আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা থাকলেও দুর্গা দেবী হাঁটার ধরণ দেখে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন এটা অল্প বয়সী মেয়ে মানুষ। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পাশ কেটে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। পর মুহূর্তের আকস্মিক ঘটনার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না অথবা কখনও কল্পনাও করেননি।কালো বোরকা পরিহিতা মানুষটা দুর্গা দেবীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো- নানু ভাই! তুমি কেমন আছো?দুর্গা দেবী হতবিহ্বল, একবার জড়িয়ে ধরা মানুষটার দিকে তাকাচ্ছেন (আপাদমস্তক কালো পোষাকে ঢাকা বিধায় মুখমণ্ডল দেখতে পাচ্ছেন না।) আবার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন। ইতোমধ্যে চারপাশে বহু লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। আর সবার চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়। এবং হয়তোবা একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- দু\'জন তো দুই ধর্মের লোক। তাহলে ওই বোরকা পরিহিতা মহিলা হিন্দু মহিলাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কেন? আবার নানু ভাই বলে ডাকছেই বা কেন?বোরকা পরিহিতা মহিলা দুর্গা দেবীকে জড়িয়ে ধরে একই সুরে কেঁদে যাচ্ছে। এবং ক্রমশঃ আরও জাপটে ধরছে যেন।দুর্গা দেবী ধীরে ধীরে নিজেকে কিছুটা সামলে নেন। মাত্রই মন্দিরে ঠাকুর পূজা দিয়ে বাসায় ফিরছেন। এক হাতে পৃজার প্রসাদের থালাটা ভালো করে সামলে নেন। আর অন্য হাতে বোরকা পরিহিতা মহিলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন- আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এভাবে কাঁদছেন কেন? আবার আমাকে নানু বলে ডাকছেন, কারণ কী?বোরকা পরিহিতা মহিলা এবার মাথাটা তুলে দুর্গা দেবীর দিকে তাকায়। দুর্গা দেবীও তাকিয়ে থাকেন কিন্তু মুখমণ্ডল নেট জাতীয় পাতলা কালো কাপড়ে ঢেকে থাকায় কিছুই দেখতে পারছেন না।বোরকা পরিহিতা মহিলার প্রশ্ন- আমাকে চিনতে পারোনি নানু ভাই?দুর্গা দেবী কোন কথা না বলে শুধু প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে তাকিয়ে আছেন বোরকা পরিহিতা মহিলার দিকে।নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে মানহা রহমান মুখমণ্ডলের ঢাকনা সরিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে- নানু ভাই! আমি তোমার মানহা।চিনতে না পেরে দুর্গা দেবী অবাক হয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে বলেন- আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে।– এই বলেই মানহার দিকে তাকিয়ে থাকেন।না, নানু ভাই। আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। আমি তোমার সেই ছোট্ট মানহা। তুমি আমাকে কত আদর করতে, আমি প্রতিদিন তোমার বাসায় যেতাম, তোমাকে কত যন্ত্রণা করেছি, শুধু আদর নয় খুব ভালোবাসতে। এখন চিনতে পেরেছো আমাকে?দুর্গা দেবী খুব গভীরভাবে ভাবছেন।মানহা আবারও বলে- সেই গোপীবাগ তিন তলায় থাকতে তোমরা আর আমরা থাকতাম ষষ্ট তলায়। তা প্রায় বছর দশেক আগের কথা নানু ভাই।– এই বলে দুর্গা দেবীর দু\'গালে আদর আর ভালোবাসার হাত বুলাতে থাকে।চকিতে মনে পড়তেই দুর্গা দেবী মানহাকে টেনে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন- মানহা, নানু ভাই আমার! তুমি কত বড় হয়ে গেছ!ভালোবাসার কান্নায় ডুবে গিয়ে দু\'জন দু\'জনকে জড়িয়ে ধরে কান্নার আকাশে ডুবে যায়। আশেপাশের লোকজন একটা ঘোরের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে- ব্যাপারটা কী! একজন হিন্দু মহিলা আর অন্যজন আপাদমস্তক বোরকা পরিহিতা মুসলিম মহিলা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় কান্নায় বাতাস কাঁপাচ্ছে। কেউ কোনরকম কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। আসলে এমন ঘটনা, দৃশ্য অথবা ভালোবাসার উঠানে এখন আর অভ্যস্ত নয় অথবা দেখতে পায় না বা ঘটে না। ২০৩০ সালের বাংলাদেশে এখন অকল্পনীয়।দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দৃষ্টির সীমানা বুঝতে পেরে দুর্গা দেবী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মানহাকে দেখিয়ে বলেন- ও আমার পরিচিত এবং খুব কাছের ও আদরের ছিল, বলতে পারেন নিজের নাতনীর মতো।সাথে সাথেই মানহা চেঁচিলে বলে- ইনি আমার নানু ভাই। অনেক অনেক বছর পরে দেখা পেয়েছি।*গত হয়ে যাওয়া দশটি বৎসর এক নিমেষেই দুর্গা দেবীর কাছে মনে হয়- এইতো যেন গতকালের কথা। দুর্গা দেবীর পরিবার ও মানহাদের পরিবার একই বিল্ডিং-এ গোপীবাগ এলাকায় থাকতেন। দুই পরিবারই ছিল ভাড়াটিয়া। দুর্গা দেবীরা মানহাদের অনেক আগে থেকেই থাকেন এই বিল্ডিং-এ। সময়টা তখন আনুমানিক ২০২০ সালের মাঝামাঝি জুন অথবা জুলাই হবে। তখন মানহাদের সাথে পরিচয় হয় দুর্গা দেবীর।বিল্ডিং-এর ছাদে সবার শখের গাছ টবে টবে ভাগে ভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখা। এখানে ছাদে দুর্গা দেবীরও অনেকগুলো টব-গাছ আছে। অবশ্য উনার বেশির ভাগই ফুলগাছ। ঘরে ঠাকুরের আসন বসিয়েছেন। প্রতিদিন পূজার জন্য ফুল লাগে। তিনি প্রতিদিন বিকেলে ছাদে আসেন। ফুল গাছের যত্নের পাশাপাশি বৈকালিক হাঁটাটাও সেরে নেন।