কুয়াকাটার ভোরে ছোট্ট লাল জুতা পড়ে থাকে সৈকতে। মা চিনে নেন—এটি তার পাঁচ বছরের ছেলে আয়ানের। সমুদ্রের কোলাহলে লোকজনের ফিসফিস, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকের খোঁজাখুঁজি, কিন্তু আয়ান মিলছে না। রাতের নিঃশব্দে মা জুতোটাকে আঁকড়ে ধরে রাখেন—ছেলের শেষ চিহ্ন হিসেবে। পরদিন সমুদ্রের কাছে তিনি বুঝতে পারেন, ছেলে আর ফিরবে না, কিন্তু জুতোতে ছেলের স্মৃতি বেঁচে থাকবে।
📖 উপন্যাস : সৈকতে ছোট্ট জুতা
📖 উপন্যাস : সৈকতে ছোট্ট জুতা ✍️ লেখক: তুষার অধ্যায় ১ : ভোরের বালুচর কুয়াকাটার ভোরটা ছিল অন্য দিনের মতোই, কিন্তু মায়ের কাছে একেবারে আলাদা। সূর্য উঠছিল সমুদ্রের বুক থেকে, কিন্তু তার চোখে সূর্যের রঙ ম্লান লাগছিল। ভেজা বালুর ওপর পড়ে ছিল ছোট্ট এক লাল জুতো। মাটির ভেতরে অর্ধেক ঢুকে গেছে, ফিতে আধখোলা। কাছেই এক শিশু দৌড়ে বেড়াচ্ছিল গতকাল—আজ নেই। পর্যটকেরা থেমে তাকাল। কেউ ক্যামেরা নামিয়ে নিঃশব্দে ছবি তুলল, কেউ বিড়বিড় করে বলল, —“এটা কোন শিশুর?” অন্য কেউ হেসে ফেলল, —“ভুলে গেছে বুঝি।” কিন্তু এক নারী এগিয়ে গেলেন ধীরে ধীরে। চোখের নিচে ঘুমহীন কালো দাগ। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে জুতোটার দিকে তাকালেন। আঙুল কাঁপছিল। জুতোর গন্ধে যেন এখনো ছেলের ঘাম লেগে আছে। অধ্যায় ২ : ভিড় আর ফিসফিস সকাল বাড়তেই সৈকত ভরে উঠল মানুষের কোলাহলে। আইসক্রিমওয়ালা হাঁক ছাড়ছিল, কিন্তু মায়ের কানে শুধু ঢেউয়ের শব্দ ঢুকছিল। তার চোখে জল শুকায়নি। একজন মৎস্যজীবী পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, —“পানিতে গেছিল নাকি? এই সমুদ্র কাউরে সহজে ফেরায় না।” এক বৃদ্ধ দম্পতি হাঁটতে হাঁটতে এসে থামল। মহিলা কৌতূহলী চোখে জুতো দেখে বললেন, —“এমন হলে তো খবরদারির দরকার।” কিন্তু তার স্বামী তাকে টেনে নিয়ে গেলেন, যেন ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চান। মায়ের বুক কেঁপে উঠল। গতকালের ছবি মনে পড়ল—আয়ান বালিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, দৌড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। সেকেন্ডের ব্যবধানেই হারিয়ে গেল। অধ্যায় ৩ : খোঁজাখুঁজি বিকেলে পুলিশ এল। হুইসেল বাজল, মাইকে ঘোষণা হলো। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক হাত ধরে লাইন করে সমুদ্রের কিনারা খুঁজল। একজন কনস্টেবল মায়ের দিকে এসে কাগজ বাড়িয়ে বলল, —“ছেলের ছবি দিন, নাম-ঠিকানা লিখতে হবে।” মা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে আয়ানের ছবি বের করলেন। লাল শার্ট পরা, দাঁতে খুঁতভরা হাসি। —“ওর নাম আয়ান… পাঁচ বছর… লাল জুতো পায়ে ছিল।” লোকজন ছবিটা দেখছিল। কারও চোখে সহানুভূতি, কারও চোখে নিছক কৌতূহল। সমুদ্র meanwhile গর্জে উঠছিল—মা মনে করছিলেন যেন সমুদ্রই সব উত্তর গিলে ফেলছে। অধ্যায় ৪ : রাতের কান্না রাত নেমেছে। সৈকতের বাতাস ঠান্ডা হয়ে এসেছে। দোকানপাট বন্ধ হচ্ছে, শুধু সমুদ্র রয়ে গেছে অন্ধকারে। মা এক কোণে বসে আছেন, জুতোটাকে আঁকড়ে। ফিতের গিঁট খুলে রেখেছেন, যেন আবার পায়ে পরিয়ে দেবেন ছেলেকে। এক বৃদ্ধা এসে বসলো তার পাশে, গলায় গামছা ঝোলানো। —“মা, আশা ছাড়িস না। কখনো কখনো জিনিস ফেরত আসে। আবার কখনো আসে না… কিন্তু স্মৃতি থেকে যায়।” বৃদ্ধার চোখে জল চিকচিক করছিল, বুঝা যাচ্ছিল সেও হয়তো কিছু হারিয়েছে একদিন। অধ্যায় ৫ : নিস্তব্ধতার ভেতর পরদিন সকাল। সৈকত ফাঁকা, শুধু কয়েকজন জেলে নৌকা টেনে নিচ্ছে। খোঁজাখুঁজি বন্ধ হয়ে গেছে। মা জুতোটাকে বুকে চেপে ধরলেন। আশপাশের লোকজন ধীরে ধীরে চলে গেল। কেউ কাছে এসে হাত রাখল তার কাঁধে, কেউ আবার দূর থেকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তিনি বুঝলেন—আয়ান হয়তো আর ফিরবে না। কিন্তু এই জুতোই বেঁচে থাকবে তার কাছে, যেন ছেলের নিঃশ্বাসের শেষ চিহ্ন। অধ্যায় ৬ : অসমাপ্ত পথ সন্ধ্যায় সমুদ্র রঙ বদলাচ্ছিল। আকাশ লাল হয়ে আসছিল। মা ধীরে ধীরে সৈকত ছাড়লেন। এক হাতে শাড়ির আঁচল, অন্য হাতে সেই ছোট্ট জুতো। হাঁটার সময় হঠাৎ পা হড়কাল, বালিতে গেঁথে থাকা ছোট পাথরে ধাক্কা খেলেন। তিনি থামলেন, আবার দাঁড়ালেন। ঢেউয়ের শব্দে যেন ভেসে এল— আয়ানের হাসি, “মা, দৌড় দাও না।” তিনি জানেন, ছেলে আর ফিরবে না। তবু এই সমুদ্র, এই বাতাস, এই জুতো—সব মিলেই তার ভেতরে বেঁচে থাকবে।
0 Comments