অতল গহীনের সৈনিক▪ পার্থসারথিচৈতন্য কিশোর ভট্টাচার্য। আপাত দৃষ্টিতে সে একজন সুখী মানুষ। আছে সুন্দর সংসার। সংসারে রূপবতী স্ত্রী আর আদরের দুই সন্তান। ছেলেটা বড়, পঞ্চম শ্রেণীতে ভালো রেজাল্ট করেছে। জিপিএ ৫ পেয়ে স্কুলের সবার নজরে। আর মেয়েটাও লেখাপড়ায় বেশ ভালো। একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। স্ত্রী অঞ্জলী দেবী রূপে লক্ষ্ণী আর গুণে সরস্বতী । সংসারটাকে যেন দশ হাতে সামলে রাখেন দুর্গা দেবীর মতো। চৈতন্যের বেতন খুব একটা নয় তবুও অল্প টাকাতেই সংসারটা গুছিয়ে রাখেন আদর-যত্নে আর ভালোবাসায়। বিয়ের আগে একা একা থাকার বদভ্যাসে টাকা-পয়সা খরচে লাগাম টানাতে কোন চেষ্টা ছিল না চৈতন্যের। তাই একা মানুষেরও টাকার টান লেগেই থাকতো। কিন্তু বিয়ের পর এক অন্য জগতের বাসিন্দা। অঞ্জলী দেবীর হিসেবের উঠানে চৈতন্যের বসবাস। স্ত্রীর কড়া নির্দেশ, অনর্থক টাকা-পয়সা খরচ চলবে না। অফিসে হেঁটেই যেতে-আসতে হবে। দুপুরের খাবারও নিজ হাতে তৈরি করে দেন। ছেলে-মেয়েরাও টিফিন আওয়ারে বাসায় এসে খেয়ে যায়। হাতে কোন টাকা-পয়সা দেন না। সংসারটা, যাকে বলে একটা সুন্দর সাজানো বলয়ে নিয়মতান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ। চৈতন্য যা বেতন পান তাতে সঞ্চয় না হলেও কোন অভাবের আঁচড় পড়তে দেন না অঞ্জলী দেবী। শাসনের বেড়াজালে চৈতন্য সুখী মানুষদের একজন। *অঞ্জলী দেবী তার স্বামীকে এত চিন্তিত এর আগে আর কখনও দেখেন নি। সবসময় হাসি-খুশী আর আমোদেই থাকেন। অফিস শেষে বাসায় ফিরেই সন্তানদের নিয়েই নিমগ্ন থাকেন আনন্দের ভেলায়। টুকটাক লেখাপড়া দেখিয়ে দেন সন্তানদের। বাইরে তেমন একটা বের হন না কাজ ছাড়া। প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো ঘরে বসে বসে শুধু টিভি দেখছেন আর হা-হুতাশ করছেন।পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তায় নিমগ্ন চৈতন্যের পিঠে হাত রেখে অঞ্জলী দেবী বলেন- শোন, এত চিন্তা করে অসুস্থ হলে তো আর সমাধান হবে না? বরং আরও কষ্ট বাড়বে। চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ের হাতটুকু বুকে টেনে চৈতন্য বুকের কষ্টটুকু জানান- তোমাদের কথা চিন্তা করলে আমার দুঃশ্চিন্তার পাহাড় চোখের সামনে দিব্য যন্ত্রণা হয়ে ভাসে। কোন চিন্তা করো না। এখন চাকুরি নেই আবার অন্য চাকুরি খোঁজে নিবে।তা ঠিক আছে। কিন্তু গতিক তো ভালো ঠেকছে না। সহসা এই করোনা রোগ শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সারাবিশ্ব জুড়ে মহাতাণ্ডবে বেড়ে চলছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলতে পারবো? হাতে তো জমানো তেমন টাকা-পয়সা নেই। আর সহজে চাকুরী পাবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই।চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।– অঞ্জলী দেবী স্বামীকে সান্ত্বনা দেন।