
\'জুলাই শিক্ষার্থী- গণঅভ্যুত্থান\' নিয়ে প্রবন্ধ
আমাদের নতুন স্বাধীনতা।(এস, এম, ইমরানুল ইসলাম রাজন)দীর্ঘ দেড় দশকের অপশাসন থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পেয়েছে গত ৫ আগষ্ট, ২০২৪। একে বিপ্লব, গনঅভূত্থান, শিক্ষার্থী জনতার অভূত্থান, ফ্যাসিস্ট বিদায় ইত্যাদি অনেক নামে সজ্ঞায়িত করছে। সবারটাই হয়ত ঠিক। তবে হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের এত আকষ্মিক সমাপ্তি, এত কলঙ্কজনক ও ভয়াবহ লজ্জাজনক পরিনতি হয়ত কেউই বুঝতে পারেনি। এখানেই প্রকৃতির শ্রেষ্টত্ব, তার ক্ষমতা আর আমাদের সীমাবদ্ধতা।গত এক দেড় দশক ধরেই আওয়ামী শাসকদল নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস, গুম, খুন, হত্যা, পেশীশক্তি, অস্ত্রের মহড়া ও তার ব্যাবহার, নিপীড়ন, ভিন্নমতের মানুষের সাথে সর্বোচ্চ খারাপ ব্যবহার করে, প্রসাশন ও পুরো দেশের কাঠামোটাকে দলীয়করন ও একটা মাফিয়াতন্ত্র গড়ে তোলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিরোধী রাজনৈতিক মত, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ নানান ধর্ম-বর্ন-শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে নানান অমানবিকতা, আয়না ঘর নামক টর্চার সেল গঠন করা ইত্যাদি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিরোধীদলের বড় বড় সব সমাবেশ দল ও প্রশাসন দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে দেড় দশক ধরে। অর্থ, ক্ষমতা, যশ তাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। চার দেয়ালের বাইরে কি ঘটে যাচেছ তারা ছিল বেখবর।কয়েক বছর আগে সরকারী চাকরীতে কোটার পরিমান নিয়ে দেশব্যপী আন্দোলন হলে সরকার চাকরীতে সকল কোটা বাতিল করে দেয়। তারপর অনেক চড়াই উতরায় পার করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা আপিল করে কোটার পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে সরকার আদালত শিক্ষার্থী দেশের মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। জুন ২৪ থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। সরকার ও আদালত আবার টালবাহানা শুরু করে। যারফলে দেশের মানুষের মধ্যে কোটা নিয়ে ব্যপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আমি নিজে সরকারী চাকরী করলেও প্রথম থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম যে কি দিয়ে কি হচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য বহু স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের উপর বর্বরোচিত আক্রমন আামাকে চুরান্তভাবে মাঠে নামিয়ে দেয়। বিবেক আর মানবিকতার দংশন আমাকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। অর্ধেক বেলা অফিস করে শিক্ষার্থিদের আক্রমনের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার বিভিন্ন চেষ্টা করছিলাম। কখনও সামাজিক মাধ্যমে ছড়া বা প্রবন্ধ লিখে আবার কখনও নিজে আন্দোলনকারী শিক্ষার্র্থীদের সাথে যতটা সম্ভব সময় দিয়েছি, ওদের পানি খাবার দিয়ে চিকিৎসায় সহযোগীতা করে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এ এক অবাক করা ঘটনা আমাদের জীবনে। ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে নিরস্ত্র ও লালাভোলা আমজনতা বা দলীয় কর্মী আর বিপক্ষ দলে সরকারের সকল ক্ষমতা, অস্ত্র, গুলি, গ্রেনেড, টিআর সেল, গরম পানি, হেলমেট বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, রণসামগ্রী ইত্যাদি। তবুও মানবিকতা আর সত্যের কাছে পরাজিত হয়েছে সকল অপশক্তি। জুলাই ২৪ এর প্রথম সপ্তাহে মাত্র গুটিকয়েক শিক্ষার্থী রাষ্ট্রপতি বরাবর স্বারকলিপি প্রদানের মতো শান্তিপূর্ন কর্মসূচীতে সরকার বাধা দেয়। যারফলে দেশব্যপী তাদের ছোট ছোট আন্দোলনেও বাধা আসতে শুরু করে। তারপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রাী ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা বাদে অন্যদের রাজাকার সম্মোধন করে, হেয় করে বক্তব্য প্রদানের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও জোরালো হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী সাধারন সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবাইদুল কাদের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেন প্রকাশ্যে। সাথে যোগ দেয় সকল আওয়ামী মতাদর্শের হায়েনার দল। বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েদের গায়ে হাত তোলা হয়, তাদের বেইজ্জতি করা হয়, তাদের রক্তাক্ত করা হয়। সাথে যোগ দেয় আওয়ামি পুলিশ নামের আরেক পিচাশবাহিনী। ১৬ জুলাই ২৪ রংপুরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাইদকে নিরস্ত্র অবস্থায় খুব কাছ থেকে গুলি করে পুলিশ হত্যা করে। এই হত্যাকান্ড সারা বিশে^র বিবেক নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আওয়ামী শকুনরা যেন আরও শক্তি পায়। খুনী প্রশাসনের সাথে তারাও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। নিজ দেশের নিঃপাপ কোমলমতি সন্তানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেমে তারা কি প্রমান করলো নিজেকে? সেই দিন থেকে আমি সরাসরি মাঠে নেমে যায়। আমাকে আর কোন শক্তি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। যেভাবে পেরেছি গোপনে প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের সহযোগীতা করেছি। জনমত গড়ে তোলার জন্য সরকারী অফিসে অফিসে কাউন্সিলিং করেছি। মানুষকে সত্য মিথ্যা আর অমানবিকতার প্রমান বলেছি। দলীয় কোন লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্য আমার কোন সময়ই ছিল না। তার বড় প্রমান ওয়ার্ডের সভাপতি থেকে শুরু করে, এমপি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষগুলোর সাথে অতি সখ্যতার সুযোগ থাকলেও আমি তার ধারের কাছে যায়নি। কারন দলীয় মতাদর্শ ও তাদের অতীত প্রমান অনুযায়ী আওয়ামীলীগ কখনও মানুষের জন্য কিছু করেনি। মানুষকে তারা পুঁজি করেছে। মানুষের চিন্তাকে ওরা ব্যাবহার করেছে মিথ্যা ইতিহাস বুঝিয়ে। ১৮ জুলাই ২৪ মহরমের রোজা রেখেই রাজপথে আমি ছিলাম। আমার অবস্থান ছিল শাহবাগ-কাটাবন-বাটা সিগন্যাল-সাইন্সল্যাব মোড়। কি যে ভয়াবহ দিন পার হয়েছে। চারদিক থেকে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিআর সেল , ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া জান একদম যায়যায়। কেউ পানি নিয়ে গেছে, কেউ সিঙ্গারা নিয়ে গেছে, কোন মা সামান্য লটকন ও কলা নিয়ে সংহতি জানিয়েছে, কেউ শরবত নিয়ে গেছে, আবাল বৃদ্ধ বণীতা সকলে যে যা দিয়ে পারছে তাই দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছদ্ববেশে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। কিছু