স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের তোমার স্মৃতি

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের তোমার স্মৃতিমোঃ মিলন হকআমি দেখেছিলাম তোমাকে সেই কবে!এক ক্লান্ত দুপুরে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, তুমি অপেক্ষমান বই হাতে বসে ছিলে। সবার ভিড়ে একান্ত আপন মনে। আমি এক পথ হারানো পথিক, শহরের মুখ চেনা ভিড়ে পথ ভুলে ছুটে এলাম তোমার কাছে। তোমার বইয়ের পাতার আড়াল থেকে মুখ তুলে এক মায়াবি হাসি হেসে তুমি জিজ্ঞেস করলে,— `পথিক!তুমি কি পথ হারিয়েছো?``আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারিনি।তোমার পাশে বসা বান্ধবীরা আমাকে দেখে হেসে উঠলো। তাদের মৃদু হাসি আর কিশোরী উচ্ছ্বাসে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। তুমি তাদের উপর হালকা বিরক্তির ছোঁয়া দিয়ে বললে,— ``আরে বাদ দাও তো ওকে নিয়ে মসকরা। দেখছো না, ক্লান্ত!``তুমি আমার দিকে এক বোতল পানি বাড়িয়ে দিয়ে বললে,— ``পানি খাও, অবসাদ যাবে।``আমি বোতল হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর তখনই বান্ধবীরা আবার হেসে উঠলো। তুমি হেসে বললে,— ``এই পাগল!মুখ পরিষ্কার করে পানি খাও।``কিছুক্ষণ পর বাদামওয়ালা মামা এসে হাজির। তোমরা সবাই বাদাম কিনলে। আমি চুপচাপ তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হয়তো আমিও চাইছিলাম।মামা চলে যেতে না যেতেই তুমি ডাক দিলে,— ``মামা, পাগলটাকেও এক ঠোঙা দাও।``আমি একটু লজ্জা, একটু খুশি নিয়ে বাদাম হাতে প্ল্যাটফর্মের এক পাশে তেঁতুলগাছের নিচে গিয়ে বসে বাদামের খোসা ছাড়াতে থাকলাম। হঠাৎ তোমার এক বান্ধবী বললো,— ``তোমার পাগলটা গাছে উঠে তেঁতুল পারতে পারবে?``তুমি বিরক্ত হয়ে বললে,— ``আশ্চর্য!অপরিচিত মানুষটা কবে থেকে আমার হয়ে গেল!``কী জানি কেন, তোমার এই কথাটা আমার মনে গভীর রেখা টেনে দিলো।এরপর ট্রেন এসে গেল। সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠতে লাগলো। তুমিও তোমার বান্ধবীদের সাথে `গ` বগিতে উঠে পড়লে। আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই।অগত্যা আমিও তোমাদের সঙ্গী হয়ে রইলাম।ট্রেনে তুমি দারুণ প্রাণোচ্ছল। পাশের দম্পতির বাচ্চাদের নিয়ে হাসি-আড্ডায় মেতে গেলে। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।পরের স্টেশনে একটা সিট খালি হলো। বসে পড়লাম। ক্লান্তি আর তন্দ্রা এক হয়ে এল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।ঘুম ভাঙলো ঝাঁকুনিতে। চোখ মেলেই দেখি, তুমি নেই। পুরো কামরা টা যেন হঠাৎ শুনশান স্তব্ধ।মনে হলো, তুমি কোনো মায়াবী স্বপ্ন হয়ে এসেছিলে। আমার ক্লান্ত দুপুরের গল্প হয়ে। যাওয়ার সময় একবার ডেকে গেলে না। জাগিয়ে দিলে হয়তো তোমার সেই হাসিটা আরও একবার দেখে নিতে পারতাম।স্টেশন, ট্রেন, বাদামওয়ালা, তেঁতুলগাছ — সব আজও আছে। শুধু তুমি নেই। আর নেই সেই দিনটার মতো মেঘলা দুপুর।মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয়, আবার কোনো ট্রেন এসে থামবে। তুমিও হয়তো এক বোতল পানি হাতে এসে বলবে,— ``এই পাগল!মুখ পরিষ্কার করে পানি খাও।``শুধু এইটুকু আক্ষেপ থেকে গেল।আমি কবি নই। তবে তোমার চোখের ভেতর লুকানো সাগরের গভীর রহস্য নিয়ে হয়তো একদিন কোনো কবির কাছে গিয়ে বলবো।