একটি টাকার আত্মকাহিনী সাদিয়া আফরোজ শশীসকাল থেকেই ডান পাশের অংশ টা কেমন যেন নড়ছে।মানুষের ডান চোখ লাফালে নাকি খুশির সংবাদ আসে,এক সময় এক দাদী-নাতনীর গল্পে শুনেছিলাম এই কথা টা।এই কথা শুনে,নাতীও কি খুশি,এই বুঝি তার শখের পুতুলটা পেয়ে যায়।কিন্তু,আমি তো টাকা, তাহলে আমার আর কি খুশি!অন্যকে খুশি করা আমার কাজ।কারো শখ পূরণ,তো কারো প্রয়োজন পূরণ।কখনো আবার কারো কারো সব থাকা স্বত্তেও চোখ আমাকে দেখলে চকচক করে ওঠে।ওহ,আমার সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে ভুলে গিয়েছি।হ্যাঁ,আমার নাম ১০০ টাকার নোট।যদিও আমার মধ্যে একটা নম্বর আছে যেটা দিয়ে আমার অনন্যতা প্রকাশ হয় তবুও সবাই আমাকে ১০০ টাকার নোট নামেই চিনে।আজ বহুদিন যাবৎ আমি আঁটকে আছি রহিম সাহেবের মানিব্যাগে।রহিম সাহেবের মোটামুটি অর্থবিত্ত ভালোয় আছে,তাই বড় নোটগুলো ব্যাংকেই রাখেন।আর আমি সহ ছোট নোট গুলা ওনার মানিব্যাগেই থাকে।মাঝে মধ্যে ওনি মানিব্যাগ টা খুলেন তবে আমাকে বের করেন না।কখনো কখনো করতে চেয়েও করেন না। কিন্তু আজ হঠাৎ আমায় বের করলেন, তখন দেখলাম আজ বাড়ি ভর্তি মানুষ,ছোট ছোট বাচ্চারা দৌঁড়াদৌড়ি করছে,গায়ে নতুন জামা।মহিলারা খাবার টেবিল সুন্দর করে সাজিয়েছে।সাথে নিজেরাও সেজেছে,সচরাচর ঘরের মহিলাদের এতো পরিপাটি দেখা যায় না।আমাকে বের করতেই দেখলাম, কয়কজন বাচ্চা হাত পেতে রহিম সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সাথে মুচকি মুচকি হাসছে তারা।চোখেমুখে প্রশ্ন।রহিম সাহেবও চলনার হাসি দিয়ে হঠাৎ করে আমাকে তুলে দিলেন এক পিচ্চির হাতে।ওহ,বুঝলাম,আজ তবে ইদের দিন।মুসলমানদের পবিত্র অনুষ্ঠান।অবশেষে সালামি হিসেবেই রহিম সাহেবের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি হলো আমার।কিন্তু,ওমা!এ কি!পিচ্চি টা করছে কি??আমায় তো একদম কাচুমুচু করে ভাজ করে তার পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলো।যেনো আমি জ্ঞানটাই হারিয়ে ফেললাম।আমার আর কিছুই মনে নেই।রহিম সাহেবের মানিব্যাগের ভেতর জায়গাটায় একটা চামড়া চামড়া গন্ধ থাকলেও,আমি সোজা হয়ে ছিলাম।কিন্তু বাচ্চাটার নতুন পাঞ্জাবির নতুন কাপড়ের গন্ধটা কেমন যেনো বিদঘুটে।অন্যরকম এক গন্ধ।পুরাতন বইয়ের গন্ধ অনেক ভালো লাগে, কিন্তু নতুন কাপড়ের গন্ধে আমার মাথা ঘোরে।পরের বার যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম কোন এক ঝালমুড়ি ওয়ালার ঝালমুড়ির বাক্সে। পাশে অন্য টাকার সাথে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছি রীতিমতো।যতই ঝালমুড়ি ওয়ালা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,আমি বারবার সামনে আর পিছনে যাচ্ছি।আমার আশেপাশে সবগুলোই খুচরা নোট।বুঝলাম পুচকে টা আমায় দিয়ে ঝালমুড়ি কিনে খেয়েছে।