মা রাস্তার পাশে বসে বসে কাদছে আর আল্লাহকে ডাকছে। তাদের ছেলে মেয়েরা আন্দোলনে রয়েছে। মহররমের রোজা রেখে সারাদনি একটুও ক্লান্তি টের পাওয়া যায়নি। সন্ধার সময় একটু পানি খেয়ে রোজা ভেঙ্গে ধানমন্ডির দিকে রওনা দিলাম। ধানমন্ডির অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। কোন রাস্তা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের অভিভাবকরাও রাস্তায় নেমে এসেছে। সাত মসজিদ রোডে থেকে থেকে গুলি হচ্ছে, টিআর সেল আর সাউন্ড গ্রেনেড পড়ছে বৃষ্টির মত। এক ঘন্টা চেষ্টা করে রাস্তা পার হয়ে শংকর হয়ে মো.পুর যাব মনে করছিলাম। কারন ধানমন্ডি ২৭ থেকে মো.পুর বসিলা মোড় পর্যন্ত ভয়াবহ গুলি আর গ্রেনেড হামলা হচ্ছে। মকবুল কলেজের কাদেররাবাদ কাটাসুর একদম রনক্ষেত্র। মো.পুর বাসস্টান্ড থেকে বসিলা রাস্তা একদম পুলিশের দখলে। বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, টিআর সেলে চোখ মুখ নাক একদম অকার্যকর হয়ে গেছে একদম। দশ পনের ফুট দূরে রাইফেল তাক করে আছে কিন্তু ওরাও হয়ত আমাকে দেখকে পরছিল না। আমি একদম কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে পড়েছিলাম। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কয়েকজন কম বয়সী ছেলে এসে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ওরা বলল ভাই এখানে থাকলে গুলি কইরা দিবো তো। এইদিকটাই আহেন লগে লগে। আমিও গেলাম। দেখলাম গুলি খেয়ে কতরাচ্ছে কয়েকজন। ওদের হাসপতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করলাম। আবার গুলাগুলিতে দিক পরিবর্তন করলাম। রাত ১ টা পর্যন্ত এভাবে চলার পর গুরি আর টিআর সেলের মধ্যে দিয়েই রাস্তা পার হলাম। সাত মসজিদের মোড়ে, বাসবাড়ি মোড়ে, শিয়া মসজিদের মোড়ে, জাপান গার্ডেনের মোড়ে ব্যপাক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হলো। গুলি, ঢিল, ইট, টিআর সেল, সাউন্ড গ্রেনেড ইত্যাদিতে চারদিকে এক যুদ্ধাবস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। প্রান নিয়ে কোন রকমে রাত দুইটায় বাড়িতে আসলাম। বেলা একটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত এক ভয়াবহ যাত্রা যেন সামান্য থামলো। রোজা রেখে না খেয়ে এত ধকল যেন কিছুই মনে হচ্ছে না। কত রক্ত, প্রান, আহাজারি, আকুতি, চিতকার শব্দ, ভয়, আতংক এ যেন এক মৃত্যুপূরীর কোন ভিডিও গেমস। এ যেন এক যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি।১৯ জুলাই, ২০২৪, শুক্রবার। আজ ইয়তাশাকে নিয়ে আন্দোলনের মাঠে গেলাম। আমাদের অবস্থান সিয়া মসজিদ আর জাপান গার্ডেনের মাঝে। থেকে থেকে গুলি আর টিআর সেল পড়ছে, সাউন্ড গ্রেনেড পড়ছে। জানটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। হেলিকপ্টার থেকে ফুলের টবের মতো কি যেন ফেলা হলো সিয়া মসজিদের মোড়ে। মুহুর্তের মধ্যেই সব অন্ধকার হয়ে যেতে লাগল। আট বছরের লিকলিকে সাহসী মেয়েকে নিয়ে পুলিশসমেত প্রানপনে দৌড়াতে লাগলাম। শেখের টেক ৪ এর মুখ আর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের উল্টোপাশের গলিতে অবস্থান নিলাম। তারাপর বিডিআর আর পুলিশের টহল বৃদ্ধি পেল। ওরা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড মারতে লাগলো। আধাঘন্টা এভাবে যাওয়ার পর অবশেষে আমরা বাড়ির রাস্তায় শেখেরটেক ০৩ এ পৌছলাম।