মুর্খদের গ্রাম

জয়পুর নামের এক গ্রাম ছিল। ছিল না বিদ্যুতের ছোঁয়া, না ছিল কোনো স্কুলের চিহ্ন। কিন্তু ছিল ভরা মাঠ, সবুজ ধান, আর ছিল অজস্র হাসি। গ্রামের মানুষগুলো অশিক্ষিত—হ্যাঁ, কেউ নাম লিখতে পারে না, আবার কেউ সংখ্যার পর সংখ্যা গুনতে গুনতে থেমে যায় দশের পরই। তবুও এই গ্রামের একটিই নাম—“মুর্খদের গ্রাম।”তবে এই ‘মুর্খরা’ ছিল আজব এক জাত। কারো ঘরে আগুন লাগলে পুরো গ্রাম একসাথে ছুটে আসত পানি নিয়ে। কেউ অসুস্থ হলে সবাই পালা করে শেভিং করিয়ে পায়ে পায়ে গ্রামীণ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। কোরবানির গরু জবাইয়ের সময় পুরো গ্রামের গরিবরাও মাংস পেত, আর ধনী পরিবারের গরুও মাংস পেত না কিছুক্ষণ না দিলে গরিবের বাসায়।এদিকে শহরে—বড় বড় ডিগ্রিধারীরা থাকত। এরা ইংরেজি বলত, ফ্রেঞ্চ জুতায় পা দিত, আর মুখে থাকত “হিউম্যানিটি”র বুলি। তবে দরজায় কেউ ভিক্ষে চাইলে চোখের ইশারায় দারোয়ানকে ডাকত। ছেলেটা রাস্তার পাশে পড়ে আছে, ওদিকে মানুষ গুগলে “how to save a dying person” সার্চ করে সময় নষ্ট করত।জয়পুর গ্রামের বেলায় অনেকবার চেষ্টা হয়েছিল ‘উন্নয়ন’ আনার। শহর থেকে একদল NGO কর্মকর্তা আসল। তারা বলল—“আপনারা কি জানেন না, লেখাপড়া ছাড়া মানুষ পশুর চেয়েও অধম?”গ্রামের একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে বলল,“তাইলে শহরের ঐ সাহেবরারে কি বলবেন, যেইরা ইয়াত্তর টাকা দিয়া ঘুষ খায়? ওরা কি বান্দর না বাঘ?”এক NGO অফিসার গম্ভীর হয়ে বলল,“আপনারা উন্নয়নের পথে নাই।”গ্রামবাসী হাসল—“আমরা ভালা থাকি, শান্তি পাই, কারো ঘরে চুরি হয় না, মাইয়া রাই রাতে একা চলাফেরা করে—এইডা যদি উন্নয়ন না হয়, তাইলে আপনারা যা করেন—উন্নয়ন না কি অশুভ উন্নয়ন?”শহরে তখন নতুন এক কেলেঙ্কারি বের হলো—এক ডাক্তার অপারেশন করে ভুলে গজ ফেলেছে পেটের ভেতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ধর্ষণের অভিযোগে ধরা পড়লো। ব্যাংকের বড় ম্যানেজার কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করল।গ্রামের মানুষ এইসব দেখে পান্তা ভাত খেতে খেতে বলে—“শিক্ষা থাকলে ভালো, তবে মন থাকলে আরো ভালো। আর এই মন জিনিসটা শহরে নেই।”একদিন সাংবাদিক এল গ্রামে। প্রশ্ন করল,“আপনারা কি মুর্খ বলে নিজেদের ছোট মনে করেন?”গ্রামের মাতব্বর উত্তর দিল,“না রে ভাই, আমরা মুর্খ বইলা লজ্জিত না। কারণ আমরা মনুষ্যত্ব হারাই নাই। যারা শিক্ষিত হইয়া চুরি করে, মানুষ ঠকায়, তারা শিক্ষিত পশু।”সাংবাদিক হতবাক হয়ে ফিরে গেল।শেষে কেউ কেউ বলতে লাগল—“মুর্খের গ্রাম ভাল, শিক্ষিতদের শহর ভয়ংকর।”