করোনাকালীন দুঃসময় বিধায় এখন ছাদে তেমন কেউ আসে না। তবে ক\'দিন ধরে দুর্গা দেবী খেয়াল করছেন একজন অল্প বয়স্ক মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ওদের সাথে দুর্গা দেবীর পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি যেচে এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলেন। বাচ্চা মেয়েটার নাম মানহা আর ওর মা ফাতিমা। ওরা এই বিল্ডিং-এ ভাড়াটিয়া হিসেবে গত মার্চে ওঠেছে। কিছুক্ষণ খোশ-গল্প করে দুর্গা দেবী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।এই বিল্ডিং-এ আসার পর থেকে করোনার কারণে প্রায় বন্দী জীবনই বলা চলে। প্রায় পাঁচ মাস হ\'তে চলল কারও সাথে পরিচয় হয়নি, এমনকি পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনদের সাথেও। ওদের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি- স্বামী-স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ে মানহা। মানহার আব্বা অফিসে চলে গেলে সারাদিন দু\'জন একেবারে একা। ফাতিমার স্বামী মজলিস খান ধর্মপ্রাণ মানুষ। বাসায় টিভি আনেন না। তাই হাতের মোবাইল ফোনটাই একমাত্র অবলম্বন। কিছুক্ষণ মেয়ের হাতে থাকে তো আবার কিছুক্ষণ নিজের হাতে নেন। কিন্তু স্বামীর নির্দেশ ওয়াজ ছাড়া কিছুই যেন না শোনেন বা দেখে এই মোবাইল ফোনে। আর মেয়ে মানহা মোবাইল ফোন টিপে টিপে গেমস খেলে। সারাদিন সংসারের কাজ, মেয়ের দেখাশুনা আর ওয়াজ শোনা এই হলো ফাতিমার দিন। তবে মেয়ে মানহাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত ওর মা-বাবা। কারণ এই পাঁচ-ছয় বৎসর বয়সেও সে এক নিঃষ্প্রাণ, অচঞ্চলা মানবী। এ\'টুকুন মেয়ের চঞ্চলতায় ঘরটা ভরপুর করে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানহা সারাদিন একেবারে নির্জীব থাকে। তাই মনটাকে একটু সজীব করতেই কয়েকদিন যাবৎ ছাদে যাচ্ছে মেয়েকে নিয়ে।মানহা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম কথা বলে, স্বল্পভাষী বললেও বেশি হয়ে যায়। মোবাইল ফোনে টিপাটিপি করে গেমস খেললেও তা\' বেশিক্ষণ নয়। চুপচাপ বসেই থাকে বেশির ভাগ সময়। খাবারও তেমন একটা খেতে চায় না। মা ফাতিমা রীতিমতো জোর করে করে একটু-আধটু খাওয়ায়। কিন্তু যা খাওয়া দরকার তা সে খেতে চায় না। আজে-বাজে অন্যান্য জিনিসে তার আসক্তি। যেমন- চিপস, চকোলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি। তবে কতক্ষণ পরপর বলে- আম্মু এলাচ খাবো, এলাচ দাও। এলাচ খাওয়া ওর নেশা। গোটা কয়েক এলাচ কতক্ষণ পরপর মুখে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে দিব্যি খেয়ে ফেলে। এক অদ্ভুত নেশা।*ফাতিমাকে ডেকে মানহা বলে- আম্মু ছাদে চল।ফাতিমা মানহার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।খাওয়া শেষে টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে রাখে। কারণ কিছুক্ষণ পরই স্বামী অফিস থেকে চলে আসবেন ফোনে জানিয়েছেন।মানহা মায়ের পিছু পিছু ঘুরছে। বারবার একই কথা- আম্মু চলো ছাদে যাই।মায়ের কোন আগ্রহ না দেখে শেষমেষ সেলোয়ার ধরে টেনে বলে- আম্মু চলো ছাদে যাই!- কথাতে একটু বিরক্তি ভাব ছড়িয়ে পড়ে।ফাতিমা এবার মানহার দিকে ফিরে তাকায় এবং মনোযোগ সহকারে চোখে চোখ রাখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে।মানহা এতটুকুন হলেও ঠিকই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আবারও বলে- আম্মু চলো ছাদে যাই।মা ফাতিমা এবার বেশ অবাক হয়েই তাকায়। মেয়ে মানহা তো কখনও ছাদে যাবার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে বলে না! মনে মনে বেশ খুশী হয় ফাতিমা। মেয়েকে আদর করতে করতে শান্ত কন্ঠে বলে- একটু পরে যাই? এখনও বিকেল হয়নি।মানহা এমনিতে খুবই নরম প্রকৃতির ও শান্তশিষ্ট মেয়ে। নিজের রাগ, অভিমান নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখে, গাল ফুলিয়ে মেঝেতে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সে।নিজের কাজে ব্যস্ত ফাতিমা কিছুক্ষণ পর মেয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক। কাছে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলে- ঠিক আছে, একটু বসো, হাতের কাজটুকু শেষ করে নিই তারপর তোমাকে নিয়ে ছাদে যাবো, ওকে?ওকে!- মুহূর্তেই মানহার অভিমানের আকাশের মেঘাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গিয়ে যেন রৌদ্রজ্জ্বোল হয়ে ওঠে। একটু মুচকি হাসি ছড়িয়ে খাটের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে। মেয়ের এমন উজ্জ্বল হাসিটুকু মা ফাতিমার নজর এড়ায়নি মনে মনে সে বেশ প্রীত অনুভব করে। কারণ মেয়েটা সারাক্ষণ কেমন যেন গোমড়ামুখো হয়ে সময় কাটায়।*ছাদে পা রেখেই ফাতিমা আকাশের দিকে তাকায়- এখনও রোদের তেজ কমেনি। মেয়েকে নিয়ে একটু ছায়ামতো জায়গায় বসার চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়ে মানহা ওখানে বসতে চায় না। প্রতিদিনকার মতো মাঝখানটায় গিয়ে বসে সে। কপালে একটা হাত রেখে মুখমণ্ডলটা ছায়ায় রাখার চেষ্টা করে ফাতিমা। মেয়ের সন্মুখে দাঁড়িয়ে বলে- এখানে রোদ মানহা, একটু পরে এসে বসি। এসো ছায়ায় যাই।