আমার ছোট মেয়ে ০৩ বছরের মালালাও সারাদিন মিছিল করছে। সৈরাচার বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। ” আমার ভায়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না”, ”খুনি হাসিনা বিদায় হ”, পানি লাগবে পানি?, ওরা ফাইয়াজ কে চেনে, মুগ্ধ কে চেনে, আবু সাইদকে চেনে। তাদের সাহসিকতার কথা শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত দেখেছে। স্বাক্ষী হয়েছে ইতিহাসের। ২০ থেকে ৩০ জুলই পর্যন্ত দেশের প্রায় সবকিছু বন্ধ করে দেশব্যপী পাখির মতো গুলি করে শিশু, শিক্ষার্থী, সাধারন মানুষকে তাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়। বাসাবাড়িতে শিশু সন্তানও হত্যার শিকার হয়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে মানুষ মারা হয়। নিজ বাড়ির নিচে দাড়িয়ে থেকে, কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফেরার সময়, হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফেরার পথে, বাজার নিয়ে বাসায় ফেরার সময়, জীবন বাচানোর জন্য লুকানো মানুষকেও ওরা গুলি করতে ছাড়েনি, হত্যা করতে ছাড়েনি। গুলি করে নিসংসভাবে গাড়ি থেকে ফেলে টেনে হিচড়ে নেয়া হয়। হাজার হাজার বুলেট, টিআর সেলের ঝাঁঝাঁলো বাতাশে পুরো জুল্ইা মাস ছিল অসহনীয়। তারপর হাজারো মানুষের রক্তের রঙে, গন্ধে গুমোট একটা দম বন্ধ করা আতংকের সময়। অফিসে, পাড়ায় মহল্লায় আতংকে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এই সময়টাতে ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্ট হিসাবে সেনাবাহিনীকে ও নামানো হয়। বিচ্ছিন্নভাবে সেনাবাহিনীও গুলি চালিয়ে হতাহত করে (তারিখ ১৯ বা ২০ জুলাই হবে হয়ত, স্থান: মো.পুর, ঢাকা- আমি নিজে প্রত্যোক্ষদর্শী), বিডিআর তাদের শক্তি প্রদর্শনের ভয় দেখায়। এত হত্যাযজ্ঞের পরও তাদের দলীয় লোকদের দ্বারা বিআরটিএ ভবন, মেট্রোরেল ও বিটিভি ভবনে আগুন দেয়ার পর সরকারের উচ্চ মহলকে সাথে নিয়ে হাসিনার মায়াকান্না দেশের মানুষের মনে চরম ক্ষোভের জন্ম নেয়। হাজারো শহিদের রক্ত মাড়িয়ে দেশজুড়ে হতাহত সাধারন মানুষদের পাশে না দাড়িয়ে ঐসকল স্থাপনা পরিদর্শন করে মিথ্যা কান্নার অভিনয় কোটি মানুষের হৃদয় থেকে হাসিনা একদম দূর হয়ে যায়।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের একদফায় এসে ঠেকে। আওয়ামী লীগ বনাম বাংলাদেশ মুখোমুখি দাড়িয়ে যায়। দফায় দফায় গন ভবনে বৈঠক হতে থাকে। ফ্যাসিস্টের পাচাটা কুকুরগুলো তখন ও সাইকোপ্যাথ হাসিনাকে বুঝিয়ে যাচ্ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে, সবকিছু তাদের আওতায় রয়েছে এবং কিছু সময় পার হলেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অবশেষে কঠোর কারফিউ দিয়ে অস্ত্রের শক্তি দিয়ে গন আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। একদিকে অবৈধ ক্ষমতা আরেক দিকে সমগ্র দেশ। নানান চড়াই উতরাই পার করে, নানান সভা- বৈঠক করেও কোন সমাধান না পেয়ে অবশেষে আগস্ট ০৩, ২০২৪ এ এসে সেনাবাহিনী জনগনের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে দাড়াতে অপারগতা জানায়। বিশেষকরে মধ্যম সারির অফিসারেরা সরকারের এই হটকারিতাকে মানতে নারাজ হয় এবং প্রয়োজনে তারা বিদ্রোহ করে জনগনের পাশে দাড়াবে বলে