সত্যি বলতে কী, কোম্পানীটা ছোট হলেও আমার জন্য খুব ভালো ছিল। তাছাড়া মালিক নিজে আমাকে খুব পছন্দ করতেন। স্যারের সাথে এইমাত্র ফোনে কথা বললাম। ছোট কোম্পানীতো তিনি আর পেরে ওঠছেন না। ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন। কারণ চালানোর মত কোন আর্থিক সচ্ছলতা উনার নেই। তাই ভাবছি!কোন চিন্তা করো না। একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। রান্না শেষ। স্নান করে এসো। একসাথে খেতে বসবো। অঞ্জলী দেবী চলে যেতেই, ভালোবাসা আর নির্ভয়ের হাতের স্পর্শটুকু মনের কোণে জাগ্রত হয়ে ভেসে ওঠল। মনের আঙিনায় আবার জীবন্ত হয়ে ফিরে এল ফেলে আসা সেই দিনটি। *মা দুর্গার চোখ ফোটানো শেষ। মুখমণ্ডলটা শাদা কাপড়ে মোড়ানো। একটু পরই দেখা যাবে ষষ্টী পূজায়। বাল্যবন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে অধীর আগ্রহে চৈতন্য রবিদাসও মন্দিরের বারান্দায় ঢুকে গেল। সবার সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে চৈতন্য। মা দুর্গা দেবীর চরণে প্রণাম করতে যেই-না মাটিতে কপাল ঠুকল অমনি মন্দিরের পুরোহিত কান টেনে ধরে এক চড় বসাল।আর ধমকের পর ধমক- চামারের ঘরের চামার। ছোট লোকের বাচ্চা। দিলি তো মন্দিরটা অপবিত্র করে। বলতে বলতে কান ধরে টেনে হেঁচড়ে মন্দিরের বাইরে এনে আবারও কয়েকটা লাথি আর চড়-থাপ্পর বসালো। যা এখান থেকে চামারের বাচ্চা। আবার যদি দেখি পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। দিলি তো আমার কাজ বাড়িয়ে। আবার স্নান করে শুচি হতে হবে। - এই বলে পুরোহিত মহাশয় হাত দুটো মেলে ধরে রাখলেন যেন গায়ে না লাগে। আর হেলতে হেলতে দুলতে দুলতে যেন নৃত্য করে যাচ্ছেন। শিশু চৈতন্য রবিদাস হতবাক! একটা ঘোরের মধ্যে যেন ডুবে আছে। চড়-থাপ্পড়-লাথির আঘাত এখনও অনুভূত হচ্ছে না। আঘাত লেগেছে মনের ভেতর অন্তঃহীন গহীনে। যেখান থেকে কষ্টের আওয়াজ বাইরে আসতে মহাকাল পরাজিত হবে। পরাজিত হবে সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ সবই। অনেক বন্ধুই তো সাথে ছিল ওদেরকে তো কিছুই বলল না ! ওরা হিন্দু আমিও হিন্দু, তাহলে?আশেপাশে অনেকে ছিল কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। বরং পুরোহিতের সাথে সাথে কয়েকজন কন্ঠ মিলিয়ে বলল- চামারের বাচ্চার কত বড় সাহস, মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়ে! বন্ধুরাও কেউ কোন শব্দ করে নি। মনের দুঃখ-কষ্ট মনের ভেতর চেপে চুপচাপ চলে আসে চৈতন্য।*চৈতন্যদের বাড়িটা তাড়াইলের পুরাতন হাসপাতাল লাগোয়া মুচিপাড়ায়। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারের বসবাস। মা-বাবা গত হয়েছে অনেক আগেই। মা-বাবার কোন স্মৃতিই মনের ভেতর নেই। পুরোহিত এত মেরেছে অথচ কোন কান্না নেই। দু\'গালে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মনের অজান্তেই হাত বুলাচ্ছে আর ভাবছে- অন্য কাউকে কিছু বলল না। শুধু শুধু আমাকে মারল আর গালাগাল করল। আমি তো কোন খারাপ কাজ করি নি। ঘরেও তো পূজা হয়। প্রণাম করি। কাকা-কাকীমা তো আমাকে কোনদিন গালাগাল দেয় না?