এক ঝটকায় মুখটা ঘুরিয়ে মানহা রোদের মধ্যেই ছাদের মাঝখানটাতেই বসে থাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ মেয়ের সামনে দাঁড়ায় ফাতিমা। মেয়ে মানহা মুখ ঘুরিয়ে দু\'হাতের মুষ্টি দু\'গালে ঠেকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। অভিমানী মেয়ের অভিমানে মুগ্ধ হয়ে মা মেয়ের পাশেই বসে। তারপর ওড়নার আঁচলে নিজ এবং মেয়েকে ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে।দুপুর মাত্র গড়িয়েছে। রোদের তেজ এখনও তেমন একটা কমেনি। রোদটা বেশ চড়া। এমন সময়টায় চারদিক সাধারণতঃ একটু হালকা নিরব থাকে। আকাশে পাখিদের ওড়াউড়ি অনেক কম। যদিও এখন কাক-পাখিদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। একে তো নাগরিক পরিবশ- গাছপালার সংখ্যা, নদী-নালার সংখ্যা সবই একেবারে নগণ্য। তার ওপর মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কিং-এর জন্য আল্ট্রাভায়োলেট রে-এর চলাচলে পাখিদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। চড়ুই পাখিতো কমার হার চোখে পড়ার মতো। তবে এই ছাদে কাক-পাখিদের বেশ আনাগোনা আছে। কারণ ছাদে টবে রয়েছে রকমারি গাছ। নানারকম ফুল গাছের আধিক্যই বেশি। কারণ এই বিল্ডিং- এ বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবার থাকে। সবাই কোন না কোন ফুল গাছ, তুলসি গাছ, কলা গাছ, বেল গাছ, এমন নানান রকম গাছ টবেতেই সাজিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। তাছাড়াও নানান গাছের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। যদিও সবগুলো গাছের আকার প্রকৃতিগত নয়। কারণ এদের লালন-পালন টবে অথবা ড্রামে। অবশ্য কয়েকটা গাছ বেশ বড়ও হয়েছে। ফুল-ফলের বেশ সমারোহ থাকে সব সময় যা চোখে পড়ার মতো কাঠ গোলাপ গাছটা বেশ বড়সড় ধাচেরই হয়েছে। কারণ এটা একটা বড় টিনের ড্রামে লাগানো। মানহা ওই গাছটার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। গাছটার ডালে ডালে দোয়েল পাখিটা লেজ উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিটা যে ডালে বসছে মানহার চোখ জোড়া সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো ভ্রমরের দিকে উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। মানহার ঠিক চোখের সামনেই একজোড়া রঙিন প্রজাপতি অনেকক্ষণ ধরেই ওড়াউড়ি করছে। সে বসে থেকেই প্রজাপতির উড়ে উড়ে চলা আনন্দের বাতাসে হাত নাড়াচ্ছে।বাহ! দারুণ তো।– বলেই মেয়ের দিকে তাকায় ফাতিমা। এবং বলে- প্রজাপতি, বাটারফ্লাই।মানহার চোখমুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খুশির আভা ছড়িয়ে বলে- প্রজাপতি, বাটারফ্লাই।দোয়েল পাখিটা এখনও কাঠ গোলাপের ডালে ডালে ঘুরছে। পাখিটাকে দেখিয়ে ফাতিমা বলে- ওই যে দোয়েল পাখি! নাইটিঙ্গেল।মানহা দু\'হাতে তালি বাজাতে বাজাতে মায়ের সাথে সাথে উচ্চারণ করে।মেয়ের এই হাসিখুশী মুহূর্তগুলো মা ফাতিমাকে সত্যিই মুগ্ধ করে এবং সুখী বানিয়ে ফেলে। অথচ এই মেয়েটাই কিছুদিন আগেও ছিল একেবারে নিষ্প্রাণ। কোন আনন্দের মুহূর্ত, ভালোলাগা প্রকাশ কিংবা কোন সৌন্দর্যই ওকে স্পর্শ করতো না। সারাক্ষণ নিস্তেজ আর মনমরা হয়ে মুখটা পাংশুবর্ণ করে রাখতো। দুর্গা দেবী মানুষটা সত্যিই অপূর্ব এবং অসম্ভব রকমের ভালো।– ফাতিমা মনে মনে উচ্চারণ করে আর ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায় এই সুন্দর মুহূর্তগুলো উপহার দেয়ার জন্য। সত্যিই উনার মাঝে এক মহান গুণ লুকিয়ে আছে। আল্লাহ উনাকে সুস্থ ও ভালো রেখো! মনে মনে এক ফাঁকে দোয়াও পড়ে নেয়।এটা ঠিক দুর্গা দেবীর ভালো গুণের প্রভাবে মানহা জীবনে প্রাণের সঞ্চারের ছোঁয়া পেয়েছে। কিন্তু জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং শিখতে হবে- পরিবেশ, প্রতিবেশ আর চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৌন্দর্যের ঘ্রাণ ও রং কীভাবে জীবনের রঙের সাথে রাঙিয়ে নিতে হয়। একলা বাগানে শুধুই গোলাপ যতক্ষণ না এই গোলাপের বর্ণনা, ছোঁয়া এবং ছায়া মানুষের মননে জায়গা করে নিবে। মানুষের মননে জায়গা পেলেই তবে গোলাপ অনন্য ও সার্থক। নানান ফুল, নানান গাছ, নানান ফল আছে বলেই নানান পাখি, পোকা, প্রজাপতি আর ভ্রমরের আনাগোনা। আবার মানুষও একেকজন একেকটার সৌন্দর্যে ডুবে কেউ গোলাপে, কেউবা কাঠ গোলাপে আবার কেউ কেউ শিউলী ফুলে অথবা অন্য কোন ফুলে আর নয়তো ফুলের টানে মুগ্ধতা ছড়ায়। শুধু গোলাপে অথবা অন্য কোন একক ফুল বা ফলে, না সকল পাখি অথবা সকল মানুষের মনকে টানতে পারবে। রকমারিতে সবকিছুরই পূর্ণতা আসে। সুন্দর পরিবেশ, সু্ন্দর সমাজ, সুন্দর জীবন সবকিছুতেই রকমারি সৌন্দর্যের ছোঁয়া অবশ্যই প্রয়োজন। আলোকে বুঝতে হলে যেমন অন্ধকারের উপস্থিতি থাকতে হয় তেমনি নিজে ভালো থাকতে হলে অন্যের উপস্থিতি লাগে। এই পৃথিবীর মৃত সকল সৌন্দর্যের হন্তারক এই মানুষ। নিয়ানডারথাল প্রজাতির মানুষকে প্রতিহিংসায় হত্যার মাধ্যমে বিলুপ্ত করেছে পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য এই আমাদের পূর্বপুরুষ হোমোসেপিয়েন্স। আমরা এখনো প্রতিনিয়ত পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যে থাবা বসাচ্ছি একা নিজে ভালো থাকার জন্য। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে অর্জিত সভ্যতার বিচিত্রতা। এই আমি পার্থসারথি যদি পুরো পৃথিবীটাকে আমার ভালোবাসার ফুল গোলাপে পরিপূর্ণ করে তুলি তবে শিউলি প্রিয় তুমি আমার দিকে অঙ্গুলি তুলবে আমার শিউলি ফুলের বাগ কেন নেই। তাই না? এবং এটাও নিশ্চিত আমিও কখনও বলতে পারবো না তোমার শিউলী ফুল, কাঠ গোলাপের রঙ অথবা মাধবীলতা থেকে আমার গোলাপের সৌন্দর্য অপেক্ষা বেশ ভালো। তাই না?*মা ফাতিমাকে অবাক করে দিয়ে মানহা এক ভোঁ দৌঁড়ে ছাদে ঢোকার গেইটে গিয়ে দুর্গা দেবীকে জড়িয়ে ধরলো। দুর্গা দেবী ছাদে আসছেন ফাতিমা একেবারেই টের পায়নি। এক গাল হাসি ছড়িয়ে সে দুর্গা দেবীর দিকে তাকিয়ে আছে। মানহাকে কোলে তুলে নিয়ে তিনি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসেই ফাতিমাকে বললেন- কেমন আছো ফাতিমা?জি আলহামদুল্লিহ! আপনি কেমন আছেন?ঈশ্বরের কৃপায় মোটামুটি ভালোই আছি!- বলেই মানহার গাল টিপতে টিপতে আবারও বললেন- তোমার মেয়ে তো দিন দিন একেবারে শুকিয়ে যাচ্ছে।কী করবো আন্টি! সারাদিন কিছুই খেতে চায় না।এমন করলে তো চলবে না নানু ভাই! ভালো ভালো খাবার বেশি বেশি করে খেতে হবে। কী ঠিক আছে?- বলেই এক গাল হাসি ছড়িয়ে মানহার চোখে চোখ রাখেন।মানহা ঘাড় কা\'ত করে হাসতে হাসতে ‘হ্যাঁ\' সূচক জবাব দেয়।এইতো আমার লক্ষী নানু ভাই। এবার একটু খেলা কর, আমি গাছে জল দিয়ে আসি।মানহা দুর্গা দেবীর কোল থেকে নেমেই খুশিতে তিড়িং বিড়িং করে নাচতে লাগলো।ফাতিমা ওর মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দুর্গা দেবীকে বলে- ওই, আপনাকে শুধু শুধু সান্ত্বনা দেয়। জোর করেও কিচ্ছু খাওয়াতে পারি না। পানি পর্যন্ত পান করতে চায় না, শুধু এলাচ আর এলাচ।চিন্তা করো না, বাচ্চা মানুষ, দেখবে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। কথা বলতে বলতে দুর্গা দেবী গাছের গোড়ায় গোড়ায় জল ঢেলে দিচ্ছেন। আবার কোন কোন গাছে জলের ঝাপটা ঝিটিয়ে দিচ্ছেন পাতাগুলো যেন সতেজ দেখায়। প্রত্যেক গাছে জল দেয়া শেষ হলে \'পর হাতের মগটা এক পাশে রেখে মানহা আর ফাতিমার সাথে আড্ডায় মশগুল হল। আজও অন্য কেউ ছাদে আসেনি। করোনার কারণে সবাই ঘরবন্দী জীবনযাপন করছেন। দুর্গা দেবী আসেন গাছ আর ফুলের জন্য। আর ফাতিমা আসে মেয়েকে নিয়ে দুর্গা দেবীর সান্নিধ্য পেতে। সত্যি বলতে কী, এ ক\'দিনেই মানহার চাল-চলন বেশ অনেকটাই বদলেছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত এই আচরণ শুধু দুর্গা দেবীর সামনেই। অচেনা কেউ এলেই একেবারে গুটিয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। প্রতিদিনকার মতো কাকটা কা কা করতেই মানহা দুর্গা দেবীর কাছে দৌঁড়ে এসে বলে- নানু ভাই কাক এসেছে। পানি দাও ওদের!দুর্গা দেবী একবার মানহার দিকে তাকায় আবার তাকায় মা ফাতিমার দিকে। তারপর মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে তাকান কাকের দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কলের প্যাঁচটা একটু খুলে দেন- ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে থাকে। তারপর মানহাকে নিয়ে একটু দূরে সরে আসেন। কাকটা এদিক ওদিক তাকিয়েই কলটার কাছে চলে আসে। নিশ্চিন্তে পানি পান করে কাছের রেলিং-এ বসে কয়েকবার কা কা শব্দে ডেকেই এক উড়ালে চলে যায়। মানহা খুশিতে দু\'হাতে তালি দিতে দিতে নেচে ওঠে। কাকের জলপানের তৃপ্তি দুর্গা দেবী, ফাতিমা আর মানহাকে খুশিতে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। এটা এখন প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায় প্রতিদিনই গোধূলী বেলায় বাসায় ফেরার পথে কাকটা পানি খেতে আসে। এই দৃশ্যটা সত্যিই দেখার মতো।দুর্গা দেবী গাছ থেকে একটা জবা ফুল তুলে এনে মানহার কানে গুঁজে দিয়ে মিষ্টি হেসে গাল টিপতে টিপতে বললেন- ফাতিমা দেখো দেখো, তোমার মেয়েকে একদম পরীর মতো দেখাচ্ছে। বাহ! চমৎকার।ফাতিমা হাসতে হাসতে বলল- আপনার মনটা খুব সুন্দর তাই আমার মেয়েকে আপনি আরও সুন্দর দেখেন।– বলেই পশ্চিম আকাশের দিকে তাকায় এবং বলে- আন্টি দেখেন, আকাশটা কত চমৎকার দেখাচ্ছে।দারুণ দেখাচ্ছে! তোমার মেয়ের সৌন্দর্য আর আকাশের পড়ন্ত বিকেলের শান্ত সৌন্দর্য মিলে-মিশে একাকার।ফাতিমা কোন কথা না বলে নীরব সম্মতি প্রকাশে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। দুর্গা দেবী আর ফাতিমার অনাবিল সুখময় মুহূর্তগুলো আকাশে-বাতাসে যেন অনুরণন সৃষ্টি করে মধুময় গীত রচনা করছে। আর গীতের মধুমাখা সুরের লাবণ্যে মানহা প্রতিনিয়ত নেচে বেড়াচ্ছে।ঠিক সন্ধ্যার আগেই ওরা ছাদ থেকে চলে আসে। যাবার সময় ফাতিমা বলে- আন্টি বাসায় আসবেন।আসবো, আসবো! তুমিও মানহাকে নিয়ে চলে এসো।তা\' আর বলতে হবে না আন্টি। মানহা তো সবসময় এক পা বাড়িয়ে রাখে আপনার এখানে আসতে। না এসে কি পারা যায়?