ফেনী জেলার ছনবাড়িয়া ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে একটা ছোট গ্রাম — ঘন সবুজ গাছ, কাঁচা রাস্তা, আর কাদা-পানিতে ভরা বর্ষার মৌসুম।সেই গ্রামেরই মাটির ঘরে জন্মেছিল এক মেয়ে — নাম **মায়া**।মায়া জন্মেছিল দারিদ্র্যের মাঝে,কিন্তু তার চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলো।বাবা মজনু মিয়া ছিল দিনমজুর, মা সালমা বেগম গৃহিণী।তারা স্বপ্ন দেখেছিল — একদিন মায়া পড়াশোনা করবে, মানুষ হবে,কিন্তু সমাজের চোখে তা ছিল অন্যরকম পাপ।প্রতিবেশীরা বলত,“গরিবের মেয়েকে পড়িয়ে কী হবে? বিয়েই তো দিতে হবে!”বাবা চুপ করে থাকতেন।মা মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন,“তুই মন দিয়ে পড়, মা। গরিব মানুষ যদি কষ্ট না সহে, তাহলে বাঁচে কেমনে?” মায়া প্রতিদিন সকালবেলা পা খালি করে দেড় কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেত।ফাটা ব্যাগ, ছেঁড়া জামা, কিন্তু মুখে হাসি।স্কুলের মেয়েরা ফিসফিস করে বলত,“দেখছিস? গরিবের মেয়ে কেমন সাজে স্কুলে আসে!”ছেলেরা হাসাহাসি করত,আর শিক্ষকরা অনেক সময় দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়ে দিত —“এই মেয়েটা কেন এত জেদী?”তবু মায়া পড়ত।কারণ সে জানত — **গরিবের একমাত্র অস্ত্র হলো শিক্ষা।**একদিন ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন,“তোমাদের স্বপ্ন কী?”সবাই বলল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ…মায়া শান্তভাবে বলল,“আমি শিক্ষক হতে চাই, যাতে গরিব মেয়েরা ভয় না পায় স্কুলে আসতে।”ক্লাসে হাসির শব্দ উঠল।কেউ বলল,“তুই আগে নিজের জামাটা ঠিক কর!”সেদিন প্রথমবার মায়ার চোখে জল এল, কিন্তু সে কাঁদল না।মনে মনে বলল,“একদিন দেখাবো, মেয়েরা কাঁদতে না, লড়তেও জানে।” মায়া যখন ক্লাস এইটে, তখনই একদিন পথে ফেরার সময় কিছু ছেলেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,“এই মায়া, তুই এত বড় হচ্ছিস, একটু হাসবি না?”মায়া কিছু বলল না, দ্রুত হেঁটে চলে গেল।কিন্তু পরদিন সকালেই ইউনিয়নের লোকেরা বলল,“ওই মেয়েটা রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে দেখা গেছে!”এক মুহূর্তে বদলে গেলো গ্রামের দৃষ্টিভঙ্গি।যে মেয়েটা প্রতিদিন স্কুলে যেত,সে এখন “খারাপ মেয়ে।”বাবা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,“মায়া, আমি কসম খাই, তুই কি কিছু করেছিস?”মায়া ফেটে কাঁদল,“বাবা, আমি শুধু হেঁটেছিলাম, কিছু না!”কিন্তু সমাজের কান কোনো মেয়ের কান্না শুনে না। মায়া তখনও স্কুল ছাড়েনি।যারা পেছনে কথা বলত, তাদের উপেক্ষা করে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়ত।কিন্তু প্রতিটি পা ফেলতে ফেলতে সে শুনত —“ওই দেখ, পাপের মেয়ে যাচ্ছে।”ক্লাসের বন্ধুরা তাকে এড়িয়ে চলত।শিক্ষকও একদিন বলেছিলেন,“তুই চুপচাপ থাক মায়া, তোর নাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।”মায়া চুপ করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল।তার চোখে শুধু আগুন জ্বলছিল।একদিন মা বললেন,“মা, সমাজ বড় নিষ্ঠুর। তুই কষ্ট পাস না।”