
মায়ের আদর না পাওয়া একটা মেয়ে,দাদীকেই সারাজীবন মা হিসেবে জেনেছে।কিন্তু একটা সময়ে যখন দেখলো তার দাদীই এই অবস্থার জন্য দায়ী।তখন পৃথিবী তার কাছে বিভীষিকাময় হয়ে গেলো
আমি সায়মা। দাদীর কাছেই মানুষ।ছোট্টবেলায় বাবা মাকে পরকীয়ার অভিযোগে ছেড়ে দেয়, তারপর তিনি আবার বিয়ে করে। বাবা তার ওয়াইফ নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে। আমি মা, বাবা সব বলতেই দাদীকে জানি। মায়ের চেহারা আমার মনে পড়েনা,তবে প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি মা আমার মতোই সুন্দরী ছিলো। এইটুকুন শুনলেই আমি চলে আসি,এই ব্যাক্তি সম্পর্কে আমার আর শুনার ইচ্ছা জাগেনা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে দাদীকে বলি সব বান্ধবীরা ঢাকাতে ভার্সিটির জন্য কোচিং করবো আমিও করতে চাই।দাদী কিছুতেই রাজী না,ওখানে গেলে আমি নাকি খারাপ হয়ে যাবো। আমি কি খাচ্ছি,কি করতেছি দাদী দেখবেনা। অনেক বুঝানোর পর দাদী রাজী হলো,জুন মাসের ২৩ তারিখ আমি পড়ালেখার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ি। গাড়িতে উঠার পর হঠাৎ আমি নাড়ির টান অনুভব করি।নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল। নতুন শহর,নতুন পরিবেশ। সবকিছু মানিয়ে উঠতে একটু সময় লাগলো। দাদীকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করি কি রান্না কিভাবে করবো,উনি ফোনে ওপাশ থেকে হাসে। এক পর্যায়ে উনি আমার জন্য কান্না করে দেয়।আমাকে জিজ্ঞেস করে কবে যাবো।আমি স্বান্তনা দিই পরীক্ষা শেষ হলেই যাবো। হঠাৎ একদিন মনে হলো বাবার বাসায় যাই। মনের খেয়ালে গেলামও।একজন বাবা আর মেয়ের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হয় আমি জানিনা। উনি মাস শেষে আমাদের খরচ পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন।কখনো মন চাইলে দেখতে যেতেন। কলিংবেলে চাপ দেয়ার পর ফুটফুটে সুন্দর চেহারার একটা ছেলে দরজা খুললো। কাকে চাই জিজ্ঞেস করাতে বললাম আনোয়ার সাহেব বাসায় আছেন? ও বাবা বলে ডাক দিলো,বুঝলাম ও আমারই ভাই। হঠাৎ কেন জানি স্নেহে আমার বুকটা ভরে গেলো।জড়িয়ে ধরার অধিকার আমার নেই,তাই আর অগ্রাধিকার খাটালাম না। ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে দিলাম। বাবা আমাকে দেখে অবাকই হলো,আমার সৎ মা আমাকে খুব যত্ন করে খাওয়ালো। হঠাৎ দেখলাম আমার ভাই বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসলো,আমি আর ওখানে বসতে পারলাম না। সবচাইতে অবাক করার বিষয় আমি ওনাকে একবারও বাবা বলে ডাকিনি। আসার সময় আমার হাতে বাবা কিছু টাকা দিলো,আর বাসার এড্রেসটা জেনে নিলো। বাসায় এসে দাদীকে ফোনে বললাম সব কথা।দাদী আমার উপর খুব রেগে গেলেন।রেগে যাওয়ার কারণ আমি বুঝিনি সেদিন। তবে আর একদিন বুঝে ছিলাম। এরপর প্রায় অনেকদিন কেটে গেলো, আমিও একে একে এডমিশন পরীক্ষা শেষ করলাম।