ঠিক আছে, এসো, খুশী হবো। আমার নানু ভাই আসলে আমারও দারুণ সময় কাটে।মুচকি হাসি বিনিময়ে ফাতিমা মানহার একটা হাত ধরে বলে- নানু ভাইকে বলো, আল্লাহ হাফেজ।মানহা হাত নেড়ে নেড়ে দুর্গা দেবীকে আল্লাহ হাফেজ বলে বাসার দিকে পা বাড়ায়।বাসায় ঢুকেই ফাতিমা মানহার আব্বুকে বলে- তুমি চলে এসেছো! ফোন করলে না?ভাবলাম মেয়েটাকে নিয়ে একটু বেশি সময় ছাদে বেড়িয়ে এসো, তাই। মানহার দিকে চোখ পড়তেই মজলিস খানের পিলে যেন চমকে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে বলেন- কী ব্যাপার মানহা! তোমার কানে ফুল কেন!- বলেই এক টানে ফুলটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।মানহা গগন বিদারী চিৎকারে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর কান্নার সুরে সুরে বলছে- আব্বু আমার ফুল ফেলে দিয়েছে!ফাতিমা একটু রাগ দেখিয়ে বলল- কী করলে এটা! মেয়েটা একটু আনন্দে আর খুশীতে ছিল, তা\'ও নষ্ট করে দিলে।মজলিস খান বেশ রাগ করে চোখ জোড়া গোল গোল করে বলল- রাখো তোমার আনন্দ আর খুশী। তোমার কি একটুও ভয় নেই জাহান্নামের! ফাতিমা অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু কোন কথা বলে না।ফুল নিয়ে আনন্দ করা আর পূজা করা হলো বিধর্মীদের কাজ, জানো না তুমি? ওয়াজ শোনো না? এর জন্যেই তোমাকে বিধর্মীদের সাথে মিশতে বারণ করি।আমাদের মেয়েটা একটু ভালো থাকুক, চাও না?- বলেই ফাতিমা স্বামীর চোখে চোখ রাখে এবং আবারও বলে- দুর্গা দেবী মানুষটাই একটু অন্যরকম, বেশ ভালো। দেখতে উনি যেমন সুন্দর মনটাও তেমন খুব সুন্দর। তাছাড়া আমার মেয়েকে উনি খুব ভালোবাসেন আর আদর করেন। অল্প কিছুদিনেই আমাদের মেয়ের কত চমৎকার হয়েছে।মজলিস খান এবার বেশ রাগ করেই বলে- শোন, বিধর্মী বিধর্মীই ওরা কোনদিন মানুষ হবে না। আমি বলে রাখছি এখনও সময় আছে সাবধান হয়ে যাও। নইলে পরে পস্তাতে হবে!ফাতিমা অসহায় দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক প্রশ্ন মনের ভেতর কিন্তু বাস্তবে কিছুই বলে না। সেও মনে-প্রাণে ধর্মকে ধারণ করে কিন্তু ভালো করেই জানে যে, ওয়াজের সকল কথা ইসলামের মতে হয় না। ওখানে হুজুরদের মনগড়া অনেক কিছুই বলে। আর কোন কথা না বলে মেয়েকে মেঝে থেকে টেনে তুলে কোলে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানহার কান্না থামছেই না।মজলিস খান রাগে গজগজ করতে করতে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তজবা ফুলের কাছে আসে। তারপর পায়ের তলায় পিষে পিষে রাগ আর ক্ষোভ মিশিয়ে ফুলটাকে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে ফেলে। তারপর ফাতিমার উদ্দ্যেশে বলতে থাকে- বিধর্মীদের সাথে মেলামেশা করো এতেও তোমার জন্যে জাহান্নাম বরাদ্দ!ফাতিমা জানে ওসব। প্রতিদিনই মোবাইল ফোনে ওয়াজ শোনে। কিন্তু দুর্গা দেবী মহিলাটা বেশ ভালো এবং উনার জন্যে মানহাটা আজ অনেক ভালো। মনে মনে ভাবে ওসব কিন্তু মজলিস খানের কথার জবাবে কিছুই বলে না।মানহা মায়ের কোলে উঠেও কেঁদেই যাচ্ছে। হাতের চেটোয় চোখের জল মুছছে আর ফুলটার দিকে তাকিয়ে বলে- আব্বু পঁচা, আব্বু দুষ্টু।– এই বলে ফোঁপাতে থাকে।মেয়েকে কোলে নিয়ে ফাতিমা অন্য রুমে চলে যায়। তারপর ফিসফিসিয়ে মেয়েকে বলে- তোমাকে আবার ফুল এনে দেবো। ঠিক আছে?মাথা কা\'ত করে মানহা বলে- ঠিক আছে আম্মু।– কথা বলতে বলতে মানহা ফিক করে হেসে দেয়।ঠোঁটের উপর আঙুল আঁড়াআঁড়ি ফেলে ফাতিমা মেয়েকে বলে- একদম শব্দ করো না। আব্বু শুনে ফেলবে।মা মেয়েতে সন্ধি হয়ে যায়।*ধীরে ধীরে করোনার তীব্রতা কমে আসছে বিধায় ছাদে এখন লোকজনদের আনাগোনা বেড়েছে। পরিচিতির গণ্ডীটাও দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ফাতিমার। তবে সবার সাথেই বেশ সীমিত কথা হয়। যেমনটা দুর্গা দেবীর সাথে তেমনটা যেন আর কারও সাথে হয়ে ওঠছে না। সবাই যেন কেমন একটু নিজেদের গুটিয়ে গুটিয়ে চলে। কেউ কখনও যেচে এসে পরিচিত হতে চায় না। কিন্তু দুর্গা দেবী তার উল্টো এবং ফাতিমাকেও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।পড়ন্ত বিকেল। বড়দের সাথে এখন বাচ্চারাও আসা শুরু করেছে। আজ বেশ কয়েকজন বাচ্চা হইহুল্লোড়ে মেতে আছে। বাচ্চাদের সবাই মেয়ে এবং হিজাব ও বোরকা পরিহিতা। দুটো ছেলে বাচ্চা আলাদা এক কোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ছেলে-মেয়ে একসাথে খেলা চলবে না। আর পাশাপাশি কয়েকজন মহিলা- কেউ গল্প করছে, কেউবা হয়ত গাছে পানি দিচ্ছে অথবা গাছের যত্ন করছে আবার কেউ বৈকালিক হাঁটাটা সারছেন। সবাই ব্যস্ত শুধু মানহা দু\'হাত দু\'গালে ঠেসে আনমনা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। আর দৃষ্টিজোড়া মেঝেতে পাতা।ফাতিমা এখন গল্প করছে দুর্গা দেবীর পাশের ফ্ল্যাটের তানজিলার সাথে। কথা বলতে মোটামুটি ভালোই লাগছে। বেশ ধর্মপ্রাণ মহিলা এবং বয়সটাও ফাতিমার মতো। অনেকক্ষণ ধরেই কথা হচ্ছে কিন্তু কথার মাঝে তেমন প্রাণ নেই। কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে কথা বলে। তানজিলা এক ফাঁকে মানহাকে দেখে বলে- কী ব্যাপার ভাবী! আপনার মেয়ে ওভাবে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে আছে কেন?