এইতো কিছুদিন হলো নিসর্গে কেবল হেমন্ত নেমেছে। অল্প অল্প শীতও পড়া শুরু হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে গা শিরশিরে বাতাস শীতের সারি গান গাইতে শুরু করেছে। প্রতিদিন ঠিক এই সময়টাতেই আনোয়ার মিয়াকে নদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি যেখানটাতে দাড়িয়ে থাকেন ঠিক তার দশ কদম পিছনেই রয়েছে বিশাল বড় একটা বটগাছ এবং তার পাশ ঘিরেই রয়েছে বেশ পুরনো, ভাঙ্গা একটা ছোট্ট মাজার।এই মাজারটি কে বা কারা তৈরি করে রেখেছিল সেটা জানা যায়নি তবে গাছটার বয়স সম্পর্কে আনোয়ার মিয়াকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম; তিনি একটা আনুমানিক উত্তর দিয়েছিলেন_যে হয়তো এর বয়স দেড়শ বছরের কাছাকাছি হবে। তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন তখনকার দিনের মতোই এখনও গাছটি তার চারপাশে আছড়ে পড়া দিগন্তের মতো সমস্ত শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে উদারচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে।দেখতে খুব ভাবগম্ভীর লাগে। মনে হয় যেন এক অদ্ভুত আধিপত্যের দাবি নিয়ে যুগ যুগ ধরে মাটির উপর দাড়িয়ে আছে আর সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে এ মাটি আমার, মাটির উপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস, দিবসের আলো, নিশীথের নক্ষত্ররাজি_ওরা সবাই আমার সুখ দুঃখের সাথি।ওই যে একটু দূরে বয়ে চলা নদীটি দেখছ_ওর নাম মুগ্ধা নদী।ও_ও আমার বন্ধু। আমার সামনে দিয়েই প্রতিদিন ওর জোয়ার-ভাটা হয়। মুগ্ধা গ্রামীন একটা নদী হওয়ায় এটি খুবই শান্ত প্রকৃতির। এর তরঙ্গ খুব বেশি উত্তাল নয়, বরং ধীরে-নিরবে বয়ে চলে। যদি অনেক্ষণ সে নদীর জলে তোমার চিন্তন চাহনি আটকে রাখো তবে শেষ বেলার বৃদ্ধ সূর্যের রক্তরাঙা জলছবিটাও দেখতে পাবে। তরঙ্গ দোলায় দোলে সে জলছবি। এরপরে, হঠাৎই নিজের অজান্তে তোমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে__আচ্ছা...দিবসন্তে সূর্য কেন রক্তিম আকার ধারন করে! এর সাথে মানুষের জীবনের মিলটাই বা কোথায়। বিষয়টা হয়তো তোমাকে বেশ ভাবাবে কিন্তু প্রথম প্রথম তুমি এর উত্তর খুঁজে পাবে না। তবে পরক্ষণে পেয়ে যাবে। তারপর, হয়তো রহস্যঘেরা সন্তুষ্টচিত্তে তুমি নিজেই বলে উঠবে__মিল তো আছে বটেই; তা না হলে চাঁদের সাথে সূর্যের দেখা হতো কিভাবে। মানুষের জীবনে যখন সূর্যের মতো বার্ধক্য এসে যায়; সাথে সাথে তার জীবনের সকল দুঃখগুলোও একসাথে এসে জড়ো হয়ে রক্তিম বেদনার আকার ধারন ধরে। অনেকে সেই বেদনায় মোহাবিষ্ট হয়ে কল্পনায় অতীতের সাগরে এসে ডুবে যেতে চান। আনোয়ার মিয়াও যেহেতু প্রতিদিন নদীর পাড়ে এসে একান্তে সময় কাটান, তিনিও অবশ্যই তার ফেলে আসা অতীত সম্পর্কে ভাবেন, ভাবেন শৈশবের স্মৃতিকথা, কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কিভাবে তার বয়সটা বেড়ে গেল__এসব।বিশেষ করে মুগ্ধা নদীটি তার কল্প স্মৃতিতে সবচে\' বেশি প্রভাব ফেলে। কারণ, তার জীবনে জড়ো হওয়া প্রায় সকল স্মৃতিগুলোর কেন্দ্রবিন্দু হলো_এই নদীটি। মাঝে মাঝে রাতের আধারে যখন তিনি মাঝিমাল্লার কন্ঠে__ \"মাঝি বাইয়া যাও রে__,অকুল দরিয়ার মাঝি,আমার ভাঙা নাও রে_মাঝি,বাইয়া যাও রে!\"অথবা,\"নদীর একুল ভাঙে অকুল গড়ে,এইতো নদীর খেলা\"। এই গানগুলো শুনতে পান তখন বারেবারে এই নদীর সাথে মিশে থাকা সকল স্মৃতির কুঁড়েঘরে গিয়ে তার চিরদিনের জন্য লুকিয়ে থাকতে মন চায়।