

গল্পটি জুলাই অভ্যুত্থানের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। গল্পে উল্লেখিত মানুষদের সঠিক পরিচয়ে সন্দেহ আছে কারন এদের সম্পর্কে খন্ডিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি একদম সত্য। নামটি শুধু কল্পনপ্রসূত।
ছেঁড়া পোস্টার এস, এম, ইমরানুল ইসলাম রাজন গল্পটি জুলাই অভ্যুত্থানের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। গল্পে উল্লেখিত মানুষদের সঠিক পরিচয়ে সন্দেহ আছে কারন এদের সম্পর্কে খন্ডিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি একদম সত্য। নামটি শুধু কল্পনপ্রসূত। নাম সোহাগ। পেশায় ফুটপাতের বইয়ের দোকানের মালিকের সহযোগী। বয়স আনুমানিক তের বা চৌদ্দ হবে বড় জোড়। দেশের বাড়ি সম্ভবত কুষ্টিয়ার অদূরে কোন উপশহর বা গ্রামে হবে হয়ত। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোার পর আর্থিক দৈন্যতার কারনে হাই স্কুলের গন্ডিতে আর প্রবেশ করা হয়নি তার। খেলার বয়সেই তাই জীবিকার তাগিদে তাকে ছুটতে হয়েছে এদিক থেকে ওদিকে। শুধু একটু খাবারের আশায়। ড্রাইভার বাবার অধীনে তাদের জীবন বেশ সচ্ছল ও সুখের ছিল। তেমন কোন অভাব ছিল না তাদের শৈশব জীবনে। স্কুলে যাওয়ার নতুন রঙ্গিন ব্যাগ, জুতো, নতুন খাতা বই, ট্যাগ লাগানো নতুন জামা কাপড় আরো কতো কি। বাবার মৃত্যুর পর ওদের জীবনের উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল। উপায়অন্তুর না দেখে গৃহিনী মা এলাকার এক কারখানায় ঘন্টা ভিত্তিক চুক্তিতে কাজের বিনিময়ে সংসারের হাল ধরলো কোন মতে। ওর ছোট বোনের জন্মের সময়ে ওদের বাবা মারা যান। তাও প্রায় ছয় বছর হতে চলল। তখন সোহাগের বয়স ছিল সাত কি আট। ছোট বোন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ে। ভোর থেকে সন্ধা পর্যন্ত থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই হয়। ভোরে ওকে দিয়ে মা কাজে যায় আবার সন্ধায় কাজ শেষে বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসে। কোনমতে সংসারটা চলছে। এলাকায় তেমন কোন কাজও নেই যে সোহাগ সেটা করবে। ছুটাছাটা একাজ সেকাজ করে শেষমেষ বাধ্য হয়ে এলাকার একজন বই ব্যাবসায়ীর মাধ্যমে ঢাকার নীলক্ষেতের বই এর মার্কেটে সোহাগের একটা কাজের গতি হলো। পুরাতন বইএর গাট্টিগুলো সময়মতো খোলা-বন্ধ করা, মোছা, গোছ-গাছ করা, ছোট খাঁটো ছেড়াঁ ফাঁটা বই মেরামতসহ বিক্রি করা ইত্যাদি তার দায়িত্ব। দেশি বিদেশী দামি দামি বিভিন্ন বই সোহাগকে খুব আকৃষ্ট করে। নামি দামি প্রকাশনীর বই গুলো খুবই আকর্ষনীয় ও নান্দনীক হওয়াতে বুঝুক বা না বুঝুক সে খুব মনোযোগ সহকারে দেখে। ইংরেজী বর্নমালা বা ওর জানা কোন বানান চোখে বাধলেই ওর চোখ চকচক করে ওঠে। ওর কাছে মনেহয় আর একটু পড়তে পারলে ঠিকই এই সুন্দর সুন্দর বই গুলো সে পড়তে পারবে। সুন্দর দামী বইগুলো সোহাগ বিক্রির চেয়ে ওর