মোঃ মিলন হক গ্রামের নাম বড়বাড়ি। সেই গ্রামের জমিদার হেলাল চৌধুরী। হেলাল চৌধুরী একজন বৃত্তবান, পরাক্রমশালী। তার বংশের শেষ চিহ্ন এবং পদবী শুধু রয়েছে । অতীতের গৌরবময় ঐশ্বর্য, সময়ের পরীক্রমায় কিছুটা লাঘব পেয়েছে।তারপরও হেলাল চৌধুরীকে এলাকায় লোকজন অনেক প্রচুর সম্মান দেয়। তার স্ত্রীকে গরীব প্রজারা ` কর্তা মা` বলে ডাকে। তার স্ত্রী বেশ প্রজা বৎসল। তার তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে।তার নিজস্ব জমিদারিতে সংসারে ব্যয়। দান দাক্ষিণ্যে তার রয়েছে প্রচুর সম্মান। সারাবছর তার বাড়িতে কাজের লোকের সমাগম ঘটে।দূরদূরান্ত থেকে লোকজন , তার বাড়িতে কাজের অন্বেষণে যায়। তিনি লোকজনকে নির্দিষ্ট মেয়াদের কাজ দেয়। যেমন খরার মৌসুমে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে, তার বড় বড় পুকুরের ও নদীর একাংশে। মাছ ধরার কাজের জন্য , জেলে সম্প্রদায়ের জেলেরা যায় । তারা বর্ষার মৌসুম আসার আগে, আবার তাদের নিজেদের গ্রামে ফিরে যায়।দূরদূরান্ত থেকে তার ফসলি জমির ফসল কাটতে অনেক মানুষ যায়। অনেকে ফি বছর অবস্থান করে তার তাঁবুতে। অনেকে আবার রাখালের কাজ করে । অনেকেই আবার পরিবারসহ অবস্থান করে, হেলাল চৌধুরীর ডেরায়।অনেক মহিলাও যায় হেলাল চৌধুরীর তাঁবুতে তাদের স্বামীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে অনেক মহিলা হেলাল চৌধুরীর বাড়িতে কাজ করে, জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক শিশু ও থাকে, তাদের বাবা- মায়ের সাথে। শিশুদের নতুন বাসস্থান ও নতুন জায়গায় বেশ ভালো লাগে, আনন্দ উপভোগ করে।একদিন মাঘ মাসের দুপুর বেলায়, একজন মহিলা নহনা নদীর ঘাটের বটতলায় বসে কান্না করে। নহনা নদীর হাঁটু জলে, কোন রকমে নদীতে নৌকা পারাপার হয় । তিনি ব্যতীত ঘাট কুয়াশায় জনমানবহীন।জেলে পাড়ার জেলেরা মাঘের রবির উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অন্নহীন ঘর ছেড়ে, সংসার চালানোর তাগিদে হেলাল চৌধুরীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় । একদিন পরে দুপুরে তারা, নহনা নদীর ঘাটে পৌঁছায় । ঘাটে এসে দেখে, তীব্র কুহেলিতে ঘাট জনমানবহীন।জেলেরা নৌকা ঘাটে বেঁধে দেয়, খাওয়া এবং বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। ঘাটের কাছে তারা দেখে ; একজন মহিলা চব্বিশ- পঁচিশ বছরের, বট তলায় বসে কান্না করে।তারা কাছে গিয়ে, দেখে মহিলার গাঁয়ে শীতের বস্ত্র নেই । তাদের মধ্যে বড় জেলে জালাল। জালাল বলেন, ``বোন ,আপনার কি হয়েছে? এই তীব্র ঠাণ্ডায় একা বসে, কেন কান্না করছেন ? আপনার বাড়ি কোথায়? এবং কোথায় যাবেন?`` মহিলা বলেন, ``ভাই, আমার বাড়ি এই গ্রামের শেষ সীমানার উত্তর প্রান্তে । আমার স্বামী মারা গেছে, তিন বছর হয়েছে। আমার বাবা- মা নেই ।