অসমর্থিত বিভিন্ন খবর চাওড় হতে থাকে। এমন ঘোষনার ফলে কার্যত হাসিনর সকল ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। শুধু গুটিকয়েক এসএসএফের বহর নিয়ে কোটি মানুষের ঢল ঠেকানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আগষ্ট ০৬, ২০২৪ তারিখে ঢাকা অবরোধ করে গনভবনসহ সরকারের নানান স্থাপনা ঘেরাও করার কথা থাকলেও কারফিউ ও নানান বাধার কারনে শিক্ষর্থী- জনতাসহ দেশের সকল স্থরের মানুষ ০৪ আগস্ট ২০২৪ মধ্যরাত থেকেই ঢাকাসহ সমস্ত দেশব্যাপী আওয়ামী সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে।গনভবন ঘেরাও এর উদ্দেশ্যে লক্ষ কোটি জনতার ঢল আসতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে পুলিশ ও আওয়ামী সরকারী বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় সাধারন মানুষের উপর। নির্বিচারে তারা নিরস্ত্র সাধারন জনতার উপর নিসংশ হত্যাযজ্ঞ চালায়। নিজেরা ও হতাহতের শিকার হয় কয়েক স্থানে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করে পুলিশ তাদের পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরতা চালায় পরাজিত হয়ে। অগনিত মানুষকে গনকবর দেয়া হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশের সকল স্থরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জীবনের মায়া ছেড়ে তারা পুলিশ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অফিস ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের প্রতিহত করে। প্রানভয়ে সরকারী দলের লোকজনসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জনগনের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়। দীর্ঘদিনের বৈষম্য, অত্যাচার, নির্যাতন, হতাহত ইত্যাদি জমে থাকা অস্বস্থি, ক্ষোভ, কষ্ট ইত্যাদি একেবারে বিষ্ফোরন ঘটে। এর মাঝে খবর আসে সাইকোপ্যাথ রক্তচোষা ফ্যাসিষ্ট হাসিনা ভারতে পলায়ন করেছে। সাথে আছে বোন শেখ রেহানা। এই খবরে সবাই স্বস্থি প্রকাশ করে। আনান্দে আল্লাহর দরবারে কেঁদে ওঠে কোটি মানুষ। আনান্দে রাস্তায় নেমে আসে কোটি কোটি আম-জনতা। রাস্তা জুড়ে লোকে লোকারন্য। সকলের গায়ে গায়ে ঘেষে চলছে সবাই। কারও কো অভিযোগ নেই। কেউ ই বিরক্ত হচ্ছে না। অসুস্থ রোগী হাসাপাতাল থেকে রাজপথে নেমে এসেছে। অনেকে হাউমাউ করে কাদছে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। কেউ কেউ চকলেট, মিস্টি, খাবার বিতরন করছে আনান্দে। এ এক অভাবনীয় চিত্র। যা শুধু দেখে বোঝা যায়, বর্ননা করা যায় না। গনভবন ও সরকারী বিভিন্ন স্থাপনা প্রথমেই ফ্যাসিস্ট দোসরেরা লুটপাট করে। তারপর আমজনতা বাকিটা শেষ করে। পাপে পরিপূর্ণ প্রাসাদ মুহুর্তে আমজনতার রোষানলে ধ্বংসযজ্ঞে পরিনত হয়। দেশের সমস্ত আওয়ামি স্থাপনা, শেখ মুজিবের মুর্যাল ক্ষুব্ধ মানুষ ভেঙ্গে চুরমার করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। পাপের আখড়া থানা ও দলীয় পাচাটা কুকুরদের বাড়িঘর ভাংচুর করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। অবশেষে দেশের বুকে চেপে থাকা অত্যাচারের অবসান ঘটে। শেষ হয় ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট অপশাসনের। দীর্ঘদিনের মানুষের ক্ষোভ এর বহিপ্রকাশ করে মানুষ। গনভবন, শেখ মুজিবের বাড়ি, আওয়ামিলিগের যত অফিস, নামফলক, মুর্তি মুর্যাল ছবি ব্যানার ফেস্টুন