কাছাকাছি লুকিয়ে রাখতে বেশী পছন্দ করে। যখন তেমন কোন মানুষের চাপ থাকে না বা অবসর সময়ে ও বইগুলো পরম যতœসহকারে দেখে উল্টে পাল্টে। ওর মনে মনে প্রচন্ড বাসনা জাগে এমন বই লেখার। আনমনে সে প্রতিজ্ঞা করে এমন সব বই লেখার ও পড়ার। এই বই প্রীতির কারনে ওকে বকা মাইর ও কাজ থেকে ছাঁটায়েরও হুমকি দেয়া হয়েছে কয়েকবার। তবুও কাজ হয়নি। ওর মালিক মতি মামাও তেমন কোন শক্ত শাস্তি ওকে দেননি কখনও। সেও হয়ত তার এই বই প্রীতিটা ভালোভাবেই নিয়েছিল। প্রতি বছরের মতোই এবার ও জুল্ইা ২০২৪ আসে। কিন্তু এই জুলাই শুরু থেকেই কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো প্রথম দিন থেকেই। ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিক্যেল, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ¯েøাগান, মিছিল, সভা, র্যালী, ব্যানার, ফেস্টুনসহ পদচারনায় গমগমে হয়ে উঠতে লাগল যত দিন যেতে লাগল। মূলত সরকারী চাকরীতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে এর সূত্রপাত। দোকান মালিক মতি মামাকে সোহাগ জিজ্ঞেস করে মামা চারদিকে কেমন চিল্লাচিল্লি হৈচৈ ক্যান? ধমকের সুরে মতি মামা উত্তর দেয়- তোর এত জাইনে কাম নাই, এগুলোন দেকার অনেক লোক আছে, তুই তোর কাম কর। সব গোজগাজ করে বন্ধ করে দে। আর তুই কবিরের কাছে থাকবি আমি যতদিন না আসি। আর ভাবসাব বেশী খারাপ দেখলে ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়িতে চলে যাবি। সোহাগের মোটেও ভালো লাগছে না বিষয়টি। নেয়ে খেয়ে ভালোই কাটছিল। মাসে মাসে মাকে অনেক টাকাও পাঠাচ্ছিল সোহাগ। এখন মাকে কি বলবে? মা বোন কিভাবে চলবে? আবার ওদের জীবনে অভাব নেমে আসবে? এসব ভেবে সোহাগের আর ভালো লাগছিল না। সামনের ঈদে ছোট বোনকে একটা নতুন জুতা কিনে দেয়ার সংকল্পও সে মনে মনে করে রেখেছিল। এখন সেটাও একটা সঙ্কার মধ্যে পড়ে গেল। মতি মামা চলে যাওয়ার পর থেকে মোবাইলে মা বোনের সাথে কথাও বলা হয়নি তেমন। কে কোথায় কেমন আছে তার জানার কোন উপায়ও ছিল না। সাধারন শিক্ষার্থীদের পুলিশ ও ছাত্রলীগের বর্বরোচিত হামলার পর সরকার পক্ষ থেকে অনুশোচনা না করে বরং নিজেদের সাজানো হামলা দেখে মায়া কান্না করে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষনা দেশবাসী আর মেনে নিতে পারেনি। তারপর আবার সাধারন শিক্ষার্থীদেরকে কটাক্ষ করে রাজাকার বলা হয়। নিজের ক্যাম্পাসে অন্যায়ভাবে নিজের রক্ত ঝঁড়ানো এতো সাধারনভাবে কোন শিক্ষার্থীরা নেয়নি। যেমন মেনে নিতে পারেনি ছোট্ট নিরীহ বই বিক্রেতার সহযোগী সোহাগও। সোহাগ মতি মামাকে প্রশ্ন করে- মামা, নিজের কলেজে কোন মেয়ে মানুষ কি মাইর খায় নাকি? নিজেদের কলেজের ছোট ভাই বোনদের কেউ এভাবে কোপাতে পারে? আবোল তাবোল আঘাত করতে পারে মামা? তাইলে এরা কার কাছে যাবে পুলিশও যদি গুলি মারে? অন্যদিনের মতো মতি তার কথার উত্তর দেয় না। মতি হাজার