মন চায় নদীটির কাছে গিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকতে। তাইতো, তিনি কাজে ফুরসৎ পেলেই মনের টানে সেথায় ছুটে যান। বসে বসে ভাবতে থাকেন সারাটা বিকেল। সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু আজ তার ভাবনার সাগরে একটু বাঁধ পড়ে গেল। হঠাৎই, তিনি কিছু ছেলেমেয়েদের হইচই শুনতে পেলেন। ওরা এ গ্রামেরই। আনোয়ার মিয়া ওদের সকলকেই চেনেন। আদরও করেন। ওদের একজনের নাম হারুন, একজনের নাম শুভ্র; আরও আছে রুকাইয়া, রুপা, আহনাফ, হামিম, আবির ও অ্যালেন। ওরা প্রতিদিনই খোলা আকাশের ছায়ায় বসে খেলাধুলা করে। কিন্তু আজকে একেবারে খেলতে খেলতে বটগাছের নিচে চলে এসেছে।ব্যাপারটা একটুখানি বক্ররেখার ছাপ ফেলেছে আনোয়ার মিয়ার মনে। সেই রেখা ধরেই তিনি ওদের কাছাকাছি গেলেন_কেন ওরা আজকে এখানে খেলতে এসেছে তার কারণ জানতে। উত্তরে ওরা বলল যে আজকে নাকি ওরা মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ খেলবে। তাই ভাঙ্গা মাজারটাকে ওরা পাকবাহিনীর ক্যাম্প বানাবে। মূলত, এজন্যই ওরা বটগাছের নিচে চলে এসেছে খেলতে খেলতে। ইতিমধ্যেই স্ক্রিপ্ট সাজানো হলো। আহনাফ হবে মুক্তিযুদ্ধ ফৌজের কমান্ডার। তার নেতৃত্বে থাকবে হামিম, শুভ্র ও রুকাইয়া। অপরদিকে, পাক হানাদারদের কমান্ডার হবে আবির এবং তার নেতৃত্বে থাকবে হারুন ও অ্যালেনদের একটি দল।প্রথমে, হানাদাররা এসে রুপাকে উঠিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। এরপর মুক্তিবাহিনীদের দলটি রাত্রিবেলায় ক্যাম্পে গিয়ে পাক-হানাদারদের উপর পরিকল্পনা মোতাবেক গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে রুপাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। এতো চমৎকার একটা পরিকল্পনা শুনে আনোয়ার মিয়া আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি নিজেই আগ বাড়িয়ে ওদের খেলায় সামিল হতে চাইলেন।তার এমন আবদার শুনে রুপা বলে উঠলো__\"না দাদু,আমাদের খেলায় তোমাকে নেয়া যাবে না।তুমি বড় মানুষ।\"রুপার মুখে এ কথা শুনে তিনি একটা ভাপসা হাসি দিয়ে বললেন__\"যুদ্ধ হলো মানুষ মারার খেলা।যে খেলা শুধু পাগলরাই খেলে।তাই সব বয়সের পাগলরাই এ খেলায় অংশ নিতে পারে।শোনো,তোমারা তো জানো আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।অতএব,আমি জানি কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়।কিভাবে মিশনে যেতে হয়।তোমাদের দলে আমাকে নাও। দেখবে, খেলাটা আরো জমে উঠবে।\"কথাটা বেশ মানানসই-ই মনে হলো আহনাফের কাছে। সে আনন্দচিত্তে বলে উঠলো__\"তাহলে দাদু তুমি আমার দলে খেলবে\"।আবির বললো__\" না!_দাদু, তুমি আমার দলে খেলবে।\" ব্যস্!আনোয়ার মিয়াকে নিয়ে ওদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল।দূর থেকে বেশ ভালোই লাগছিল দুহাত বাজু ভাজে রেখে এতো সুন্দর একটা দৃশ্য উপভোগ করতে।মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধ খেলতে গিয়ে ওদের নিজেদের ভিতরেই সত্যিকারের দুষ্ট-মিষ্টি যুদ্ধ বেধে গেল।
উক্ত গল্পটি একটি কিশোর উপযোগী ছোটগল্প। গল্পটি একজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধের অতীত স্মৃতি ও কিছু কিছু ছেলেমেয়ের খেলাধুলা ও হাসিতামাশার সংযোজনে সা৭ানো হয়েছে।
বাহ, অসাধারণ লাগল গল্পটা।