সময় পথিকের গন্তব্য– মো. শিয়াবুজ্জামান চঞ্চলশহরের এক প্রান্তে, ভাঙা ইট-পাথরের এক পুরনো বাড়িতে একা থাকত রনি। কলেজপড়ুয়া এই তরুণের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, কিন্তু কল্পনায় ভরা। বইয়ের পাতা ছিল তার বিশ্বভ্রমণের টিকিট, বিশেষত ইতিহাসের বইগুলো। প্রাচীন সভ্যতা, রাজ্য পতনের কাহিনি, বীরদের আত্মত্যাগ—সব কিছু যেন তাকে টানত অতীতের দিকে।একদিন, রাতে অনলাইনে পুরনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে রনি একটি রহস্যময় ডায়েরির বিজ্ঞাপন দেখতে পেল। ডায়েরির মলাটে লেখা ছিল, “সময়ের পথে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা লিখে রাখো।” কৌতূহলী হয়ে সে মুহূর্তেই সেটি কিনে ফেলে।ডায়েরিটি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রনি লক্ষ্য করল—এর কাগজগুলো খুব পুরনো, যেন শতাব্দী পেরোনো। ঢাকনার গায়ে অদ্ভুত এক নকশা, ঠিক যেন ঘড়ির কাঁটার মতো ঘূর্ণায়মান প্রতীক। প্রথম পাতায় লেখা ছিল: “যখন তুমি প্রথম পাতা উল্টাবে, তখন তুমি সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে যাবে।”রনি অবিশ্বাসের হাসি হেসে পাতা উল্টাল। হঠাৎ চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, ঘরের দেয়াল ঝাপসা হয়ে গেল, আর একঝলক আলোয় সবকিছু ডুবে গেল। সে চোখ খুলে দেখল—সে আর নিজের ঘরে নেই।সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল রাজপ্রাসাদের প্রবেশপথে। চারপাশে উজ্জ্বল রঙের পোশাকে সজ্জিত মানুষজন, বাদ্যযন্ত্রের শব্দ, হর্ষধ্বনি—সব মিলিয়ে এক রাজউৎসব চলছে। সে চমকে উঠল। এটা যেন কোনো প্রাচীন রাজ্য। কৌতূহলী হয়ে সামনে এগোতেই এক রাজপুত্র তার কাছে এসে দাঁড়াল। সে বলল, “তুমি কি সেই পথিক, যে সময় পেরিয়ে আমাদের রাজ্যে এসেছে?”রনি ধীরে মাথা নাড়ল। “আমি ইতিহাস জানতে এসেছি,” তার কণ্ঠে ছিল মৃদু কম্পন। রাজপুত্র তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানে রাজকুমারী, সভাসদ, সৈন্যপ্রধান—সবার সঙ্গেই পরিচয় হল তার। রাজপুত্র তাকে জানাল, তাদের রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে এক ধর্মীয় মতবিরোধ চলছিল, যার ফলে দেশে অস্থিরতা, যুদ্ধ ও রক্তপাত বেড়েই চলেছে।রনি বিস্মিত হয়ে শুনছিল সব। তার হৃদয়ে প্রশ্ন জাগল—এটা কি কেবল কল্পনা? সে কি সত্যিই অতীতে এসে পড়েছে?রাতে একাকী ঘরে বসে ডায়েরির দ্বিতীয় পাতাটি খুলে দেখল। সেখানে লেখা, “যদি তুমি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করো, তাহলে পৃথিবী তোমাকে ঘরে ফিরাবে না।”এই কথাগুলো পড়েই তার হৃদয় কেঁপে উঠল। সে কি তাহলে ফেঁসে গেল? পরিবর্তন আনার আকাঙ্ক্ষা কি তাকে চিরতরে এই পৃথিবীতেই আটকে রাখবে?কিন্তু রনি থামল না। সে রাজপুত্র ও রাজকুমারীর সঙ্গে সময় কাটাতে লাগল, তাদের সাহস ও বেদনার গল্প শুনতে লাগল। একদিন রাজকুমারীকে বলল, “যুদ্ধ বন্ধ না হলে এই রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনারা যদি শান্তির কথা বলেন, তবে সাধারণ মানুষও আপনাদের অনুসরণ করবে।”রাজকুমারী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তুমি ঠিক বলেছো। একজন বহিরাগত হয়েও তুমি আমাদের চোখ খুলে দিলে। তবে আমাদের এক হতে হবে।”রনি গ্রাম থেকে শহর, মন্দির থেকে বাজার—সর্বত্র গিয়ে শান্তির বার্তা দিতে লাগল। প্রথমে অনেকে অবিশ্বাস করলেও, ধীরে ধীরে তার কথায় সাড়া দিতে লাগল মানুষ। রাজপুত্র নিজেই একটি শান্তিচুক্তির ঘোষণা দিলেন।সময় কেটে গেল। একদিন রনি ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লিখল, “আমি এই রাজ্যে পরিবর্তন আনতে পেরেছি। ইতিহাসে আমার চিহ্ন রয়ে যাবে না হয়ত, কিন্তু এখানে শান্তি ফিরেছে—এটাই বড় প্রাপ্তি।”তৎক্ষণাৎ চারপাশে সেই আলো জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই সে ফিরে এল নিজের ঘরে।রনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সে আবার নিজের পুরনো ঘরেই। কিন্তু তার হাতে এখনও সেই ডায়েরি। এখন সেটা নিঃসন্দেহে তার জীবনের অংশ। সে জানে—সময়ের পথিক হয়ে সে ফিরে এসেছে, কিন্তু ফিরে আসেনি আগের মতো। সময় তাকে সাহসী করে তুলেছে, চিন্তার গভীরতা দিয়েছে।রনি আবার ডায়েরিটি খুলে নতুন পৃষ্ঠায় লিখতে শুরু করল। কারণ, হয়ত সামনে আরও এক যাত্রা অপেক্ষা করছে...
“সময় পথিকের গন্তব্য” গল্পে এক কলেজছাত্র রনি ইতিহাসের প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে এক রহস্যময় ডায়েরি কিনে ফেলে। ডায়েরির নির্দেশ অনুসরণ করে সে হঠাৎ সময় ভেদ করে পৌঁছে যায় এক প্রাচীন রাজ্যে, যেখানে যুদ্ধ, বিভাজন ও অস্থিরতা চলছে। রনি প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও ধীরে ধীরে রাজপুত্র ও রাজকুমারীর সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে এবং শান্তির আহ্বান জানায়। তার প্রচেষ্টায় রাজ্যে শান্তির সূচনা হয়। কিন্তু একটি সতর্কবার্তা তাকে জানিয়ে দেয়—পরিবর্তন আনলে হয়ত সে আর ফিরে যেতে পারবে না। তবুও রনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যায় না। শেষ পর্যন্ত, সে সময়ের গহ্বর পেরিয়ে ফিরে আসে নিজের ঘরে। ডায়েরি হাতে নিয়ে সে বুঝে যায়—এই ভ্রমণ শুধু ইতিহাস জানা নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক সাহসিক অভিযান। গল্পটি কল্পবিজ্ঞান, ইতিহাস ও মানবিক মূল্যবোধের মিশেলে সময়ভ্রমণের এক আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় কাহিনী।
ভালো লাগল গল্পটা
ধন্যবাদ