জাহাঙ্গীর নগরে চান্স হলো।এইবার বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ি ফিরবো ফিরবো সময় এসেছে,দাদী আমার জন্য আচার করে রেখেছে,পিঠা বানানোর জন্য সব জোগাড় করে রাখছে। হঠাৎ একদিন হোস্টেল এর নিচে এসে বাবা ফোন করলো। আমিও নিচে গেলাম,আমাকে বললো আমার সাথে কথা আছে। আমরা একটা কফিশপে বসলাম, ইতস্তত লাগছিলো খুব।বাবা কেন জানি সেদিন কিছু বলতে পারলোনা।জিজ্ঞেস করাতে বললো কথা আছে না বললে আমি আসতাম না। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব। আমার খুব হাসি আসলো। ওনাকে বললাম যে জন্মদাতা পিতা বছরে একবার যেতে কষ্ট হতো,তার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে ব্যাপারটা হাস্যকর।উনি চুপ করে রইলেন।তারপর উনি আমার সাথে অনেক যোগাযোগ করতে চাইলেন আমি ধরা দিলাম না। একদিন বাবার ওয়াইফ আমার হোস্টেলে এলেন,আমি ভদ্রতার খাতিরে ওনাকে বসতে বললেন। নাহ ওনার উপর আমার কোনো রাগ নেই। বাবা চাইলেই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারতেন ওনাকে দেখে আমি তা বুঝলাম। উনি আমার জন্য নানারকম খাবার রান্না করে আনলেন। নিজে বসে থেকে খাওয়ালেন। মায়ের আদর কেমন আমি তা জানিনা,কিন্তু ওনার মধ্যে আমি এক মুহূর্তের জন্য মমতাময়ী মা কে খুঁজে ফেলেন। তারপর উনি আমাকে বললেন আজকে উনি আমাকে এমন কিছু কথা বলতে চায় যেগুলো আমার শুনা জরুরি। আমি জানতে চাইলাম কি কথা? - আমি জানি মা, তোমার বাবার উপর তোমার খুব রাগ।রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনি পিতা হিসেবে কোনো দায়িত্বই পালন করেননি। তবে এর পেছনে একটা কঠিন সত্য আছে। - কি সত্য? -তোমার বাবা তোমাকে খুব মিস করে,প্রতিদিন না হলেও দুই/তিনবার তোমার ছোট্টবেলার ছবিতে চুমু খায়। একটা কঠিন সত্য তোমাদের আলাদা করে রেখেছে। যার কারণে তোমার বাবা আমাকে কোনোদিন গ্রামে নিয়ে যায়নি,তোমাকেও আমাদের কাছে এনে রাখেনি। -তার পেছনে কি কারণ? - তোমার দাদী তা করতে দেয়নি। -দাদী কেন দিবেনা? - তোমার মা কে তোমার বাবা ভালোবেসে বিয়ে করে।তোমার দাদীর ওনাকে পছন্দ না।ওনাকে মায়ের কাছে রেখে তোমার বাবা শহরে চলে আসে। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতো।তারপর তুমি দুনিয়ায় আসো।তাও তোমার দাদী পছন্দ করতোনা ওনাকে। একদিন তোমার দাদী ওনার বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগে এনে তোমার মাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করে। এইসব শুনে আমি শিউরে উঠি।মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচের মাটির ফাঁক হয়ে যাচ্ছে।আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো,আমার দাদী যে আমার দুনিয়া।সে আমার মায়ের সাথে এইসব করলো।তাও আমার বিশ্বাস হয়নি। - আমি এইসব এক বিন্দুও বিশ্বাস করিনা। - আমার পুরো কথাটা শুনো। তারপর তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে দেয়নি,তোমার মা তোমাকে দেখতে চাইতো।