আত্মান্বেষী আত্মানুভূতি

আমার ভীষণ শখ, আমার একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর হবে নদী বালুচরের মাঝে। যার একপাশে থাকবে পাহাড় আরেক পাশে বয়ে চলা নদী। শুকনো খড় বিচালির চালা হবে সেই ঘরের। আলোর বিন্দুর মত ছোট ছোট ছিদ্র ওয়ালা বাঁশের চাটাই-এর বেড়া হবে সেই ঘরের। সেই ছিদ্র গুলো দিয়ে চাঁদ সূর্যের আলোরা উঁকি দেবে দিন রাত। দক্ষিণে থাকবে একটি বড় জানালা।মাঝে মাঝে মন খারাপ এর সময় জানালায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণা বাতাস এর সাথে মৌন আলাপ চারিতা চলবে। দরজার ওপারে থাকবে ছোট্ট একটা বারান্দা। বারান্দার খুঁটি গুলো হবে বাঁশের। ঘরের ভেতর থাকবে না না কোন আসবাবপত্র বা রঙিন কোন জিনিস। এক পাশের বেড়ায় বাঁশের কঞ্চিতে ঝোলানো থাকবে সাদা শিফন আর সুতির শাড়ি। অন্য কোনো রঙ নয়, বড় জোর সাদা শাড়িতে কালো পার হতে পারে। ঘরের এক কোণে মেঝেতে পাতা থাকবে খেজুর পাতার তৈরি মাদুর, বালিশের প্রয়োজন নাই, বসার পিড়ি টা কেই না হয় বালিশ ভেবে নেব। দরজার পাশে বেড়ায় ঝোলানো থাকবে একটা ছোট্ট হারিকেন, রাতের বেলা অন্ধকার কাটানোর জন্য। চালায় শিকায় ঝোলানো থাকবে কিছু বড় থেকে ছোট বিন্যাস করে সাজানো মাটির হাড়ি। যেখানে থাকবে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র বা খাবার দাবার। বারান্দার এক কোণে ঝোলানো থাকবে একটা বাঁশের তৈরি পাখির খাঁচা। একটা ময়না পাখি থাকবে সেখানে, শেষ বেলায় সঙ্গী হয়ে।বারান্দার অন্য পাশে থাকবে ছোট্ট মাটির চুলা যেখানে থাকবে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র তবে সব মাটির তৈরি। একটা গ্লাস, একটা থালা, হাড়ি কড়াই ইত্যাদি ইত্যাদি। মাটির পানির কলসি টা বারান্দার খুটিতে হেলান দিয়ে বসানো থাকবে। বারান্দা থেকে পা নামালেই বালু চরে পা গুলো ডুবে যাবে। একটু এগুলেই বয়ে চলা নদী, দশ বারো কদম হাঁটলেই স্বচ্ছ পানির ধারায় পা ভিজে যাবে। বালু চরে বসে পা ডোবালেই ছোট ছোট ঢেউ গুলো এসে পায়ে ধাক্কা খাবে আর বলবে তোমাকে আমরা অনেক ভালোবাসি যতটা তুমি আমাদের ভালোবাসো আর যতটা ভালো কেউ কাউকে কখনো বাসেনি। কুঁড়েঘরের সংসারে প্রতিদিন ভোর বেলায় ঘুম ভাঙবে পাহাড়ের ঘন সবুজ থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন বন্য সুর এর আওয়াজে। আড়মোড়া ভেঙে এক কোণে বসে সূর্যের প্রথম কিরণের আনাগোনা ঘরের মেঝেতে দেখতে দেখতেই কয়েক প্রহর কেটে যাবে। পোষা ময়নাকে সকালের খাবার দিতে দিতে আনমনে ভাববো যদি ময়নার মত মানুষকে পোষা যেত,তবে কাউকে পুষতাম পরম যত্নে। আর কুঁড়ে ঘরে আরেক টা প্রাণের অস্তিত্ব থাকতো। সব অভিমান, দু:খ, কষ্ট, যন্ত্রণা গুলো ছোট ছোট করে ভাগ করে শাড়ির ভাজে বেঁধে রাখব জমিয়ে জমিয়ে । বহু যুগ ধরে যে হাতে মেহেদীর রঙ উঠেনি সেই অভিমানি হাত গুলো রঙিন হবে কাদা মাটির খেলায়। নদীতে গোসল করতে নেমে শাড়িতে বাধা দু:খ গুলো নদীর জলের শীতলতা ও পবিত্রতার বিনিময়ে সওদা করে দেব। দু:খের বিনিময়ে প্রশান্তি কিনে বুক জুড়াবো। বহু বছর ধরে অযত্নে অবহেলায় বেধে রেখে নষ্ট হয়ে যাওয়া চুল গুলো আর কখনো কোন বাঁধনে জড়াবো না।