পুরাতন হাসপাতালের কোয়ার্টার সংলগ্ন সূতি নদী তীরে জাম তলায় চুপচাপ বসে আছে শিশু চৈতন্য রবিদাস।নদীর জলের ওপর চোখ। আঘাতপ্রাপ্ত ছোট্ট গালে হাত। মনের ভেতরটা এলোমেলো। ভাবনার জলে ডুবে আছে এই ছোট্ট শিশুটা। পিঠে হাতের একটু স্পর্শ পেতেই চৈতন্য ফিরে তাকায়। কিন্তু ভাষাহীন দৃষ্টি।কী ব্যাপার, এই দুপুর বেলা একা একা মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?- বলতে বলতে অসীম ওর পাশে বসে।অসীম হাসপাতালের ডাক্তারবাবু মোহন দত্তের ছেলে। অসীম চৈতন্যকে খুব আদর করে। কাছে পেলেই সবসময় কথা বলে। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে- চৈতন্য তোর মন খারাপ কেন?জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে- আচ্ছা অসীম\'দা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?বল, অবশ্যই দেবো।– বলে স্নেহের হাতে জড়িয়ে ধরে চৈতন্যকে।অনেক ভেবে-চিন্তে চৈতন্য বলে- আচ্ছা দাদা, তোমরা কোন ধরণের হিন্দু আর আমরা কোন ধরণের হিন্দু?প্রশ্নটা শুনে অসীমের বুকের ভেতরটা কেঁপেওঠে। এই প্রশ্নটা ওর মনের ভেতরেও দীর্ঘদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কোনদিন কাউকে বলাও হয় নি এবং উত্তরও নই। কারণ নিজেদের তো ভালোই চলছে। চৈতন্যের প্রশ্নে মনের ভেতর কঠোর বজ্রাঘাত হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- আমরা সবাই এক কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?একটু আগে বাজারের মম্দিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বিস্তারিত বলল চৈতন্য। বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল- অসীম\'দা আমরা কি শুধু নামেই হিন্দু? কোন মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবো না? তাহলে আমরা কোন ধরণের হিন্দু?- বলতে বলতে চৈতন্য ক্লান্ত হয়ে পড়ল।অসীম নির্বাক। ভাবনায় মশগুল। সত্যিই তো ওরা হিন্দু পরিচয়ে চলে অথচ অন্যসব হিন্দুদের সাথে চলাফেরা, ওঠাবসা নেই। ওরা যেন আধুনিক সমাজের হিন্দু নামে অন্য জগতের আলাদা বাসিন্দা। মনে আরও নানান রকমের প্রশ্ন জাগে ; ওরা যদি হিন্দুই হবে তবে আলাদা কেন? হিন্দু সমাজে গরু খাওয়া নিষেধ তবে গরুর চামড়ায় ওদের জীবিকা কেন? কেমন যেন একটা গোলক ধাঁধায় আবদ্ধ অসীম। ওরা দু\'জন পাশাপাশি চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে আছে। যেন সনাতনের গহ্বর থেকে ওঠে আসা হিন্দু ধর্মের দুই রাজসাক্ষী। নীরবতা ভেঙে চৈতন্য বলে- অসীম\'দা, তুমি সবসময় আমাকে বলো তোমার কাছে লেখাপড়া শিখতে।অসীম চৈতন্যের চোখে চোখ রাখে এবং আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আরও শোনার জন্য। এবং বলে- আয় তোকে আমি লেখাপড়া শিখাবো।ঠিক আছে দাদা, আমি তোমার কাছে লেখাপড়া শিখবো। কিন্তু এতে কী লাভ হবে বলতে পারো?- এই বলে চৈতন্য উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।