ফাতিমাও বেশ দুঃখ ভরা কন্ঠে বলে- ওর নানু ভাইয়ের জন্য মন খারাপ। তাই চুপচাপ বসে আছে।উনাকে ছাদে নিয়ে এলেন এলেন না কেন?আজ এখনও আসেনি তাই। হয়তো এখনই চলে আসবে।খালাম্মা বুঝি আপনার এখানেই থাকে?না, আমার আম্মা নয়। উনি আপনার প্রতিবেশী দুর্গা দেবী।তানজিলার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে ওঠে। এবং বলে- হিন্দু মহিলাকে নানু ভাই বলে!উনি খুব ভালো মানুষ। মেয়েটাকে খুব আদর করেতো তাই।তানজিলার মেয়েকেও দুর্গা দেবী প্রচণ্ড আদর করেন এবং ভালোবাসেন। ওর মেয়েও উনাকে নানুভাই বলে ডাকে। কিন্তু সে এটা প্রকাশ করেনি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- ও আচ্ছা, আমি ভাবলাম আপনার আম্মা। এবার কথার সুর পাল্টে তানজিলা বলে- শুনুন ভাবী, বিধর্মীদের সাথে একটু কম মেলামেশা করবেন, গুণাহ হয়!ফাতিমাও একথা জানে কিন্তু কিছুটা অবাক হয় কারণ তানজিলাকে কোনরকম পর্দা করতে দেখছে না, অথচ...! কিন্তু বলে অন্য কথা- না তেমন মিশি না, মেয়েটার জন্যে মিশতে হয়। উনি আমার মেয়েটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেনতো তাই!শুনুন ভাবী, পাপ পাপই। ওয়াজ শোনেন তো?হ্যাঁ, রেগুলারই শুনি।ভালো, খুব ভালো। শুনুন ভাবী, এখানে আমরা যা\'ই করি না কেন কিছুই সঙ্গে যাবে না। গুণাহ করলে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। হুজুরদের কথা সব আমাদের মানতে হবে।কথায় কথায় দু\'জনার মাঝে বেশ আন্তরিকতা হয়ে যায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। দু\'জন দু\'জনাকে বাসায় যাবার আমন্ত্রণটাও সেরে ফেলে। ওদের কথার মাঝেই মানহা হঠাৎ ভোঁ দৌড় দেয়। দুর্গা দেবীকে জড়িয়ে ধরেই চিৎকার করে ডাকতে থাকে- আম্মু, আম্মু নানু ভাই এসেছে! কাছে আসতেই ফাতিমা বলে- কী ব্যাপার আন্টি আজ এত দেরী করলেন যে? আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না। তাই দেরী হলো। নানু ভাইটার জন্যে এলাম আর ভাবলাম গাছগলোতে একটু জল দিয়ে যাই।দুর্গা দেবী কাছে আসার আগেই তানজিলা ব্যস্ত হয়ে গেল ওর গাছপালা আর টবের যত্নে। ফাতিমাও কথাবার্তা বলছে তবে মেপে মেপে। এর মধ্যে রেহানা পারভীনসহ আরও কয়েকজন মহিলা এসে উপস্থিত হয়। দুর্গা দেবী এসব ভ্রুক্ষেপ না করে মানহাকে নিয়ে একটু ব্যস্ত সময় কাটিয়ে তারপর গাছে জল দিয়ে ওদের সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে চলে গেলেন।এমন আচরণে দুর্গা দেবী অভ্যস্ত- তানজিলা অথবা রেহানা পারভীন ওরা যখন একা একা উনার সাথে কথা বলেন তখন ওদের কথার ধরণ থাকে বেশ প্রাণখোলা। আবার যখন দুই বা তার অধিক সংখ্যায় থাকে তখন সবাই দুর্গা দেবীর সাথে মেপে মেপে কথা বলে। সেটা উনি বুঝেন বেশ ভালো করেই। বুঝেও না বঝার ভান করে সবার সাথে সুস্পর্ক বজায় রেখেই চলেন। এটা উনার ব্যক্তিগত স্বভাব, কাউকে খুশী করার জন্য নয়। এদের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই দুর্গা দেবীর তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু তিনি এমনটা কখনও প্রত্যাশা করেননি। কারণ সবাই বেশ শিক্ষিতই বলা চলে। দুঃখের বিষয় সবাই এখন একটু অন্যরকমই হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে ওরা কেউ না কেউ ইসলামের দাওয়াত দেয়। এতে নাকি ওদের সোয়াব হয় আর বেহেস্তের দরজা খোলা থাকে।জীবনে চলতে গেলে প্রত্যেকেই তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সংস্কার মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওরা দিনকে দিন কেমন যেন উদ্ভট প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের জন্মদিনে নিমন্ত্রণে দুর্গা দেবী তানজিলাদের বাসায় যায়। অনুষ্ঠান শেষে তিনি বিদায় নিতে গিয়ে বলেন- আসি তানজিলা, ভালো থেকেো।আচ্ছা আন্টি আল্লাহ হাফেজ।প্রত্যুত্তরে দুর্গা দেবী হাসতে হাসতে হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছিলেন।আন্টি ‘আল্লাহ হাফেজ\' বলেন।– বলেই তানজিলা দুর্গা দেবীর দিকে তাকিয়ে থাকে।কোন কথা না বলে দুর্গা দেবী চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে।তানজিলা আবারও বলে- আন্টি ‘আল্লাহ হাফেজ\' বলেন সোয়াব হবে। খুব রাগ হচ্ছিল দুর্গা দেবীর কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলেন- ‘আল্লাহ হাফেজ\' আমার কাছে একটা শব্দ মাত্র। তোমার কাছে কেমন গুরুত্বপূর্ণ আর আমার কাছে কেমন সেটা তুমি ভালো করেই জানো। কেন শুধু শুধু কিছু পবিত্র শব্দকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাও। পবিত্রতা রক্ষা করে নিজ ধর্ম যথার্থভাবে পালন করো আরও বেশি সোয়ব হবে। কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনও কিছু করতে যেও না। তোমার মতো মেয়ের কাছে এমনটা কখনও প্রত্যাশা করিনি। তবুও ভালো থেকো।তানজিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আর কোন কথা বলার সাহস পায়নি।কথায় কথায় একদিন রেহানা পারভীন বললেন- আচ্ছা আন্টি, আমাদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?