ঘৃনাভরে মানুষ ধ্বংস করে তছনছ করে ফেলে তাদের মনের খায়েস মেটায়। আওয়ামী সম্পর্কিত সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে মজলুম জনতা। যদিও মুল্যবান সামগ্রী আগেই সরিয়ে ফেলে অবস্থান করা সরকারী ও দলের কিছু মানুষ। অন্তিম বিদায়ের আগে কয়েক ঘন্টা যাবত হাসিনার সাথে দেন দরবার চলে। শেখ রেহানা ও জয়ের সাথে দেন দরবার চলে। অবশেষে দেশের বা হাসিনার আশপাশের সকলে পিছটান মারে দেশব্যাপী বাধার মুখে হাসিনার আর রেহানার প্রান বাঁচানোর একমাত্র উপায় হিসাবে ওরা শেষমেষ ভারতে পলায়ন করে। পাপের বোঝায় ওরা পরিপুর্ন হয়ে লজ্জাজনকভাবেই তাদের বিদায় ঘটে। তারা এই দেশের মানুষকে ভয় পায়। কারন ওরা এদেশের মানুষের জন্য কিছু করেনি, এদেশের মানুষকে ভালোবাসেনি। সবই করেছে তার পরিবারের জন্য। তার নিজের ক্ষোভ ও খায়েশ মেটানোর জন্য। দেশের সমস্ত মানুষকে তারা প্রজা মনে করে শাসন করতে চেয়েছে। হাসিনার রাজনীতিতে প্রবেশের একমাত্র উদ্দেশ্য সফল করে সে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে পালালো। এটাই তাকে ইতিহাসে চুরান্তভাবে কলঙ্কিত করল। নিয়তিই তাকে তার পাপের সাজা দিয়ে দিল।কতটা লোভী ও আত্বকেন্দ্রীক ফ্যাসিস্ট হাসিনা? তার এই হটকারিতায় আজ আওয়ামি লীগের কি হবে? এত দলীয় লোকদের কি হবে? এত দিন ক্ষমতায় থাকলেও তার অবর্তমানে দলের হাল কে ধরবে, এই চিন্তা সে কখনও করেনি। যেমনটা করেনি তার বাবা শেখ মুজিব। সে ও চায়নি তার অবর্তমানে আমার স্থানে অন্য কেউ থাকুক। এটা রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর। যার প্রমান দুইজনই পেয়েছে। কিন্তু তাদের এই পাপের সাজা ভোগ করবে তাদের অনুসারীরা। তারা না পারবে অন্যদলে যেতে, না অন্য দল তাদের দলে নিবে। সকলের সংগতিও নাই যে বিদেশ পাড়ি দেবে। তারা জানে না তারা কি করবে? এ এক অভিশপ্ত দল। হাসিনা তার পরিবারের লাভ আর নিজের জীদ লালসা পূরনে পুরো জাতিটাকে ব্যবহার করেছে। স্যাইকোপ্যাথ আর গুয়ার্তুমির কারনে সারা বিশে^র সাথে আমাদের কোন সুসম্পর্ক নেই। কূটনৈতিকভাবে আমরা সবচেয়ে নীচের সারির দেশ। বিশে^ আমাদের দেশের সকল মাত্রা নিচের দিকে। একমাত্র কারন এই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার লোভী দোসররা।বিবেক বিসর্জন দিয়ে এই আন্দোলনটাকে দমাতে গিয়ে যারা দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো তাদের জন্য দয়া। তারা নির্লজ্জ ও বেহায়া বলেই আবার ফ্যাসিস্টের বন্দনা করে। কারন তারা আর যাই হোক মানুষের কাতারে পড়বে না। কারন মানবিকতাহীন দলকানা মানুষের চাইতে পশু পাখি ও ভালো। ওরা কি এখনও মনে করেনা যে হাসিনা ওদের ব্যাবহার করেছে। ওদের কে কিছু মুখস্ত বয়ান শিখিয়ে সেই চেতনা পুঁজি করে এই দল ব্যবসা করেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে হুকুম দিয়ে ভায়ে ভায়ে, বন্ধুতে বন্ধুতে, ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এই পাপের দল। দেশে সকল অরাজকতা ও বিভেদের জন্য ওরা ও ওদের গুরু ভারত দায়ী। আর ভুক্তভোগী আমরা বাংলাদেশী মানুষেরা।