কাঠ গোলাপ

 তখন আশ্বিন মাসের শেষভাগ। গ্রামের পশ্চিম পাড়ার ছোট্ট স্কুলঘরটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তমাল। মাথার উপর নীল আকাশ, হালকা রোদে কাঠগোলাপ গাছটা সোনালি হয়ে ঝলমল করছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল কাঠগোলাপের মৃদু গন্ধ। এই গন্ধই একদিন ভালোবেসেছিল তারা দু’জন—তমাল আর ঋদ্ধিতা।ঋদ্ধিতা ছিল ওদের স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা। সদা হাস্যোজ্জ্বল, শান্তচরিত্র আর গভীর দৃষ্টির এক মেয়ে। তার চোখে ছিল কেমন এক শূন্যতা, যেন পৃথিবীর সব সুখ তার হৃদয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়লেও সে শুধু নীরব হাসি দিয়ে ফিরিয়ে দেবে। তমাল তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। সেই বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল ভালোবাসা মানে শুধু বয়স নয়, ভালোবাসা মানে অনুভব, নিঃশব্দে আত্মার টান।প্রতিদিন ক্লাস শেষে ঋদ্ধিতা ছাদে গিয়ে কাঠগোলাপ গাছটার নিচে বসত। বই পড়ত, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে চেয়ে থাকত। তমাল দূর থেকে তাকিয়ে থাকত। একদিন সাহস করে সে কাঠগোলাপের কয়েকটা ফুল তুলে ওর সামনে রেখে বলেছিল,\"আপনার চোখের মতোই সুন্দর এই ফুলগুলো।\"ঋদ্ধিতা চমকে তাকিয়েছিল তার দিকে। তারপর হালকা হেসে বলেছিল,\"তোমার চোখেও শুদ্ধতা আছে, তমাল। তবে এখনো তুমি কিশোর। সময় হলে বুঝবে, কাঠগোলাপের সৌন্দর্য শুধু বাহিরে নয়, ভিতরেও কাঁটা থাকে।\"বছর পেরিয়ে গেল। তমাল কলেজে উঠল। আর ততদিনে ঋদ্ধিতা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে গিয়েছে। স্কুলে গুঞ্জন উঠেছিল—শহরের একজন প্রফেসরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। তমালের মনটা একেবারে খালি হয়ে গিয়েছিল, যেমন খালি হয়ে যায় গ্রীষ্মে নদীর বুক।কয়েক বছর পর, শহরের এক বইমেলায় হঠাৎ দেখা হয়।ঋদ্ধিতা ক্লান্ত, শীর্ণ, আর চোখে সেই পুরনো শূন্যতা। তমাল তাকে দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,\"আপনি ভালো আছেন?\"ঋদ্ধিতা মাথা নাড়ে,\"ভালো থাকাটা সবসময় সম্ভব হয় না, তমাল। কাঠগোলাপের মতোই কিছু সম্পর্ক কেবল ঝরে যায়, গন্ধ রেখে যায়, কিন্তু ফুল থাকে না।\"তমাল বুঝে গিয়েছিল—ঋদ্ধিতা বিয়ে করেনি। অথবা করেও সে ভালোবাসা পায়নি। সে জানতে চায়নি বিস্তারিত। শুধু একটা কাঠগোলাপ তুলে তার হাতে দিয়েছিল।ঋদ্ধিতা তাকিয়ে বলেছিল,\"তুমি এখনো ফুল দাও? এবার যদি কাঁটা লাগে?\"তমাল হাসে,\"ভালোবাসা মানে কাঁটা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু কেউ যদি ভালোবাসে, সে ফুলটাই দেখে কেবল।\"পরের বছর গ্রামের সেই স্কুলঘরের সামনে কাঠগোলাপ গাছটা কেটে ফেলা হয়। গাছটার গোড়ায় কেউ একজন কাঠের ফলকে লিখে রেখে যায়:“যারা ভালোবাসে, তারা চুপচাপ অপেক্ষা করে—একটি ঝরা কাঠগোলাপের গন্ধের জন্য।”আর তমাল? সে আজও চুপ করে বসে থাকে গাছটার ছায়ায়, যদিও গাছ আর নেই। তবুও মনে হয়, কোথা থেকে যেন এখনো সেই সুবাস ভেসে আসে।

কাঠ গোলাপ

• মোবারক হোসেন
• 25/06/2025
• 15 views
• 0 Comments

তখন আশ্বিন মাসের শেষভাগ। গ্রামের পশ্চিম পাড়ার ছোট্ট স্কুলঘরটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তমাল। মাথার উপর নীল আকাশ, হালকা রোদে কাঠগোলাপ গাছটা সোনালি হয়ে ঝলমল করছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল কাঠগোলাপের মৃদু গন্ধ। এই গন্ধই একদিন ভালোবেসেছিল তারা দু’জন—তমাল আর ঋদ্ধিতা।ঋদ্ধিতা ছিল ওদের স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা। সদা হাস্যোজ্জ্বল, শান্তচরিত্র আর গভীর দৃষ্টির এক মেয়ে। তার চোখে ছিল কেমন এক শূন্যতা, যেন পৃথিবীর সব সুখ তার হৃদয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়লেও সে শুধু নীরব হাসি দিয়ে ফিরিয়ে দেবে। তমাল তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। সেই বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল ভালোবাসা মানে শুধু বয়স নয়, ভালোবাসা মানে অনুভব, নিঃশব্দে আত্মার টান।

See More Read Full Story