এমন প্রশ্নে দুর্গা দেবী কোনরকম অবাক না হয়ে বললন- দেখো রেহানা, ধর্ম নিয়ে সাধারণতঃ আমি কখনও আলোচনা করি না। তবে তুমি যেহেতু জানতে চেয়েছ তবে বলি- কোন ধর্মই কখনও কোন মন্দ কথা বলে না এবং মন্দ শিক্ষাও দেয় না।পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষের কল্যাণের জন্য। তবে কিছু কিছু মন্দ লোক ধর্মকে খারাপভাবে ব্যবহার করে। আর আমি যখন শিক্ষকতা করতাম, ইসলাম ধর্মও পড়িয়েছি। এই বলেই তারপর গড়গড় করে কয়েকটা সুরা মুখস্থ বলে ফেললেন।রেহানা পারভীন তো অবাক এবং বেশ উৎফুল্ল হয়েই বলল- আন্টি এই যে সুরা পাঠ করলেন, আপনার অনেক সোয়াব হবে।প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে দুর্গা দেবী রেহানা পারভীনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবেন- সত্যিই তোমাদের জন্য করুণা হয়! কিন্তু বলেন- এটা আমার কাছে স্রেফ শিক্ষা আর এটা আমার ধর্ম নয়। তুমি পাঠ করলে তোমার সোয়ার হবে।আন্টি, আপনি কি ইউটিউব দেখেন?হ্যাঁ দেখি, কেন?জাকির নায়েকের বক্তৃতা শুনবেন, ভালো লাগবে।দুর্গা দেবী কোন কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন।আন্টি, ইউটিউবে ওয়াজ শুনবেন খুব ভালো লাগবে।খুব শান্তভাবেই দুর্গা দেবী বললেন- কোরান আর হাদিস নিজে বুঝে বুঝে পড়বে তোমার অনেক বেশি সোয়াব হবে।আপনি পড়েছেন?শোন রেহানা, জ্ঞানকে কখনও সীমাবদ্ধ করে রেখো না। বলার চেয়ে শুনবে বেশি আবার শোনার চেয়ে পড়ে পড়ে জ্ঞান আহরণ করবে। আর জাকির নায়েককে তুমি কত বৎসর জানো?এইতো বৎসর-দুই।আমি উনাকে অনেক আগে থেকেই জানি।রেহানা পারভীন থ হয়ে দুর্গা দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বোরকার কাপড়টা ঠিক করতে করতে বলে- আন্টি মনে কিছু করবেন না, আমি এমনি এমনি জানতে চেয়েছি।দুর্গা দেবী বিদায় নিয়ে ছাদ থেকে চলে যাবার পর তানজিলা, ফাতিমা, রেহানা এবং আরও কয়েকজন মিলে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলল, বেশিরভাগই ধর্মীয় আলোচনা আর বিধর্মীদের নিয়ে চর্চা বিশেষ করে দুর্গা দেবী।*ক\'দিন ধরে দুর্গা দেবীর মনটা দুঃখে আর কষ্টে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মানুষ সকল কষ্ট অন্যের কাছে ভাগাভাগি করতে পারে বা জবাবে বলতে পারে কিন্তু অবহেলার বেলায় তা সত্যিই অন্য রকম কষ্ট লাগে। ফাতিমা বা তানজিলা উনার কেউ নয় শুধু প্রতিবেশি। তবে ফাতিমার সাথে উনার অন্যরকম একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। সে তার নিজের মেয়ে নয় কিন্তু মানহার কারণে কেমন যেন একটা মায়ার জালে আটকে গেছেন। ফাতিমাও বেশ আন্তরিকতার সাথে মিশেছে এতদিন। যখনই তানজিলা আর রেহানাদের সাথে পরিচিত হয়েছে তখন থেকেই ওরও দ্বৈত-চরিত্র ক্রমশঃ প্রস্ফুটিত হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। যখনই দুর্গা দেবীর সাথে ফাতিমা বা তানজিলা বা রেহানার একা একা দেখা হয় তখন বেশ আন্তরিক হয়েই কথা বলে- যেন কত আপন। আবার যখন একসঙ্গে দেখা হয় তখন যেন সকলেই দুর্গা দেবীকে এড়িয়ে চলে। সবাই আচরণে প্রকাশ করতে ব্যস্ত থাকে যে, তার সাথে দুর্গা দেবীর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। অথচ যখন একা একা দেখা হয় তখন ব্যবহার থাকে ঠিক উল্টো। ইদানিং ফাতিমাও তাদের সাথে পুরোপুরি যুক্ত হয়েছে। পরিচয় হবার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় মেয়েকে নিয়ে দুর্গা দেবীর বাসায় চলে আসতো। এবং কোন কোনদিন দু\'তিন ঘন্টা সময় কাটাতো। বিশেষ করে মেয়ে মানহা থাকতো প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে। দুর্গা দেবী ওর জন্য অনেক খেলনা আনিয়ে রেখেছেন যা যা সে পছন্দ করে। আর এসেই সব খেলনা নিয়ে বিছানার উপরই পসরা সাজিয়ে বসে এবং যে ঘরে টিভি সেই ঘরে। তারপর চলে আবার ম্যারাথন খেলা। মানহার আনন্দ আর খুশীতে ঘরটা ঝলমল করে থাকে সর্বক্ষণ। ফাতিমাও বেশ উৎফুল্ল ছিল তার মেয়ের এমন প্রাণচাঞ্চল্যে। কিন্তু তানজিলাদের সাথে পরিচয় হবার পর থেকেই আর কখনও আসেনি। দুর্গা দেবী সবই বুঝেন। এখন যদি ফাতিমা উনার বাসায় আসে তাহলে তানজিলা দেখে ফেলতে পারে। তারপর সবাই জেনে যাবে যে, ফাতিমা বিধর্মীদের বাসায় আসা-যাওয়া করে।ফাতিমা এখন ইন্টারকমে কথা বলে- আন্টি, আমার মেয়ে আপনাকে দেখতে চায়। অথবা বলে যে, মানহা আপনার জন্যে কান্না করছে অথবা অন্য কিছু বলে।দুর্গা দেবীও অভিমান আর কষ্টের চূড়ান্ত পর্যায় থেকে বলে- মানহাকে বলো যে, ওর নানু ভাই সংসারের কাজে ভীষণ ব্যস্ত, অথবা বলেন সারাদিন পরিশ্রম শেষে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি অথবা অন্য কিছু বলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানহাকে একপলক দেখার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে আছে। এ কয়েক মাসেই কেমন যেন একটা আত্মার সম্পর্ক হয়ে গেছে, অথচ! দুর্গা দেবী আর ভাবতে চান না, শুধু মনে মনে উচ্চারণ করেন- সবাই ভালো থেকো! ভীষণ অভিমান বুকে চেপে দুর্গা দেবী চুপচাপ থাকেন। এখন ছাদেও রীতিমত যান না আর তেমন একটা দেখাও হয় না। আর যেদিন দেখা হয় সেদিন মানহা দুর্গা দেবীর সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকে। বেলা শেষে বিদায় বেলায় মানহা দুর্গা দেবীর হাত ধরে টানতে থাকে- নানু ভাই আমাদের বাসায় চলো!