লেখাপড়া করে আত্ম উন্নয়ন করবি, নিজের পাশাপাশি বিশ্বকে জানবি, চাকরি করবি। সমাজ, দেশ, ধর্ম, সম্মান, টাকা-পয়সা সবই তোর হাতের মুঠোয় থাকবে। সব কিছুতেই তোর সাধ্য মতো তুই বিচরণ করবি। কারও করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হবে না। সবাই তোকে সম্মান করবে।কিন্তু আমি যে মুচির ছেলে! চৈতন্যের সাথে সাথে অসীমেরও মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তারপর অসীম বিচক্ষণতার সাথে বলে- আগে লেখাপড়াটা শিখে নে। দেখবি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।বয়স অল্প হতে পারে কিন্তু বুদ্ধিমান চৈতন্য মনে মনে সব ছক করে ফেলে তৎক্ষণাৎ। তারপর বলে- ঠিক আছে অসীম\'দা, আজ বিকেল থেকেই আমি তোমার কাছে লেখাপড়া শিখতে শুরু করে দেবো।কথায় এবং কাজে চৈতন্য ওঠে পড়ে লাগে। প্রতিদিনই বিকেল বেলা সূতি নদীর তীরে জামতলায় দু\'জন বসে। অসীম খুব খুশী কারণ চৈতন্য বেশ বুদ্ধিমান এবং লেখাপড়াও খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে নিচ্ছে। এক বৎসরের মধ্যেই চৈতন্য চমৎকার লিখতে ও পড়তে শিখেছে। অংকটাও খুব ভালো পারে। তারপর চেয়ে চেয়ে বিভিন্ন বই নিয়ে পড়তে থাকে চৈতন্য। ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডঃ বাবাসাহেব ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের জীবনী পড়ে সত্যিই অভিভূত চৈতন্য রবিদাস। মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় অন্য এক জগতের নেশায়। মনের ভেতরটা যেন একটা স্থায়ী আবাসের তাড়নায় ছটফট করে সর্বক্ষণ। কিন্তু ওর নিজস্ব সমাজে এসেই ভাবান্তর ঘটে। অসীম\'দা ঠিকই বলে- প্রকৃত শিক্ষা হলো আলোর উজ্জ্বল শিখা। যা মনের ও জীবনের পথকে আলোকিত করে। এই যে মুচিপাড়ায় যত ঘর আছে কেউ কখনও লেখাপড়ার কথা ঘুনাক্ষুরেও চিন্তা করে না। শুধু চামড়া বানাও, জুতা সেলাও, মদ খাও আর শুয়োর মেরে খেয়ে-দেয়ে আনন্দ আর ফূর্তি কর। কাকাকে কতবার বুঝিয়েছে- মদ খাওয়া বন্ধ কর। একটু সভ্য হয়ে চলতে শেখো। কে শোনে কার কথা। আবার ভাবে- হয়ত মনের জ্বালা-যন্ত্রণা, ক্ষোভ ভুলে থাকার জন্য মদ খেয়ে মত্ত থাকে। হতে পারে অভিশপ্ত ক্লান্ত জীবনটাকে মদের নেশায় ডুবে তাড়িয়ে রাখা।*মনে মনে ছক কেটে চৈতন্য রবিদাস পাড়ি জমায় রাজধানী ঢাকার বুকে। যেখানে সবাই সবার আপন ভুবনে মশগুল। সাতঘাটের নাকানি-চুবানি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সুধীর\'দার ক্যান্টিনের ক্যান্টিন বয়। এখানের আলোময় জগৎটাই আলাদা। জাতের ভেদাভেদটা মনে হয় এখানে এসে কিছুটা হলেও থীতু হয়েছে। আলাপে আলাপে অনেকের সাথে পরিচয় এবং শেষে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজন দাদার সুবাধেই চাকুরীটা জুটিয়েছিল। অফিসের খাতায় নাম লিখে নেয় চৈতন্য কিশোর ভট্টাচার্য, বাবা : মৃত রাজ কিশোর ভট্টাচার্য, মাতা : অমিয়বালা ভট্টাচার্য। শুধু ঠিকানাটা পাল্টে দেয় আর সজ্ঞানে চলতি ভাষাটা সুন্দরভাবেই রপ্ত করে নিয়েছে আগেই। কথার বাচন-ভঙ্গীতে ওদের