গল্প - চায়ের পেয়ালা
আকরাম সাহেব এর কাপড়ের ব্যবসা আছে।ঘরে স্ত্রী ও দুই পুত্র সন্তান। একজনের বয়স তেরো, আরেকজনের ছয়। বড়টার নাম ইকরাম আর ছোট টার নাম জহির।বড় ছেলের নাম শুনতেই সকলে বুঝতে পারে বাপের নামের সাথে মিল রেখে এ নাম রাখা হয়েছে। তবে ছোট ছেলের নাম শুনতেই সকলে বেশ অবাক হয়ে পড়েন। মূলত আকরাম সাহেব এর স্ত্রীর নাম জহুরা বেগম।এ কারণেই স্ত্রীর নামের সাথে মিল রেখে ছোট ছেলের নাম এমনটা রাখা হয়েছে। আকরাম সাহেব এর ইচ্ছা নামে যেহেতু মিল রাখাই হয়েছে তবে মা বাবা দুজনেরই এতে অধিকার আছে।
আকরাম সাহেব বেলকনিতে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে পত্রিকা হাতে নিয়ে বসেছেন। আকরাম সাহেব এর কিছু অভ্যাস রয়েছে।তার মধ্যে একটি হলো পত্রিকা পড়া। আজকাল পত্রিকা যতই ডিজিটাল হোক না কেনো তিনি পত্রিকা কিনেই পড়ে থাকেন।এরই মধ্যে হুট করে ইকরাম আসলো বাবাকে চা দিতে।এই চা খাওয়া আকরাম সাহেব এর আরেকটি অভ্যাস। না, আমি নিত্যদিনের চা খাওয়ার কথা বলছি না। আমি মূলত বলতে চাইছি আকরাম সাহেব এর রং চা খাওয়ার অভ্যাস টা।আজ পর্যন্ত তিনি কখনো দুধ চা মুখে দেননি। ওহ হ্যাঁ, এর পাশাপাশি আকরাম সাহেব এর অদ্ভূত একটা অভ্যাস আছে।তার একান্ত প্রিয় পেয়ালায় চা খাওয়ার অভ্যাস।তার স্ত্রীর প্রতি তার কড়া নির্দেশ - এই পেয়ালা তেই যেনো তাকে চা দেওয়া হয়। অন্যথায় অন্য কোনো কাপে তিনি চা পান করতে রাজি নন। চায়ের পেয়ালার বর্ণ স্বচ্ছ, সাথে পিরিচ টাও স্বচ্ছ। আকরাম সাহেব এর বাবা আজমল সাহেব একবার ছেলেকে এটি দিয়েছিলেন। আজমল সাহেব আজ বেঁচে নেই। বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখতেই হয়তো আকরাম সাহেব এর এমন ইচ্ছে।অতি যত্ন সহকারে রাখেন পেয়ালাটিকে। স্ত্রী ছেলেদের প্রতি ও তার কড়া নির্দেশ পেয়ালা টার যাতে কিছু না হয়।বলা যায় একপ্রকার সন্তানের মতোই ভালোবাসেন তিনি এই পেয়ালা কে।
আকরাম সাহেব বেলকনিতে বসে বসে চা পান করছেন।আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ মুহূর্তে আকরাম সাহেব দোকানে বসেন। কিন্তু আজ কেনো যেনো তার মোটেও মন চাচ্ছে না কাজের উদ্দেশ্যে বেরুতে। সকাল থেকে শরীরটা মেজমেজ করছে।দোকানের ক্যাশিয়ার আর কর্মচারী উভয়েই গিয়েছেন।এ মানুষ গুলো তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী।এ সময়ে আকরাম সাহেব এর ফোন বেজে উঠলো। দোকান থেকে ক্যাশিয়ার এর ফোন। হিসাব নিয়ে একটা বড় গন্ডগোল বেঁধে গেছে। কোনো মতেই হিসাবটা মিলাতে পারছেন না তিনি।আকরাম সাহেব কে যে করে হোক আজ যেতেই হবে।এসব কাজে চাইলেও ফাঁকি দেওয়া যায় না।