আশেপাশে কেউ না থাকলে ফাতিমাও মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলে- আসুন আন্টি!আর যদি তানজিলা বা রেহানা বা অন্য কেউ থাকে তাহলে ফাতিমা এসব না শোনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে অথবা ওদের সাথে অনর্থক বেশি ব্যস্ত থাকে। ওরা সবাই একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে চলে অথবা একটা অদৃশ্য দেয়ালের কারণে মেপে মেপে চলে, এবং বলে। দুর্গা দেবী সবই বুঝেন এবং টের পান। কিন্তু খুব সতর্কভাবেই এই দেয়ালটাকে এড়িয়ে চলেন বা দেখেও না দেখার ভান করেন। মানহাকে ভালোবাসেন এটাই উনার কাছে মুখ্য আর বাকীসব গৌণ।*দুর্গা দেবীর মনটা আজ ভীষণ ভারাক্রান্ত। দুঃখের ভারে দেহমন যেন ক্রমশঃ নতজানু হয়ে আসছে। কোন কাজেই মন বসাতে পারছেন না একদিকে ফাতিমা, তানজিলা আর রেহানাদের মতো শিক্ষিত লোকদের বিষাক্ত-মিষ্ট অবহেলা। আর অন্যদিকে এইসব জ্ঞানপাপীদের জন্যে ভালোবাসার গণ্ডীতে নিষ্পাপ মানহার ভীষণরকম অনুপস্থিতি। মানহার ভালোলাগা, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস সবকিছুই যেন দুর্গা দেবীকে সুখের দরিয়ায় প্লাবিত করে। অথচ অদৃশ্য দেয়ালের কূটচালে সবই যেন ধোঁয়াশা আর অচেনা কষ্টে নিমজ্জিত। আরও কষ্ট হচ্ছে উনারা আগামীকাল এই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। নানান চিন্তায় দুর্গা দেবীর মনটা সত্যিই ক্লান্ত।বিকেলে ছাদে গিয়েছিলেন তিনি কিন্তু মানহারা আসেনি, দেখাও হয়নি। ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে এলেন।রাত নয়টা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। অবুঝ মনটাকে টেনে নিয়ে চললেন দুর্গা দেবী। ভারাক্রান্ত মনটাকে টানতে টানতে পা বাড়ালেন। ঘরের বাইরে পা ফেলে তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে চললেন।কলিং বেল বেজে ওঠতেই ফাতিমা দরজা খুলে ভীষণ অবাক- আরে আন্টি আপনি! আসুন, আসুন ভেতরে আসুন।দুর্গা দেবী ঘরের ভেতর পা রেখেই আনমনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর মানহাকে খুঁজছেন। কোথাও দেখতে না পেয়ে বললেন- মানহাকে দেখছি না যে?মানহা ঘুমিয়ে পড়েছে আন্টি!- বেশ স্বাভবিকভাবেই বলে ফাতিমা। কিন্তু ঘটনার পেছনের দৃশ্যপট পুরোপুরি ভিন্ন; ক\'টা দিন ধরেই মানহার আবদার- আম্মু চলো নানু ভাইদের বাসায় যাই!মানহা আর ফাতিমা দু\'জনই নাছোড়বান্দা, একজন যেতে চাচ্ছে আর অন্যজন যাবে না। আজ সারাটা বিকেল কাঁদতে কাঁদতে মানহা একেবারে ক্লান্ত; কিছুই খায়নি সারাদিন। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত দেহে ঘুমের রাজ্যে লুটিয়ে পড়ে।সোফায় বসেই দুর্গা দেবী উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন মানহাকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু কাউকে ঘুম থেকে জাগানো উনি কখনও পছন্দ করেন না এবং ডাকেনও না, তাই বসে আছেন। ফাতিমা একটা বড় ট্রেতে করে ফল, বিস্কুট আর নিয়ে এলো।দুর্গা দেবী নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মনের ভেতরটা উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে- মুহূর্তে মুহূর্তে কঠিনসব পাথরের গড়াগড়ি টের পাচ্ছেন হৃদয়ের অন্তঃপুরে।দু\'জন টুকটাক কথা বলছে। কিন্তু কথাবার্তায় তেমন প্রাণ জাগছে না। দু\'জনই তা\' টের পাচ্ছে। তারপরও অনর্থক কিছু কথা বলছেন দুর্গা দেবী শুধু মানহাকে শেষমেস একপলক দেখার জন্য। কিন্তু ফাতিমার ভেতর তেমন কোন ভাবান্তর দেখছেন না। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছেন যেন মানহার দেখা পান। কোন কিছুই খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তবুও ইচ্ছের বিরুদ্ধে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিলেন। আর প্রাণখোলা কথা বলার চেষ্টা করছেন। ইচ্ছে করেই বেশ শব্দ করে কথা বলছেন।ঈশ্বর থাকুক বা না-থাকুক বিশ্বাসে সবই মিলে, হৃদয়ের আর অন্তঃপুরের ডাক ঠিকই তিনি শুনতে পান- কথাগুলো দুর্গা দেবীর মনের ভেতর বাজছে। ঐতো মানহা দাঁড়ানো! চোখ-জোড়া ফোলা-ফোলা, দেহ পুরোপুরি ক্লান্ত কিন্তু টলমল চোখে দুর্গা দেবীকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই দুর্গা দেবী উঠে দাঁড়িয়ে দু\'হাত বাড়িয়ে বলেন- আমার নানু ভাই, কেমন আছো?মানহা এক দৌঁড়ে এসে উনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।জড়িয়ে ধরেই দুর্গা দেবী ডুঁকড়ে কাঁদতে লাগলেন- আমার নানু ভাই! কেমন আছো তুমি?মানহা দুর্গা দেবীর কোলে মাথা ডুবিয়ে ভালোবাসার কোলে যেন ডুব দিয়ে আছে। সেই একইরকম ভালোবাসা, সেই ফেলে আসা অনুভব আর শীতলতা। সব ডিঙিয়ে মানহা বলে- নানু ভাই, তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ?চোখের জল মুছতে মুছতে দুর্গা দেবী বলেন- না নানু ভাই, কোনদিন ভুলিনি। শুধু সময়ের আড়ালে আর অদৃশ্য দেয়ালে চাপা পড়েছিল।শেষ১০.০২.২০২৩রায়ের বাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ।
0 Comments