এলোমেলো আর অবাধ্য হয়ে হালকা করে জড়িয়ে থাকবে কাধ আর পিঠ, উসকো খুশকো হয়ে ঝগড়া করবে বাতাসের সাথে। দুপুর বেলায় ময়নার সাথে অনুভূতির গল্প আর রান্না হবে মাটির চুলায়, খাবার দাবার খেয়ে ময়নার ভাত ঘুম আর আমার উদাস দুপুর উপভোগ হবে নিত্য দিনের সঙ্গী। উত্তপ্ত দুপুর বুকে ধারণ করে আনমনে নদী দেখতে দেখতে বিকেল চলে আসবে। বিকেল বেলা পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিয়ে তার শেখরে গিয়ে দাঁড়িয়ে চূড়ায় তাকিয়ে ভাববো যে ওই পাহাড়ের চেয়েও উঁচু ছিল তাদের মন যাদের মনের কাছে পৌছাতে পারিনি কখনোই, যাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারিনি কখনোই । এক রাশ অভিমান নিয়ে পাহাড়ের নাম দেব \'অধরা\'। গোধূলি বেলায় নদীর পারে ফিরে এসে নদীর বুকে সূর্যের ডুবে যাওয়ার ছবি ধারণ করব। দূর থেকে ভেসে আসা এক ঝোপ কচুরিপানা আর এক কলোনি শেওলার ভেসে আসার পথে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাববো আমিও কখনো মানুষের জীবনে এভাবেই ভেসে আসতাম আবার ভেসে চলেও যেতাম। যেমনটা ভেসে আসে আর ভেসে চলে যায় নীল আকাশের বুকে সাদা তুলোর মতো মেঘ গুলো। নদীর বুকে সূর্যের অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখে নিজের জীবন এর অস্তমিত হওয়ার কথা স্মরণ করব। স্মরণ করব অন্তিম সেই দিন। সন্ধ্যা রাতের বেলা ময়নার সাথে গল্প করতে করতে আর চাঁদের কিরন এর ঘরের ভেতর লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। ঘরের কোণে রাখা হারিকেন টা বড্ড অভিমান করে বলবে যখন জ্বালাবি না আমায় তবে ঘরে কেন রেখেছিস? মুচকি হেসে বলব বুকের ভেতর আগুন নিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কতটা সেটা জেনেও কি করে তোমার বুকে আগুন জ্বালাই বলো, হারিকেন ও এরপর চুপ হয়ে যাবে। মাঝ রাতে জ্যোৎস্না বিলাস হবে বালু চরে বসে। মধ্য রাতে বালুর উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে বসে সারা গায়ে জ্যোৎস্না মেখে নেব। চোখের পলকে কেটে যাবে কয়েক প্রহর। শেষ রাতে বারান্দায় তাহাজ্জুদ এর নামাজে প্রভুর সঙ্গে হিসেব নিকেশ হবে আজীবন এর। মোনাজাত শেষ না হতেই নদীর জলের শীতল বাতাস এসে চোখ মুখ ছুঁয়ে প্রশান্তি দিয়ে যাবে। এ যেন পরম শান্তি,পরম সুখ। এরপর আবার ভোর আসবে আবার দুপুর, পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যা আবার রাত। এভাবেই কেটে যাবে জীবন এর শেষ কয়েকটি বছর। কুঁড়েঘরের সংসারে থাকবে না কোন দু:খ কষ্ট যন্ত্রণা। ঝড় বাদলের দিনে নড়বড়ে ঘর এর ভেঙে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই ভুলে যাব সারা জীবন এর সংসারের স্বপ্ন, কুঁড়েঘর টা রক্ষার চিন্তায় ভুলে যাব ঘর রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টার কথা। কুঁড়ে ঘরে বৃষ্টির ফোটায় চোখের জল লুকিয়ে কাঁদতে হবে না। কোন কান্না থাকবে না কোন অপেক্ষা থাকবে না। কুঁড়েঘর হবে পরম শান্তির আশ্রয়। এতটাই প্রশান্তির যে ক্ষত বিক্ষত প্রাণের মুক্তি হয়ে যাবে একদিন কোন এক বিকেল বেলা সূর্যের অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে। নিথর দেহ টা পড়ে থাকবে বারান্দা আর বালুচরের মাঝামাঝি। শেষ বারের মতো চোখ দুটো অস্ত যাওয়া সূর্য দেখতে দেখতে চিরতরে বন্ধ হতে ভুলে যাবে। শেষ বারের মতো নদীর জল কে স্পর্শ করার অতৃপ্ত ইচ্ছে নিয়ে নদীর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া ফ্যাকাসে সাদা হাত টা পড়ে থাকবে বালু চরে। পোষা ময়না টা নিজের শেষ সঙ্গীর বিদায় হয়েছে বুঝতে পেরে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ভাঙাচোরা পুরনো খাঁচা ভেঙে বাইরে এসে নিথর দেহ কে শেষবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরখ করে দেখে নেবে। নি:শ্বাসের অস্তিত্ব না পেয়ে শেষ বিদায় নিয়ে সে ও চলে যাবে দূরের সেই পাহাড়ে। বাহিরে মেলে রাখা সাদা শাড়ি টা পরম অভিমান নিয়ে বাতাসের বন্ধু হয়ে উড়ে চলে যাবে আর নদীর জলে মিশে যাবে। পড়ে থাকবে শুধু একটা পঁচা বাসি নিথর দেহ আর আমার অনেক স্বাধের সেই স্বপ্নের কুঁড়েঘর।