চা শেষ করে টেবিলের উপর চায়ের পেয়ালা টা রেখে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হলেন তিনি।জহুরা বেগম রান্নাবান্নাতে ব্যস্ত।আজ আকরাম সাহেব এর প্রিয় টাকি মাছ রান্না করছেন। পাশাপাশি ভাতও চড়িয়েছেন।এসব কাজ শেষ করতেই মনে পড়লো আকরাম সাহেব এর আবদার এর কথা।রাতে স্ত্রীর হাতের ঝাল ঝাল মুরগি টা খেতে চেয়েছিলেন তিনি। আপাতত মুরগি টা কেটে কুটে রাখলেই ভালো।কুটতে বসলেন আর ওমনি আকরাম সাহেব এর চায়ের কাপ টার কথা মাথায় এলো তার। তিনি তার বড় ছেলে ইকরাম কে ডেকে বলতে লাগলেন- তোর বাবার চায়ের কাপ টা নিয়ে আয় তো। আর হ্যাঁ, মনে করে সাবধানে আনবি কিন্তু।
মায়ের মুখে এ কথা শুনে ইকরাম এর মনে কি এক ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হলো। সবসময় তো মা এমনটা বলেন। তাহলে আজ এতো ভয় লাগার কারণ কি?অতি যত্ন সহকারে চায়ের পেয়ালা টা নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। হাতগুলো কাঁপছে।কোনোভাবেই স্থির করতে পারছে না সে। শেষ মেষ ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেলো।ঠাস করে বহুদিনের সামলিয়ে রাখা অতিযত্নবান পেয়ালা টা টাইলসের উপর পড়ে ভেঙ্গে গেলো।এমন শব্দ শুনে জহুরা বেগম দৌড়ে এলেন।
-হায় আল্লাহ! এ কি করলি তুই!
তিনি ইকরাম কে আরো বকতে যাবেন তার আগেই জহুরা বেগম এর ফোন টা বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি করে তিনি ফোনটা ধরলেন। ওদিকে ইকরাম ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।আজ বাবা আসার পর তার কি অবস্থা টা হবে! না জানি কত বকবকানি শুনতে হবে আজ। বাবার রাগ আগেও দেখেছে ইকরাম। তবে এবার মনে হচ্ছে এবার বাবার রাগটা আগের রাগ গুলোর চাইতেও অনেক বেশি হবে।
জহুরা বেগম হঠাৎ করে চিল্লিয়ে বলে উঠলেন - কি!! কি বলছেন ওসব! আ,,,,আপনারা কোন জায়গায়?
-আব্দুল্লাহ মার্কেট এর সামনে।
জহুরা বেগমকে এতোটা ভীত আর চিন্তিত দেখে ইকরাম এর নিজের ভয় উধাও হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক গলায় সে বললো-
-কি হয়েছে মা?
-তুই,,, তুই জহির কে নিয়ে আয় ভিতর থেকে।তোর আব্বা নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করছে আব্দুল্লাহ মার্কেট এর সামনে। তাড়াতাড়ি চল।
এসব বলতে বলতেই জহুরা বেগম এর চোখের কোনে পানি চলে এলো।বুকটা আরো বেশি ধুকপুক করছে। দুই ছেলেকে নিয়ে দ্রুত আব্দুল্লাহ মার্কেট এর সামনে গেলো।
বহু মানুষের ভীড়।ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখা গেলো আকরাম সাহেব এখন আর আকরাম সাহেব নেই। তার পরিচয় এখন কেবলই একটা লাশ! জহুরা বেগম চিল্লিয়ে কাঁদছেন। জহির ও আব্বু আব্বু করে চিল্লাচ্ছে। কিন্তু ইকরাম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে ভাবছে তবে কি এই কারণেই চায়ের পেয়ালা টা আজ ভেঙ্গে গেলো?
লেখায়- রাদিয়াহ সারওয়া।
আমি রাদিয়াহ সারওয়া। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে অধ্যয়নরত। গল্প লেখার পাশাপাশি কবিতা এবং দু-চারটে লাইন লিখে থাকি। মূলত শিক্ষামূলক এবং সামাজিক লেখার প্রতি আমার আগ্ৰহ বেশি
0 Comments