আমি একাই । ভাই- বোন নেই। বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুড়- শাশুড়ি আছে । তারা আমাকে সহ্য করতে পারে না! তাদের ছেলে মারা যাওয়ায় । তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।আজ এক সপ্তাহ থেকে প্রায় অর্ধ অনশনে আছি ।কারো কাছে হাত পাততেও পারি না । নদীতে মরতে এসেছিলাম । ``জেলেরা মহিলার কথা শুনে নির্বাক! কিছুক্ষণ পর জালাল বলেন, বোন তোমাকে মরতে হবে না। আমরা আছি, কোন এক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।বিধবার মনে, বেঁচে থাকার বীজ অঙ্কুরিত হয়।কান্না বন্ধ করে বলেন ভাই, ``আপনারা কোথায় যাবেন?`` জালাল বলেন, `হেলাল চৌধুরীর বাড়িতে।` তিনি খুব ভালো মানুষ। আপনাকেও সেখানে নিয়ে যাবো, যদি আপনার সম্মতি থাকে তাহলে....।কিছুক্ষণ পর জালাল, রহমান ও করিমকে খাবারের বন্দোবস্ত করতে বলে। তিনি নৌকায় হুকা টানতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর জালাল তার একটা কম্বল মহিলাকে গায়ে, জড়িয়ে নেওয়ার জন্য দেয়।মহিলা গায়ে কম্বল জড়িয়ে বসে থাকে।করিম রান্নার জন্য উনানে আগুন দেয়। মহিলা করিম কে বলেন,`ভাই আমাকে ভাত রান্না করতে দেন। আপনি আমাকে সাহায্য করেন।` করিম ইতস্তত করে উনান ছেড়ে দেয় এবং তরকারির আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। রান্না শেষ করে খাওয়া- দাওয়া করে ,বিশ্রাম নেয় জেলেরা।মহিলা বটতলার নিচে বসে থাকে।বিশ্রাম শেষে মহিলার কাছে গিয়ে রহমান বলেন,` বোন আপনাকে বড়ভাই ডাকে।`মহিলা কাছে আসলে জালাল বলেন, ``বোন আপনি কি আমাদের সাথে যেতে রাজি আছেন?`` মহিলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।তখন জালাল বলেন, তাহলে নৌকায় ওঠেন।সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছায় হেলাল চৌধুরীর বাড়িতে।হেলাল চৌধুরীর সঙ্গে জালাল, রহমান ও করিম রাত আটটায় দেখা করে। জালাল মহিলার বিষয়ে সব কথা হেলাল চৌধুরীকে বলে । জালাল ,রহমান ও করিম অনেক অনুনয় করে হেলাল চৌধুরী কাছে । যেনো তার বাড়িতে মহিলাকে রাখে। হেলাল চৌধুরী মহিলাকে তার নাম ও স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করে এবং বাপের গ্রাম ও শ্বশুর বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে।মহিলা বলেন,`` আমার নাম জেরিন। স্বামীর নাম সাগর। বাপের বাড়ি রহিমানপুর। স্বামীর বাড়ি কাশিপুর। কোন সন্তান হয় নি। স্বামী মারা গেছে ।বাবা-মাও মারা গেছেন। শ্বশুর- শাশুড়ি সহ্য করতে পারে না! আমি তাদের ``চোখের বালি।``তাই বাধ্য হয়ে মরতে এসেছিলাম বাড়ির পাশের নহনা নদীর ঘাটে।হেলাল চৌধুরী বলেন,আজ থেকে আপনাকে মরতে হবে না। আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন।হেলাল চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে, বেশ ভালো যাচ্ছিলো। কিছুদিনের মধ্যে হেলাল চৌধুরীর বউ রুনার মনের মধ্যে, জেরিন কাজের মধ্যে দিয়ে জায়গা করে নেয়। রুনা জেরিন কে অনেক স্নেহ করে। রান্না ঘরে রান্না করার সময় অনেক গল্প করে। হেলাল চৌধুরীর মাও বেশ ভালোবাসে।তার ছেলে মেয়েরাও জেরিনকে বেশ ভালোবাসে।জেরিন সবার ভালোবাসায় বিমোহিত।হেলাল চৌধুরীর সাথে বেশি কথা হয় না। হেলাল চৌধুরীর নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন।দিনে তিন বেলায়, শুধু খাওয়ার সময় দেখা পায়। জেরিনের রান্না খেয়ে, হেলাল চৌধুরী তার অনেক প্রশংসা করে। হেলাল চৌধুরীর স্ত্রী তাকে নিজ বোনের মতো ভালোবাসে। কোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে নিয়ে যায়। জেরিনকে মাঝেমধ্যে দেখা করার জন্য জালাল, করিম ও রহমান তাঁবু ছেড়ে হেলাল চৌধুরীর বাড়ি যেত।এভাবে পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়। জলাল, রহমান ও করিমের বাড়ি ফেরার দিন ঘনিয়ে আসে নিকটে।একদিন রাতে জলাল তার বাড়িতে জেরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেলাল চৌধুরীকে বলে । হেলাল চৌধুরী নিরব থাকে । হেলাল চৌধুরীর পাশে দাড়িয়ে থাকা; রুনা বলেন,``জেরিন এখানে থাকবে আমার সঙ্গে। আমার বাড়িতে।`` পরদিন সকালে জেরিনকে রেখে জালাল, রহমান ও করিম বিদায় নিয়ে চলে যায়।কিছুদিন পরে রুনা তার বাপের বাড়ি যায় মাসখানেক জন্য। রুনা তার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব জেরিনকে দিয়ে যায়। জেরিন সংসারের সব কিছু দেখে রাখে নিজ দায়িত্বে । এরপর একদিন রাতে হেলাল চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। জেরিন ডাক্তারকে নিয়ে আসার জন্য ফরিদকে পাঠায়। ফরিদ ডাক্তার নিয়ে আসে । ডাক্তার হেলাল চৌধুরীকে দেখে কিছু ওষুধপত্র লিখে দেয় এবং বিশ্রাম নিতে বলেন । জেরিন এক সপ্তাহ হেলাল চৌধুরীর অক্লান্ত সেবা যত্ন করার পরে, হেলাল চৌধুরী সুস্থ হয়ে ওঠেন । জেরিনকে হেলাল চৌধুরীর ভালো লাগে।রুনা বাড়িতে এসে জানতে পারে, তার স্বামীর অসুস্থতার কথা। তার শাশুড়ির কাছে জেরিনের অক্লান্ত সেবা যত্নের কথা জানতে পারে ।জেরিনের প্রতি রুনার ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়।রুনা কিছু দিন পর আবার বিকালে বাপের বাড়ি যায়। তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। হেলাল চৌধুরী বাড়িতে ছিল না। হেলাল চৌধুরী তার মায়ের কাছে জানতে পারে; রুনার মা অসুস্থ । রুনা দেখার জন্য গেছে, ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে। জেরিন রাতে হেলাল চৌধুরীর খাবার পরিবেশন করে। হেলাল চৌধুরী বলেন,``আপনি কি বিয়ে করতে রাজি আছেন?``জেরিন বলেন, ``এ দেহে যদি প্রাণ পায়। তারে সব উজাড় করে দিব। আমার মতো চোখের বালি কারো, সংসারে ঠাঁয় হবে না।``হেলাল চৌধুরী বলেন,``যদি আপনার সম্মতি থাকে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।`` জেরিন বলেন,`না।