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর দেশ যখন ভয়াবহ এক সঙ্কায় আচ্ছন্ন। ঠিক তখনই তারা সদলবলে ভারতে পলায়ন করে সমগ্র জাতিকে এক অগ্নিগর্ভে ফেলে দিয়ে। কোটি কোটি মানুষ, সকল ভরসার স্থান দেশের কি হবে, এগুলো কিছুই তারা ভাবেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার বিনা ম্যান্ডেটে তারাই তাদের ইচ্ছামতো বিস্তর, দূবোধ্য, গোজামিলে, একপেশে, ছদ্মবেশী এক সংবিধান রচনা করলো। এতেও পেট ভরলো না। সকল মানুষের আশা জলাজ¦লি দিয়ে তারা এক নায়ক তন্ত্র বাকশালের প্রবক্তা তো তারাই। এই জন্য মানুষ তাদের ক্ষমাতা দেয়নি বা তাদের কথায় চলেনি। ঠিক ২০২৪ এ এসেও তারা পলায়ন করলো দেশ ও তাদের কোটি দলীয় অনুসারীদের ফেলে। ১৯৭১ সালে না হয় দেশ স্বাধিনতার ফল ভোগ করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এর আগষ্ট পর্যন্ত তাদের অপশাসনের ফল হিসাবে জাতি চরম এক নির্মমতা দেখেছিল। তখনও শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে ছিল। এইবারও কাকতালীয়ভাবে সেই দুই বোন একসাথে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে একসাথে অবস্থান করছে। এই দেশ তাদের আর সহসাই গ্রহন করবে না। কারন এদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর পেতাপ্তারা পূনর্জন্ম হওয়া মানে ভবিষ্যতে দেশ আবারও তথাকথিক হায়নারুপী একনায়কতন্ত্রের নারকীয় থাবায় পড়বে। এই জেনজি অবশ্য এটি হতে দেবে না আশা করা যায়।সকল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষের মানুষের অনুরোধে বিশ^ বরেন্য ড. মুহাম্মদ ইউনুছ কে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। এখানে ও আওয়ামি হায়নাদের কূটচাল বন্ধ হয়নি। সমস্ত প্রশাসন ওদের দোসরদের ভারে টাইটুম্বুর। ওদের হটাতে না পারলে সরকারের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। এই জাতি বীরের জাতি। আমাদের দেশে খেঁটে খাওয়া সৎ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। আমাদের মায়া দয়াও বেশী। কিন্তু অতিরিক্ত ধানাই পানাই করলে আমাদের মাঠে নামতে বেশী দেরী হয় না। আমরা সহনশীল তবে অকার্যকর বা অবলা না। যুগে যুগে অনেক প্রমান করেছি আমরা। প্রয়োজন পড়লে আবার রাজপথে নামবো। আর যারা এখনকার মতো চামচামি আর ফোরং কাটছে তারা ছিল ও ভবিষ্যতে ও থাকবে। ওরা শুধু নিজেদের বানানো এলিটের ঘরনার মাঝেই জীবন পার করে দেবে যতদিন অর্থ, ক্ষমতা , যৌবন আছে। তারপর বেঁচে থাকলে বুঝবে সমাজের প্রয়োজনীয়তা, সমাজের সকল স্তরের মানুষের অভাব, কিন্তু হয়ত সময়টা অনেক দেরী হয়ে যাবে। আজ আমাদের কিছুটা অভাবের মধ্যে হয়ত যেতে হচ্ছে নানান বাস্তবতার কারনে। তবুও জনমনে তেমন কোন আতংক ও অস্বস্থি নেই। বিছিন্ন কিছু নিয়মিত দূর্ঘটনা ছাড়া তেমন কোন অশান্তি নেই। যা আছে ফেসবুকে কিছুটা রয়েছে। সর্বজনগ্রায্য ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর প্রতি প্রায় সকল মানুষের আস্থা আছে, আশা আছে। ইনশাল্লাহ আমারা সকলের প্রচেষ্টায় আবার এগিয়ে যাবে। দল মত নির্বিশেষে সকল মেহনতী মানুষের জয় হোক। শিক্ষার্থী জনতার আত্বত্যাগ আমাদের ভবিষ্যতের প্রেরণা। দেড় যুগে সকল অন্যায়ের শিকার মানুষদের জন্য সমবেদনা ও শ্রদ্ধা। এটার নাম দেশের অনেক মানুষ দিয়েছে ২য় স্বাধীনতা। আমি বলি আমাদের নতুন স্বাধীনতা।
\'জুলাই শিক্ষার্থী- গণঅভ্যুত্থান\' নিয়ে প্রবন্ধ
ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন, কবিতা, ছড়া ও গল্প লেখার অভ্যাস। তবে সংবাদ পত্রে প্রতিবেদনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক লেখালেখির শুরু।
0 Comments