যে একটা নিজস্বতা আছে তা থেকে নিজেকে বের করে নেয়। উচ্চারণে আনে ঢাকার আধুনিক ও প্রমিত ভাষার স্থায়ী ছোঁয়া। তারপর কোম্পানীর মালিকের সুপারিশে একটা ব্যাচেলর রুমের খোঁজ পায় রায়ের বাজারে। সেই থেকে রায়ের বাজারেই বসবাস। অঞ্জলী দেবীর বাবা বিনয় বিহারী দেব রায়ের বাজারের গলির মুখে বসে কলা বিক্রয় করতো। সেখানে ক্রেতা হিসেবে পরিচয়। পরিচয় থেকে পারিবারিক সম্পর্ক। অতঃপর অঞ্জলী দেবীর সাথে পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে। অঞ্জলী দেবীর পিতা-মাতা গত হয়েছেন প্রায় বছর দুই হবে।সব তো ঠিকই ছিল। এখন চৈতন্য যেন সাগরের অতল গহীনে হাবুডুবু খাচ্ছে। কী করবে, কীভাবে দিন চালাবে, কোথায় যাবে, কার কাছে হাত পাতবে ; সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে চিন্তার রেখা সমান্তরাল চলছেই। কিন্তু চৈতন্য হার মানতে নারাজ। উঠে দাঁড়াতে হবেই। মনে মনে শিরদাঁড়া শক্ত করে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ রাজ্যের অন্ধকার এসে ভর করে। কারণ এই জগৎ সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। যারা আছেন তারা সবাই অন্ধকারে ডুবে থাকা জীবন্মৃত মানুষ। ওদের কাছে জীবনের কোন মানে নেই। ভাগ্যের হাতে জীবন সপে দিয়ে নিরুপায় হরিণীর মতো বাঘের থাবায় ছটফট করছে প্রতিনিয়ত। চৈতন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ; আমি হারবো না। আমি লাথি মেরে সনাতন অচলায়তন ভেঙে তবে এগিয়ে যাবো। যুদ্ধে আমি হারতে নামিনি!*অঞ্জলী দেবীর ডাকে মগ্নতা ভাঙে চৈতন্যের। স্বামীর পিঠে হাত রেখে কানে কানে বলেন- শোন, আমার কাছে জমানো টাকা আছে। কোন চিন্তা করো না।অবাক নয়নে স্ত্রীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন চৈতন্য। চোখ জোড়া আনন্দে ছলছল করে ওঠে। তারপর আনন্দের উচ্ছ্বলতায় আঁকড়ে ধরে স্ত্রীর হাত। তুমি সত্যি বলছো?- এখনও ঘোর কাটেনি চৈতন্যের।স্ত্রীর সোহাগ মাখা কন্ঠ- হ্যাঁ গো, আমি সবসময় তোমার দেয়া মাসিক খরচ থেকে জমিয়ে রেখেছি। একটা ডিপিএসও করেছি ব্যাংকে। দু\'মাস পরই পাকা হবে। আমার হাতেও নগদ আছে। এসো আমার সাথে। - এই বলে স্বামীকে টেনে গোপন জায়গা থেকে খুঁজে দেখান এবং বলেন- এখনও এই ড্রামে এক মাসের চাল মজুত আছে। তুমি শান্ত হও। স্নান সেরে খেয়ে নাও। তারপর চিন্তা-ভাবনা করো, কী করবে। কোন দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই।চৈতন্যের দু\'চোখ বেয়ে ভালোবাসার জল গড়িয়ে পড়ে। এই জল কান্নার বা দুঃখের নয়, আনন্দের। জীবন যুদ্ধে নামা সৈনিকের যুদ্ধের রসদ। যুদ্ধে হারলে চলবে না। যেভাবেই হোক জিততে হবে। পাশেই ছেলে-মেয়ে বসা। এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে মা-বাবার কথা শুনছিল। দৃষ্টি পড়তেই চৈতন্য সন্তানদের জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেন।মেয়ে সুনন্দা কিশোরী কাঁদতে কাঁদতে বলে- বাবা, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?