কিন্তু আমার চিন্তাভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো ঝালমুড়ি ওয়ালা নিজে।আহ!কি বিপদ রে বাপু,এই ঝালমুড়ি ওয়ালা একটু আস্তে হাটঁতে পারেনা?কিসের এত তাড়া তার?মনে হচ্ছে এই মাত্র তিনি ট্রেন মিস করবেন।কিন্তু এমন সময় ওনি থেমে গেলেন।আর বহুযত্ন বের করলেন আমাকে।ঝালমুড়ি ওয়ালার ময়লা অথচ যত্নমাখা হাত আমাক একটু বেশি সতর্কতার সাথেই যেনো বাক্স থেকে বের করলেন।সামনে দেখি এক কাপড়ের দোকান,আহা মরি বড় দোকান নয়।কোনরকম মার্কেটের এক কোণে ছোট একটা জায়গায় কিছু কাপড় স্তুপ করে রাখা হয়েছে যেনো।যদিও দোকানের শাটার ফেলা,এক পাশে হালকা তোলা রয়েছে।ইদের দিনে স্বভাবতই সব বন্ধ থাকে,কিন্তু কিছু কিছু মানুষ জীবিকার তাগিদে,এই আনন্দ আর বন্ধের দিনেও নিজেকে ছুটি দেওয়ার সুযোগ পায় না।ঝালমুড়ি ওয়ালা গিয়ে বললেন,\"এই যে ভাই,জামা ডা রাখছেন তো?আমার মাইয়া কিন্তু ওই লালজামা ডাই চায়।দোকানী বললো,\"হ,আছে।দেরি করলা কেন?বাড়ি কি যামুনা?নামাজ পইড়া তোমার লাইগা দোকানে বইসা আছি।\"ঝালমুড়ি ওয়ালা হাসলো।কিছুটা নীরব অথচ আত্মসমর্পিত কন্ঠে মাথা নিচু করে বললো,\"১০০ টাহা কম আছিলো।\"এই বলে তিনি বান্ডিল করা কয়েকটি ১০০ টাকার নোটের সাথে আমাকে জুড়ে দিয়ে তার অভিজ্ঞ হাত দিয়ে শেষবারের মত গুণে দেখলেন,মেয়ের ইদের জামার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টাকা তিনি জমাতে পেরেছেন কিনা।দোকানীর ক্যাশবক্সে যাওয়ার আগে,আমি দেখলাম তার হাতে একটা ব্যাগ এবং তার চোখে চিকচিক করছে পানি।যেন তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ।একজন বাবা,যিনি কিনা মেয়ের শখ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন,তার চেয়ে সুখী বাবা পৃথিবীতে আর কে হতে পারে।নিশ্চয়ই তিনি ইতিমধ্যে কল্পনাও করে ফেলেছেন মেয়েটি লালা জামা গায়ে দিয়ে কি সুন্দর হেঁটে বেড়াচ্ছে পুরো উঠানময়।আমি শেষবার যখন দেখলাম লোকটি পা বাড়িয়েছে বাড়ির দিকে।এক হাতে ঝালমুড়ির ঝুড়ি,অন্য পাশে বহুকষ্টে ধরা কাপড়ের ব্যাগটি।তার পায়ের দ্রুততা যেনো আরো বেড়ে গিয়েছে।চোখেমুখে খুশি।যাওয়ার সময় এক ছেলেকে তাকে ঝালমুড়ির জন্য ডাক দিতেই তিনি ইশারায় কি যেনো বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।হতে পারে,মেয়েকে আর অপেক্ষা করাতে চাচ্ছেন না তিনি।দোকানীর ক্যাশবক্সে শুয়ে ছিলাম এক পাশে।সাথে অনেক টাকা,শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম ডানপাশ কেনো নড়েছিলো।আজ নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে,অনেক খুশি লাগছে।টাকার ও খুশি লাগতে পারে?ঝালমুড়ি ওয়ালার চোখের কান্নামাখানো হাসি দেখে আজ টাকা হয়ে জন্ম নিয়ে নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে।
0 Comments