যেতে চাই না ( ছোটগল্প )

যেতে চাই না ( ছোটগল্প )▪পার্থসারথিচৌদ্দ ফেব্রুয়ারি দুই হাজার নয়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সূর্যের উঁকিতেই ভেসে ওঠল প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরা যৌবনের স্রোতধারার কোলাহল। ভালোবাসার নিঃশ্বাসে, উত্তাপে, আবেগে কিংবা বিশ্বাসে প্রিয়তমর হাতে হাত রেখে চলছে ললনারা। কোটি কোটি হৃদয়ের ভালোবাসার উত্তাপ হেলে দুলে আয়েশী ভঙ্গীতে গুটি গুটি পা পা করে মাতিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। আহা! কী আনন্দ আকাশে, বাতাসে, হৃদয়ের গহীনে প্রতিটি কোণে কোণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভালোবাসার জোড়ায় জোড়ায় জোড়াতালিতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় যেন নতুন এক নকশী কাঁথার মাঠ। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার ঢেউ যেন আনন্দে আছড়ে পড়ছে। এখানে সবাই আপাত সুখীর প্রতিচ্ছবি। সকলের সুখ-নিঃশ্বাসের বাতাসে উড়ে উড়ে কাক-পক্ষীরাও আনন্দে ভাগ বসাচ্ছে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর হৃদয়ের বেড়াজালে ভালোবাসা আজ লক্ষীসোনা। কোথায় রাখি, কেমনে ঢাকি এত ভালোবাসা। যেদিকেই তাকাই ভালোবাসার রঙ চোখের পাপড়িতে বর্ণচ্ছটা মেলে ধরে- শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমি পেরিয়ে টিএসসি, শাহবাগ থেকে শিশুপার্ক হয়ে রমনা পার্কের অন্তর্ভাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সুশীতল ছায়াতল কিংবা ক্যাম্পাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অলিগলি সবখানে। ভালোবাসার মিছিলে অতর্কিত হামলায় সবাই স্তম্ভিত। সকলের দৃষ্টি শাহবাগ মোড়ে। একটা কফিন। নীরব দল ; হতে পারে কফিন মালিকের সমর্থক , আত্মীয় অথবা বন্ধু-বান্ধব আবার নিছক যেচে চলে আসা কেউ। সবার দৃষ্টি ঝাপসা। সকলের প্রাণান্ত চেষ্ঠা চেহারায় কষ্টের ছাপ ফোটাতে। তবে কেউ কেউ মায়ায় আর ভালোবাসায় আবেগাপ্লুত। ভালোবাসার মিছিল ভেদ করে ধীরে ধীরে কফিনাবাহীরা এগিয়ে চলছে টিএসসি-র দিকে। কফিন-বার্তা নিমেষেই সকল তরুণ-তরুণীর দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। কফিন মালিক শ্রীকুমার। তিনি চিরকুমার ছিলেন। এটা উনার নতুন কফিন। তার কাছে এতদিন পুরো পৃথিবীটাই ছিল কফিন সদৃশ। কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে উনি ছিলেন জীবন্মৃত। রক্তাত্মীয় কেউ না থাকলেও কিছু আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধব ছিল। তবুও উনি ছিলেন ভীষণ রকমের একাকি। অবশ্য এই কথাটা বলা মিথ্যাচার হয়ে যায়। সাহিত্য-সন্তানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন, আত্মীয় কিংবা বন্ধু-বান্ধব। উনি কখনও একাকি অনুভব করেননি। বুকের ভেতর সোহাগে রেখে সাহিত্য-সন্তানদের উত্তাপ নিয়ে কাটিয়ে দিলেন পুরোটা জীবন। কদাচিত হয়তো কিছু কবিতা অথবা গল্প কোন কাগজে ছাপার অক্ষরে নতুন জীবন নিয়ে জন্মেছে। এতেই স্বাদের অথবা তৃপ্তির ঢেকুড় তুলেছেন তা কিন্তু নয়। সাহিত্য চর্চা করেছেন। নিজের মনের আর প্রাণের তাগিদে। কেউ কোনদিন বলেনি শ্রীকুমার তোমাকে অর্থ-কড়ি দেবো তুমি একটি কবিতা অথবা একটা গল্প লিখে দাও। শ্রীকুমারের লেখা  নিয়ে কোনরকম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মনের গহীনে একটা সূক্ষ ব্যথা অনুভব করতেন। আহা! আমার সাহিত্য-সন্তানগুলো একত্র হলো না। আমার মৃত্যুর পর ওদেরও মৃত্যু হবে! এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন সাহিত্য-সন্তানদের একত্র করে পরম যত্নে প্রকাশকের হাতে দিয়েছেন। কিন্তু কখনও প্রকাশিত হয়নি। শুনতে হয়েছে- জনপ্রিয় আর পরিচিত লেখকদের লেখা ছাপিয়েই দম ফেলার সময় পাচ্ছি না। তবুও চেষ্ঠা করবো এক ফাঁকে আপনার লেখাটা দেখবার। আহা, কী অমায়িক করুণা!শ্রীকুমারের বিনম্র উচ্চারণ- ভাই একটু কষ্ট করে পড়বেন। যদি ছাপবার মতো হয় তবে ছাপবেন।শোনেন, কিছু না হলেও ছাপতে আপত্তি নেই। আপনি শুধু ছাপা খরচটা দিয়ে যান, দেখবেন ঝকঝকে বই বেরুবে।