না মামণি, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন!তাহলে কাঁদছো কেন?আনন্দে কাঁদছি মা।আনন্দে আবার কেউ কাঁদে?হ্যাঁ মা। মানুষ আনন্দেও কাঁদে।মেয়ে সুনন্দা কিশোরী মায়ের দিকে তাকায়। মা অঞ্জলী দেবী এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলেন- হ্যাঁ মা, মানুষের এমনটা হয়।দুপুরের খাওয়া শেষে ছেলে-মেয়ে চৌকির ওপর বিশ্রামে গেল। কারণ এখন ঘর থেকে বের হওয়া একদম নিষেধ। দুই ভাই-বোনের জন্য মা অনেকগুলো খেলনা এনে দিয়েছেন। আবার বাবা চৈতন্য একটি খেলা শিখিয়ে দিয়েছেন; বাংলা এবং ইংরেজী শব্দের খেলা। দুই ভাই-বোন শব্দের খেলাটায় দারুণ মেতে থাকে। চৈতন্য মহাখুশী কারণ এতে ওদের আনন্দ হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষাটাও পোক্ত হচ্ছে। এখন এই করোনায় আবদ্ধ সময়ে শব্দের খেলাতেই ওরা মেতে থাকে। নীচে মাদুর পেতে অঞ্জলী দেবী আর চৈতন্য জীবনের চলার পথের হিসাব করছে। অঞ্জলী দেবী তার জমানো টাকার কাপড়ের পুটুলিটা বের করলেন। আর চলতি মাসের দেয়া পুরো বারো হাজার টাকা। চৈতন্যের হাতজোড়া আনন্দ আর খুশীর উত্তাপে যেন অবশ হয়ে আসছে। এক দৃষ্টে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।প্রথমে অঞ্জলী দেবী ক্ষীণ কন্ঠে কথা বলেন- এই নাও এখানে চলতি মাসের পুরোটাই আছে। এখনও ধরিনি।বেতনের টাকাটা আলাদা করলেন। তারপর দু\'জনে মিলে পুটুলিতে রাখা টাকাগুলো গুণলেন। প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা ।নিজেকে সামলাতে না পেরে চৈতন্য বলেই ফেললেন- এত টাকা কীভাবে জমালে!ঠোঁটে একটা আঙুল আঁড়াআড়ি করে ফেলে স্বামীকে সাবধান করে বললেন- আস্তে কথা বলো। দেয়ালেরও কান আছে। এখন খারাপ সময়। সাবধানে থাকা ভালো। আমি অনেক আগে থেকেই সবসময় একটু একটু করে জমাচ্ছি। তুমি বাঁচালে আমাকে। ডুবতে থাকা এই আমাকে তুমি উদ্ধার করলে।– চৈতন্যের চোখ জোড়া ছলছল করছে। এই বুঝি কান্নার জল উপচে পড়বে।অঞ্জলী দেবী কপট রাগ দেখিয়ে চোখে চোখ রেখে শাসন করলেন এবং বললেন- সব আমাদের নিজেদের জন্য। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে।ঠিক বলেছো। একদম আমার মনের কথা। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রথমে দরকার শিক্ষা। আর পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা। তুমি চিন্তা করো না। তোমার এই বাড়িয়ে দেয়া হাত আমি সভ্যতার প্রাচীরে ঠুকে দেবো। আমি পারি, আমরা পারি।– এই বলে চৈতন্য আনন্দের জোয়ারে ভাসতে লাগলেন।সাবধানী উচ্চারণ স্ত্রী অঞ্জলী দেবীর- শোন, যা\'ই করো খুব চিন্তা-ভাবনা করে তবে করবে। যদি মনে কিছু না করো, তবে আমার সাথে আলোচনা করে করবে। কি ঠিক আছে?অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই আমার মহারাণী। লাজুক হাসি হেসে অঞ্জলী দেবী বলেন- বাচ্চারা আছে!