মায়া বলল,“আমি কাঁদব না মা। আমি শুধু প্রমাণ করব, মেয়েরা অপরাধী না — সমাজ অপরাধী।” স্কুল শেষ করে মায়া কলেজে ভর্তি হলো ইউনিয়ন বাজারের কাছে।সেখানে পরিচয় হলো এক ছেলের সঙ্গে — নাম সোহেল।সোহেল মায়াকে সম্মান করত, সাহস দিত।কিন্তু সমাজ আবার কথা তুলল,“মায়ার আবার প্রেম শুরু!”একদিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পর্যন্ত ডেকে পাঠালেন।সবাই সামনে বসে বলল,“এই মেয়েটা সমাজের মান নামাচ্ছে, ওর পড়া বন্ধ করা দরকার।”মায়া দাঁড়িয়ে বলল,“চেয়ারম্যান সাহেব, আমি প্রেম করি নাই। আমি পড়তে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এটা কি অন্যায়?”সবার চোখ নিচু হয়ে গেল,কিন্তু তারপরও মায়াকে কলেজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।কারণ — “সমাজের শান্তি রক্ষার জন্য।” মায়া কাঁদতে কাঁদতে একদিন বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেল।একটা পোশাক কারখানায় কাজ পেল।দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ, রাতে ছোট্ট ঘরে নিঃশব্দ কান্না।তবুও সে লিখত —“আমি হারিনি। আমি কষ্টে আছি, কিন্তু আমি জীবিত।”একদিন ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগল।অনেকে দৌড়ালো, মায়া পেছনে পড়ে গেল এক মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে।সেই দিনই খবরের কাগজে এল শিরোনাম —**“ফেনীর মেয়ের সাহসিকতা: নিজের প্রাণ দিয়ে অন্যকে বাঁচাল।”** পরের সপ্তাহে ছনবাড়িয়া ইউনিয়নে খোলা হলো নতুন স্কুল —“**মায়া স্মৃতি বিদ্যালয়**”।চেয়ারম্যান নিজেই বললেন,“আমরা ভুল করেছি।যে মেয়েকে আমরা সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, সে প্রমাণ করেছে —চরিত্র মুখে না, কাজে।”গ্রামের মেয়েরা এখন স্কুলে যায়,আর মায়ার গল্প শোনে কান্না চেপে। রাতে ইউনিয়নের মাঠে বাতাস বইছিল।এক বয়স্ক মানুষ চুপ করে বলল,“আমরা মেয়েদের দোষ দেই, কিন্তু আসলে দোষ আমাদের চোখে।আমরা চোখ বন্ধ করে রাখি, তারপর বলি — আলো নেই।” 🌧️ সমাপ্তি**“সমাজের অবহেলা”** শুধু মায়ার গল্প না,এটা আমাদের প্রতিদিনের গ্রামের গল্প —যেখানে মেয়েদের কণ্ঠ আজও ভয় পায়,কিন্তু এক মায়া বারবার জন্ম নেয়,যে কষ্টকে জয় করে দেখিয়ে দেয়,“মানুষের মূল্য পোশাকে নয়, আত্মসম্মানে।”
“সমাজের অবহেলা” একটি হৃদয়বিদারক বাস্তব কাহিনি —যেখানে এক দরিদ্র মেয়ের জীবনের প্রতিটি দিন ভরে আছে সমাজের তাচ্ছিল্য, কটূ কথা, আর অবহেলায়।তার নাম সুরভি — ছোট এক ইউনিয়নের মেয়ে, যার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নিজ পায়ে দাঁড়ানো।কিন্তু সমাজ কখনো তাকে সুযোগ দেয়নি, বরং প্রতিদিন তাকে ছোট করেছে তার দরিদ্রতা, পোশাক, স্বপ্ন, এমনকি ভালোবাসার জন্যও।গল্পটি শুধু সুরভির নয় — এটি আমাদের চারপাশের অসংখ্য মেয়ের কণ্ঠস্বর,যাদের কষ্ট কেউ শোনে না, যাদের চোখের পানি মাটির নিচে মিশে যায় নীরবে।“সমাজের অবহেলা” পড়লে তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে —আমরা কি সত্যিই মানুষ, যদি এখনো এক জীবন্ত স্বপ্নকে সমাজের নাম করে মেরে ফেলি?এটি এক অতি বাস্তব, মন ছুঁয়ে যাওয়া কষ্টের গল্প,যা পড়ে পাঠকের বুক ভার হয়ে যাবে, কিন্তু চোখে জেগে উঠবে এক নিঃশব্দ আলো — পরিবর্তনের আশায়।
0 Comments