শ্রীকুমার নিরাসক্ত হাত বাড়িয়ে সাহিত্যের পুটুলিটা হাতে তুলে নিয়ে আর কোন কথা না বলে বিদায় নেন। এক, দুই, তিন করে চার চারটি যুগ পেরিয়ে অশীতিপর শ্রীকুমার ভালোবাসার টানে সাহিত্যের উদ্যানে কাটিয়ে দিলেন। জীবনে কোনদিন অন্ন জোগাড়ে অন্য কোন পথের সন্ধানে হাঁটেননি। কী এক মহাটান, অফুরন্ত ভালোবাসা। পাতায় পাতায় কালির আঁচড়ে গেঁথে রেখে গেছেন দেশ-কাল-জীবনের প্রতিচ্ছবি ; সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা, উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাত আর ছিঁড়ে যাওয়া সেতারের করুণ সুর। জীবনের একটি দিনও শ্রীকুমার হতাশার বাতাসে নিঃশ্বাস নেননি। ভালোবাসায় উপচে পড়া আঙিনায় প্রিয়তমার ছেড়ে দেয়া হাতকে কল্পনায় ছুঁয়ে কখনও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েননি। একটু কষ্ট, একটু দুঃখ, একটু ব্যথা বুকের গভীরে ক্ষণে ক্ষণে জেগেওঠত। কোন রস বা যোগান না পেয়ে আবার উবে যেত এমনিতেই। ছোট ছোট দুঃখ, ছোট ছোট ব্যথার আঁচড় বেশ মধুর আবেশে মনের ভেতর জড়িয়ে নিতেন। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন নিরাবেগ, অনাহার, নিদ্রাহীন, শ্রীহীন মুহূ্র্তের কোলে। কষ্টের সীমানায় কাউকে ইচ্ছে করেই জড়াননি। সবাই ভালো এবং সুন্দর থাকুক এমনই প্রত্যাশায় কাটিয়ে গেলেন গোটা জীবন। সকলের চাওয়া-পাওয়ার চিত্র-প্রতিচিত্র সাহিত্যের পাতায় পাতায় সাজিয়ে গিয়েছেন।দুঃসংবাদ বাতাসের আগে চলে। শ্রীকুমারের জীবনাবসান সংবাদ মুহূর্তেই সারা বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। আজই জাতীয় শীর্ষ একটা দৈনিকে শ্রীকুমারের একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয় আজ শ্রীকুমার ও তার প্রকাশিত গল্পটা। রাতারাতি নয় দিবালোকেই শ্রীকুমার হটকেক। মিডিয়ার দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে শ্রীকুমারের কফিনকে ঘিরে রাজ্যের কৌতূহল। শত হলেও বিখ্যাত লেখক শ্রীকুমারের কফিন। ভালোবাসার মিছিল ধীরে ধীরে  শ্রীকুমারের কফিনের লাইনে মিশে গেল। টিএসসি-র ভেতরে সবুজ চত্বরে কফিনের ভেতর পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন শ্রীকুমার। অন্তরাত্মা কফিনের পাশেই নিরাকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। সজীব দৃষ্টি নিয়ে শ্রীকুমার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে লাইন ধরে দেখতে আসা ভক্তদের সজল চোখ। কারও কারও উষ্ণ ভালোবাসার উষ্ণ অশ্রুফোঁটা টপটপ করে কফিনের গায়ে আছড়ে পড়ছে। যেন চৈত্রের বুক ফাটা মাটির বুকে বৃষ্টির শীতল স্পর্শ। নিরাকার  শ্রীকুমার অপলক তাকিয়ে দেখছে ওর প্রতি সকলের অন্তরে এত ভালোবাসা জমেছিল! আবেগের উতাল-পাতালে নিরাকার শ্রীকুমার অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়ে। সবার সামনে চোখের অন্তরালে নিরাকার  শ্রীকুমার ঘাসের উপর লেপটে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু দৃষ্টি সরিয়ে রাখা সত্যিই কষ্টকর! ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গনে  নিরাকার শ্রীকুমার বেসামাল। দেখতে দেখতে ফুলের সমারোহ ; ফুলের তোড়ায় কফিন ঢেকে গিয়েছে। যেন ভালোবাসার এক নতুন সমুদ্র। ভালোবাসা ঠিকই ছিল শুধু সমন্বয়হীনতার দাপটে ছিল প্রায় চিররুদ্ধ অথবা অন্যকিছু। কফিনটা কাঁধে উঠতেই নিরাকার  শ্রীকুমার ডুঁকড়ে কাঁদতে শুরু করেন- আমাকে তোমরা নিয়ে যেও না। আমি অনন্তকাল এখানেই থাকবো। ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি যেতে চাই না, এখানেই থেকে যেতে চাই।*** 

যেতে চাই না ( ছোটগল্প )

• পার্থসারথি
• 29/05/2025
• 1 views
• 0 Comments

চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি দুই হাজার নয়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সূর্যের উঁকিতেই ভেসে ওঠল প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরা যৌবনের স্রোতধারার কোলাহল। ভালোবাসার নিঃশ্বাসে, উত্তাপে, আবেগে কিংবা বিশ্বাসে প্রিয়তমর হাতে হাত রেখে চলছে ললনারা। কোটি কোটি হৃদয়ের ভালোবাসার উত্তাপ হেলে দুলে আয়েশী ভঙ্গীতে গুটি গুটি পা পা করে মাতিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। আহা! কী আনন্দ আকাশে, বাতাসে, হৃদয়ের গহীনে প্রতিটি কোণে কোণে। 

See More Read Full Story