উনি দিতোনা। তারপর তোমার বাবা জেদে পড়ে আমাকে বিয়ে করে। আমরা সংসার করতে লাগলাম। তোমাকে আমরা নিতে চেয়েছি বহুবার উনি দেয়নি। - কিন্তু আমার দাদী করেছে তার প্রমাণ কি? -প্রমাণ উনি নিজেই। তারপর একদিন ওনার একটা অসুখ হয়। উনি ভেবেছিলো উনি আর বাঁচবেনা। তারপর তোমার বাবাকে সব কথা খুলে বলে। তোমার বাবা সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিলো।বাসায় এসে তোমার ছবি বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। তারপর মা সুস্থ হয়ে উঠলো,তোমার বাবাকে রিকুয়েষ্ট করলো যাতে তোমাকে উনি কোলে পিঠে করে মানুষ করে প্রায়শ্চিত্য করতে পারে।তোমার বাবাও রাজী হলো। এই সত্যগুলো তোমার সামনে কোনোদিনই আসতোনা যদি তোমার বাবার সাথে তুমি যোগাযোগ করতে। আমি মনে করলাম যে ভুল তুমি আজীবন পুষে রেখেছো তা এবার গোছানো উচিত। আমার মনে হচ্ছিলো আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। ছোটবেলায় অনেক কিছুর সম্মুখীন হয়েছি মায়ের ডিভোর্স হয়েছে বলে। মাকে অনেক মিস করতাম,কিন্তু দাদী সত্যিই আমাকে কোনো অভাবে রাখেনি।আদর,স্নেহ, বিলাসিতা সবই করিয়েছে। তবুও ওনাকে আমি ঘৃণা করা শুরু করলাম। দাদী কল দেয় আমি কেটে দিই। অনেকদিন দাদীর সাথে কথা বলিনা।বাসায় বসে থাকি,কিছুই ভালো লাগেনা। বাবা এসে দেখে যায় আমাকে,টাকাপয়সা উনিই দেয়। অনেক চেষ্টা করে নিয়ে যাওয়ার,আমি যাইনি।যে শেকড় আগে থেকেই উপড়ে ফেলা,সে শেকড়ে নতুন করে জন্মানোর ইচ্ছে আমার হয়নি। আমি জানিনা দাদী কেমন আছে।হঠাৎ একদিন অচেনা নাম্বার থেকে একটা কল আসলো,আমি জানিনা উনি কে।শুধু বললো সায়মা তোমার দাদী খুব অসুস্থ তোমাকে দেখতে চাচ্ছে।তুমি একবার আসো।আমি ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম।তারপর সেই নাম্বার থেকে আরও ১৩৬ টা কল আসে আমি ফোন ধরিনি। হঠাৎ বাবা কল দিয়ে বললো দাদী মারা গেছে। কয়েক সেকেন্ড এর জন্য আমি থ হয়ে গেলাম। সব অভিমান ভুলে আমি হাউমাউ করে কাঁদলাম। বাবা নিয়ে গেলো আমাকে,খাটিয়ায় শোয়ানো দাদী।মনে হচ্ছিলো আমাকে ডাকছে ফুলবানু বলে। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিলো আমার পুরো পৃথিবী খাটিয়ায় করে গোরস্থানে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো এক পলকে। দাদীর কয়েকটা শাড়ি খুব যত্নে রেখেছি আমি। কি মিষ্টি সুবাস শাড়িতে। দাদী মারা গেছে অনেকদিন হলো প্রায় ১০ বছর। আমি এখন দুই সন্তান এর জননী।তবুও আলমারি খুলে যখন শাড়িগুলো দেখি বুকের মধ্যে হুহু করে উঠে। মনে হয় দাদী ডাকছে আমাকে ফুলবানু আসো,তোমাকে একটু বিলি কেটে দিই।
মায়ের আদর না পাওয়া একটা মেয়ে,দাদীকেই সারাজীবন মা হিসেবে জেনেছে।কিন্তু একটা সময়ে যখন দেখলো তার দাদীই এই অবস্থার জন্য দায়ী।তখন পৃথিবী তার কাছে বিভীষিকাময় হয়ে গেলো
0 Comments