` আপনি কেন আমার প্রতি এত্তো মায়া দেখাবেন![যদিও এখানে বলে রাখা ভালো, মনে মনে জেরিনের হেলাল চৌধুরীকে প্রথম দেখায় ভালো লেগে যায়]আপনি এমনিতেই আমার অনেক উপকার করেছেন। দয়া বশত আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে। তাছাড়া আপনার সংসার আছে।আপনার বউ বাচ্চা আছে। আপনি কেন আমাকে বিয়ে করবেন? আমার মাঝে কি এমন আছে, যে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?এভাবে কিছু দিন যায় একদিন দুপুরে হেলাল চৌধুরী হুক্কা ধরিয়ে নেওয়ার জন্য জেরিনকে ডাকে।হেলাল চৌধুরী জেরিনকে বলেন, ``সেদিন যে রাতে বলেছিলাম, ঐ বিষয়ে কিছু ভেবেছেন কি?`` জেরিন বলেন, `না।` একথা বলার পর জেরিন রুম থেকে, বের হয়ে তার রুমে যায়। জেরিন বিছানায় শুয়ে কল্পনা করতে থাকে। জেরিনের ভাঙা মন পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে উড়তে চায়!রুনা ও জেরিনের মধ্যে সম্পর্ক আরও অনেক মধুময় হয়। রুনা তার জীবনের সব দুঃখ, আনন্দ জেরিনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। হেলাল চৌধুরীর বাড়ির সবাই জেরিন কে, নিজের বাড়ির লোকের মতোই সম্মান। তাকে কেউ কাজের লোক মনে করে না।অপরদিকে হেলাল চৌধুরী বিভিন্ন ছল করে তাকে কাছে ডাকে এবং বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।একদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে কারেন্ট না থাকায়। জেরিন হেলাল চৌধুরীর রুমে যায় হারিকেনের আলো দিতে। হেলাল চৌধুরী রুমে শুয়ে ছিল।হেলাল চৌধুরী জেরিন কে দেখে বলেন , কিছু কথা আছে। জেরিন বলেন, বলেন কী কথা? হেলাল চৌধুরী বলেন, ``আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি নই কেন?`` জেরিন বলেন, ``যদি আপনার প্রস্তাবে রাজি হয়, আমাকে রাখবেন কোথায়?`` হেলাল চৌধুরী বলে, ``আমার মনের মধ্যে। আপনার যেখানে ইচ্ছে!`` তারপর হেলাল চৌধুরী জেরিনকে জড়িয়ে ধরে। এরপর একদিন রাতে হেলাল চৌধুরী লুকিয়ে জেরিন কে বিয়ে করে।বিয়ের ছয় মাস পর একদিন রুনা; তাদের বেশ অন্তরঙ্গ দৃশ্যে দেখে!যা কোন দিন রুনা জেরিনের কাছে প্রত্যাশা করে নি। সেই ঘটনার রাতে রুনা জানতে পারে হেলাল চৌধুরী ও জেরিন বিয়ে করেছে। এরপর জেরিন হয়ে ওঠে,রুনার ` চোখের বালি।`
বড়বাড়ি গ্রামের, জমিদার হেলাল চৌধুরী।তার বাড়িতে বিভিন্ন পেশার মানুষ কাজ করতে আসে।একদিন মাঘ মাসে,তার পুকুর ও নদীর একাংশে মাছ ধরার জন্য তিন জন জেলে নহনা নদী দিয়ে যাচ্ছিল । দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তারা নদীর ঘাটে থামে । ঘাটে তারা একজন নারী কে দেখতে পায় । ঐ নারী জলডুবি হওয়ার জন্য ঘাটে অপেক্ষা করে। তখন জেলেরা তাকে, হেলাল চৌধুরীর বাড়ি নিয়ে যায়। হেলাল চৌধুরীর বউ রুনার সাথে ঐ নারীর খুব ভালো সম্পর্ক হয়। পরবর্তীতে হেলাল চৌধুরী সঙ্গে ঐ নারীর বিয়ে হয়।
0 Comments