তারাগঞ্জে হাজার তারা

তারাগঞ্জ বাজার — যেন একেকটা গ্রামের মানুষজনের জন্য ছোটখাটো “পিকনিক স্পট”! বিকাল নামলেই তাজপুর, কোচনধরা, বেলবেলিয়া, স্ত্রীবাড়ী আর মোহনপুরের লোকজন ছুটে আসে হাটে। তবে বাজারে কেউ ঠিক বাজার করতে আসে না, আসে “বাজারে আসছে” বলে নিজের নাম জাহির করতে।বিকাল ৪টার দিকে হাঁকডাক শুরু হয়: — “ও কাশেম ভাই! কই গেছিলেন? তিন দিন আইছেন না!”— “বউরে দিছিলাম বাপের বাড়ি! শান্তি চাই শান্তি!”— “তয় তো এখন বাজারে আইছেন কী করতে?”— “শান্তি পাইলাম না! বউ আবার আইছে!”এক কোণে অজিতের ফার্মেসি। লোকজন বলে ওটা ‘চিকিৎসালয ও সুস্থকেন্দ্র’। অসুখ এখানে ওষুধে নয়,অজিতের মুখে মিঠা কথায় বেশি ভালো হয়।একদিন বেলবেলিয়ার রফিক ভানু নামে এক চুপচাপ লোক এসে বলল,— “ভাই, একটা শক্ত টাইপের ওষুধ দেন……”অজিত হাসিমুখে বলল,— “শক্ত ওষধ দিলে কাজ করবে না,ক্যাপসুল গুলে খানদানি ঢংয়ে খাইতে হবে… তিন বেলা বাজারে এসে হাঁক পাড়বেন ‘আমি শক্ত! আমি শক্ত!’ তহন কাজ হবে!”মাঝে মাঝে স্ত্রীবাড়ীর মোজাম্মল বাজারে আসেন শুধু লোকেদের দাঁতভাঙা যুক্তি শোনাতে।একবার বললেন,— “এই যে সুমর মিয়া, বলেন তো মাংসের দাম বাড়ছে ক্যান?”সুমর ভয়ে বলল,— “বউয়ের দোষ! ওরে মাংস খাওয়াইতে মাংসের ব্যবসায় লস হয়ে যায়।চকবাজারে জামালের পানের দোকান। এখানে জোয়ান বুড়া সবার সাথে আড্ডা দেয় আরেক জামাল। ছোট জামাল আর বড় জামাল নিয়ে হয় প্রায়ই গন্ডগোল। চায়ের দোকানে ছোট জামাল চা অর্ডার করলে দিয়ে যায় বড় জামালের কাছে। চায়ের বিল নিয়ে যখন লংকা কান্ড তখন সবাই হেসে কুটি কুটি।তারাগঞ্জ বাজারে একবার গুজব ছড়ায় —“চোর ধরা পড়েছে, কিন্তু চোর নিজেই বলছে সে চোর না, তার জামাই চোর!”এই কথা শুনে কোচনধরার জহুর আলী বললেন,— “এইবার তয় আমারে নিয়া গুজব হইব!”— “ক্যান?”— “কারণ আমিও জামাই! তয় চোর না।”প্রতিদিন বিকেলটা যেন মফস্বলের একটা উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ। হাসি, ঠাট্টা, কটুকথা, গুজব, প্রেম, রাজনীতি—সব চলে মসলা মিশায়ে। কেউ কেউ মাছ কিনে বাড়ি ফেরে, আর বাকিরা হাসি কিনে আত্মীয়স্বজনের কাছে গল্প বিক্রি করে।তারাগঞ্জে হাজার তারা — কেউ জ্বলে তেল দিয়া, কেউ কথা দিয়া, আর কেউ গুজব দিয়া! এখানে ধনীর সদর তবে গুনীর নাই কদর। তাই হাজার তারা হাজার দিন ধরে জ্বললেও বাজারটা আলোকিতের চেয়ে কিছুটা যেন অন্ধকারই!