উল্টো রথ

উল্টো রথমোবারক হোসেনরাজু ছিল অদ্ভুত এক চরিত্র। গ্রামের মাঠে-ঘাটে, রাস্তার ধারে, কুড়ানিতে কিংবা মেলা-পার্বণে সে যে ছিল, তবুও যেন কোথাও ছিল না। মুখে মৃদু হাসি, চোখে স্থিরতা, হৃদয়ে যেন এক অদৃশ্য দেয়াল। গ্রামের মেয়েরা যেমন তার পেছনে চোখে প্রেমের দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকত, রাজু তেমনি নির্বিকার। যেন তার হৃদয়টা পাথর দিয়ে গড়া।এই রাজুরই পেছনে পড়ে গেল লুবাবা।লুবাবা, গ্রামের ধনী হুজুর সাহেবের একমাত্র মেয়ে। পড়াশোনায় ভালো, দেখতে চাঁদের মতো, আর আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়ায় অভিমানীও বটে। রাজুর সেই পাথরের মতো নির্লিপ্ত স্বভাব তাকে যেন আগুনে পোড়াতে লাগল। লুবাবা রাজুকে নানা ভাবে কাছে টানার চেষ্টা করল—মেলায় হাতে তৈরি মিষ্টি দিল, মসজিদের পাশে বই রেখে অপেক্ষা করল, এমনকি রাজুর মায়ের সাথেও মিষ্টি হেসে কথা বলল।কিন্তু রাজু? সে শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল—“তুমি খুব ভালো মেয়ে, কিন্তু আমি কারো কিছু নই।”এই কথাটা যেন লুবাবার বুকের ভেতর খোঁচা দিয়ে রয়ে গেল।তারপর একদিন খবর এলো—লুবাবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শহরের এক বড় ব্যবসায়ী ছেলের সাথে। পাকা কথা, আংটি, আয়োজন সবই হয়ে গেল হুড়োহুড়িতে। লুবাবা প্রতিবাদ করল না। শুধু বিয়ের আগের রাতে সে চুপিচুপি রাজুর ঘরের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটুও কিছু না বলে ফিরে গেল।আর ঠিক পরদিন থেকেই পালটে গেল রাজু।সে আর আগের মত মাঠে যায় না, মেলাতেও দেখা যায় না, কারো সাথে কথা বলে না। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, ঠোঁট শুকনো। আর তারপর শুরু হলো জ্বর।গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে—এই বুঝি ওর কিসের বদনজর লাগলো। কেউ বলে—লুবাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই ছেলে বদলে গেছে।রাজুর মা এক রাতে তাকে জিজ্ঞাসা করল—“তুই তো বলতিস, তোদের কিছু ছিল না। এখন এমন করছিস কেন রে?”রাজু চুপ করে থাকে। শুধু বলে—“কিছুই ছিল না আম্মা, তবু যেন সব ছিল।”তারপর এক ভোরবেলা, গ্রামের কেউ রাজুকে খুঁজে পায় না। ঘর খালি, খাটে তার গায়ের চাদর। শুধু একখানা কাগজ রাখা—“রথ যখন উল্টো পথে চলে, তখন কেবল চাকা না, মনও পিষ্ট হয়। আমি ভাল ছিলাম না, এখনও না। তবে শান্তি খুঁজতে যাচ্ছি। লুবাবা ভালো থাকুক।”সেই থেকে রাজুকে আর দেখা যায়নিগ্রামের কোথাও, কেউ বলে সে হিমালয়ের কোনো আশ্রমে, কেউ বলে সে বাউল হয়ে পথে পথে গান গায়।