*ছোট্ট ঘর। ছোট্ট সংসার। বিন্দু বিন্দু, ছোট ছোট সুখ ক্রমশঃ জমা হচ্ছে। বেড়ে ওঠছে পুষ্ট হয়ে চৈতন্যের মন-বাগানের ডালপালা। মনের বাগানে পাখ-পাখালির উড়াউড়ি বাড়ছে শান্ত হাওয়ার তালে তালে। সুখের বাগানে চৈতন্য এক সদা জাগ্রত পাখি। সংসার নামের বৃক্ষটাকে পরিপক্ক করা এখন পরমব্রত। তারপর বৃক্ষের ডালে শক্ত-মজবুত এক বাগানবাড়ি হবে। যেখানে সনাতন অচলায়তনের ছায়ার কোন রেখাপাত হবে না। সব ডিঙিয়ে সভ্যতার মানব সমাজে সমানতালে বসবাসে নিঃশ্বাস ফেলার সংস্থান করা। যে সমাজ ধর্মের নামে তৈরি করেছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অচলায়তন। যেখানে জেনে-শুনে ধর্মের চোখে ঠুলি পরিয়ে মানুষের পায়ে শিকল বেঁড়ি বেঁধে ছুটছে অনবরত। ভগবানকে টেনে হিঁচড়ে ইচ্ছে মতো নামিয়ে আনা হয়েছে মহাপুরুষের ছায়াতলে। নেই ভেদাভেদ ভগবান, অবতার, দেব-দেবী, মুনি-ঋষি আর মহাপুরুষের মাঝে ; সবাই মিলে মিশে একাকার। শুধুই মানুষের মাঝে ইচ্ছের সূতোয় গেঁথে দিয়েছে বর্ণ নামের এক সোনার হরিণ। জন্মিলেই যদি ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ হবে তবে কেন দীক্ষার প্রয়োজন। কেন-ই বা ভগবান একেকজন ব্রাহ্মণের গলায় পৈতা পরিয়ে এই ধরায় পাঠান না। ধর্ম আসেনি পৃথিবীর বুকে মানুষের পদার্পণের আগে। আসেনি বর্ণপ্রথা সমাজ গঠনের আগে। কিন্তু ঝুলছে এখনও বর্ণপ্রথা নামের বিষবাষ্প সনাতনের প্রতিটি ঘরে। যে বর্ণের কালো ছাপের যাঁতাকলের অনন্তকালের যন্ত্রণা এই চৈতন্য টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। সে এখন অনড়, অটল ভাঙবে দেয়াল বর্ণবাদের কালো থাবা। ব্রাহ্মণ যদি ব্রাহ্মণই না-হয় তবে কেন মিছিমিছি এই ধর্ম খেলা। তাই তো এই চৈতন্য অর্জন করে নিয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান। যাকে বলে প্রকৃত ব্রাহ্মণ। মানছে না আজ, মানতে হবে এমনই ব্রাহ্মণের পুনঃপ্রবর্তন। হয়েছে শুরু, চলছে পূজো ব্রহ্মজ্ঞানের অর্জিত ব্রাহ্মণের ছোঁয়ায়। আসবে আলো জ্বলবে ভুবন, আলোর ঝর্ণা ধারায়। মূর্খ মানুষ সাজবে না আর ব্রাহ্মণ নামে পৈতা ধরে।– ভাবের ঘোরে ভাবতে ভাবতে চৈতন্য একটু দিশেহারা।এখনও তোমার চিন্তা শেষ হয়নি?- অঞ্জলী দেবী স্বামীর পিঠে ভালোবাসার হাতটুকু রেখে চোখে চোখ রাখে।না, আর চিন্তা করছি না। ভাবছি, কোথা থেকে কীভাবে শুরু করবো।এক কাজ কর, ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতে পারো।মন্দ বলোনি। তবুও আমি ভাবছি। ভালো একটা কিছু করা যায় কি না। তবে যা\'ই করি না কেন, খুব ভেবে-চিন্তে করবো ।ঠিক আছে, তুমি যা ভালো মনে করো সেটাই করো। কিন্তু শুরু করার আগে আমার সাথে আলোচনা করে নিও।ঠিক আছে। ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। তারপর চৈতন্য মনে মনে ভাবে আর হিসেব করে- বারো হাজার, পঁচিশ হাজার আর চল্লিশ হাজার । সব মিলিয়ে প্রায় সাতাত্তুর হাজার।– একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ভবিষ্যতের বুকে পা বাড়ায় চৈতন্য। শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা আর অর্থ, অর্থ, অর্থ – তবেই শক্তি অর্জন সব দেয়াল ভাঙার। একটু একটু করে এগোতে হবে। গড়তে হবে শক্ত ভীত। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ায় কোন ব্যঘাত ঘটানো যাবেনা। ভাবতে ভাবতে ভাত ঘুমের রাজ্যে ডুবে যায় চৈতন্য। অঞ্জলী দেবীও চুপচাপ স্বামীরপাশে শুয়ে থাকে। আর আপন মনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন এবং ভাবেন- মানুষটা খুবই ভালো। পুরো শরীর-মন জুড়ে মায়া-মমতা আর ভালোবাসায় ভরা। মনটা আকাশের মতো পরিষ্কার। সংসারের প্রতিটি কোণ মমতায় আগলে রেখেছেন। কথায় কথায় ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার সুপ্ত হাওয়া। সুশৃঙ্খল জীবনই পছন্দের তালিকায়। অগাধ ধর্মজ্ঞান। সব পূজা অনায়াসে করতে পারেন ; সব মন্ত্র মুখস্থ। পূজার সময় হলেই অনেকে এসে জোর করে নিয়ে যায়। সে পূজা-কর্ম সেরে দেন কিন্তু বিনিময়ে কোন অর্থ নেন না। অনেকে অবশ্য জোর করে টাকা পকেটে গুজে দেয়। কে কত টাকা দেয় তা কখনও গুণে দেখেন না চৈতন্য। এসে সরাসরি স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। বয়সে বড় কারও প্রণাম গ্রহণ করেন না। আরও কতগুণ ! স্বামী চৈতন্য কিশোর ভট্টাচার্য সবসময় কেমন যেন চিন্তামগ্ন থাকেন । কখনও প্রাণ খুলে হাসেন না। কিন্তু আজ স্বামীর চোখে-মুখে সুখের ও খুশীর বন্যা দেখেছেন। অঞ্জলী দেবীর মনটা ভরে যায়। হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে ঘুমন্ত স্বামীর বুকে রাখেন। তারপর চোখ বুঁজে আসে। হারিয়ে যান জীবন রণাঙ্গনে চৈতন্যের সৈনিক হয়ে। স্বামীর বুকে আঁড়াআড়ি করে রাখা স্ত্রীর হাতটা মনে হচ্ছে ধারলো তলোয়ার। আর ইশারায় বলছেন যেন, তুমি এগিয়ে যাও। যত বাঁধা বিপত্তি আসবে আসুক, কেটে টুকরো টুকরো করে, ধূলিস্যাৎ করে এগিয়ে যাও। আমি আছি তোমার সাথে। চৈতন্য যেন অতল গহীনের এক প্রবল যোদ্ধা-সৈনিক। যে নিমেষে ভেঙে দিতে পারে সকল রণকৌশল। এগিয়ে যেতে যেতে ভেঙে দেবে সকল বাঁধা। এগিয়ে যাবে সুভবিষ্যতের পথে। অঞ্জলী দেবীও স্বামীর সঙ্গে ঘুমের কোলে নিমগ্ন হয়ে হারিয়ে গেলেন।শেষ
স্বামী চৈতন্য কিশোর ভট্টাচার্য সবসময় কেমন যেন চিন্তামগ্ন থাকেন । কখনও প্রাণ খুলে হাসেন না। কিন্তু আজ স্বামীর চোখে-মুখে সুখের ও খুশীর বন্যা দেখেছেন। অঞ্জলী দেবীর মনটা ভরে যায়। হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে ঘুমন্ত স্বামীর বুকে রাখেন। তারপর চোখ বুঁজে আসে। হারিয়ে যান জীবন রণাঙ্গনে চৈতন্যের সৈনিক হয়ে। স্বামীর বুকে আঁড়াআড়ি করে রাখা স্ত্রীর হাতটা মনে হচ্ছে ধারলো তলোয়ার। আর ইশারায় বলছেন যেন, তুমি এগিয়ে যাও। যত বাঁধা বিপত্তি আসবে আসুক, কেটে টুকরো টুকরো করে, ধূলিস্যাৎ করে এগিয়ে যাও। আমি আছি তোমার সাথে। চৈতন্য যেন অতল গহীনের এক প্রবল যোদ্ধা-সৈনিক। যে নিমেষে ভেঙে দিতে পারে সকল রণকৌশল। এগিয়ে যেতে যেতে ভেঙে দেবে সকল বাঁধা। এগিয়ে যাবে সুভবিষ্যতের পথে। অঞ্জলী দেবীও স্বামীর সঙ্গে ঘুমের কোলে নিমগ্ন হয়ে হারিয়ে গেলেন।
0 Comments