দশেক টাকা সোহাগের হাতে গুজে দিয়ে বিদায় নেয়। দেশ স্বাভাবিক হলে সে তার মায়ের সাথে কথা বলে ওকে আবার কাজে আনবে। ততদিন ও কবিরের কাছেই থাকবে খাবে। সেই জন্য কবিরের কাছেও কিছু টাকা দিয়ে যায় মতি মামা। সোহাগের ভেতরে কেমন ভালো লাগছে না সবদিক দিয়ে। কিন্তু ওর কিছু করারও ছিল না। তার শুধু মনে হচ্ছিল ধরে ধরে সব পুলিশকে বলতে যে, ভাই আমাদের আর মাইরেন না। আর গুলি কইরেন না। আমাদের মাফ করে দেন। আমরা অনেকদিন ঠিকমতো খায় না। ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। গোসল করতে পারি না। কারও খোঁজ নিতে পারি না। কিন্তু সোহাগ কথাগুলো কাকে কিভাবে বলবে বুঝতে পারে না। ১৬ জুলাই সকলের কাছে খবর আসে, রংপুরে পুলিশ সামনে দাড়ানো নিরস্ত্র এক ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। আবু সাইদ নাম ছিল অভাগা ছেলেটার। খুন হওয়া ছেলেটিও হয়ত ধারনা করতে পারেনি যে, আমাদের জান মালের নিরাপত্তার মহান ও গুরু দায়িত্বটি যে পুলিশের কাছে দেয়া হয়েছে সেই পুলিশ নিরস্ত্র অবস্থায় গুলি করতে পারে। এটা কল্পনাতীত ও ইতিহাসে বিরলতম নিকৃষ্ট কাজ। এই ঘটনার পর সারা দেশ যেন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রশাসন ও দলের অংগ সংগঠন অন্যদিকে সারা দেশের সর্ব শ্রেনীর আম-জনতা। যতই সময় গড়াচ্ছিল সরকারী হায়েনা বাহিনী ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল। দেশের সাধারন মানুষের সাথে যেন তারা যুদ্ধে নেমেছে। এর মাঝে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলো। হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিআর গ্যাস, বোমা মেরে নিরস্ত্র মানষের উপর বর্বরোচিত হামলা করলো হাসিনার রক্তপিপাশু বাহিনী। বাড়ির বারান্দায় দাড়ানো, ঘরের মধ্যে বাবার কোলে, বাড়ির ছাদে বাবার কোলে, বাবার সাথে খেলারত, রাস্তায় হাসপাতাল ফেরত শিশু কোনটিই নৃশংস হত্যার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সোহাগ বুঝতে পারে না ও কি করবে। হাজারো মানুষের আহাজারি, রক্ত, গুলি, বোমা, টিআর গ্যাসের জ¦ালা, অস্ত্র, হতাহত ইত্যাদি এক বিভীষিকাময় ৩৬ দিন পার করে ৫ আগষ্ট ২০২৪ সকালে ছাত্র জনতা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্তরে সমাবেত হওয়ার চেষ্টা করে। সবদিক থেকে খবর আসতে থাকে যে কোন মুহুর্তে হাসিনার পতন ঘন্টা বাজবে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহন করবে। সারা দেশব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে গেল সরকারী হানাদার বাহিনীর সাথে। গনভবন অভিমুখে লক্ষ কোটি মানুষের মিছিল এগিয়ে চললো। আজকেই চুরান্ত ফয়সালা হবে রাজপথে। হয় বিজয় না হয় মৃত্যু। মাঝে মাঝে সামান্য বাধার অভ্যাস আসলেও আমজনতার বাধার মুখে টিকতে পারছিল না সরকারী বাহিনী। আর সবার মতো সোহাগদেরও মনে দারুন আনান্দ লাগছে। আজ মনে হয় মুক্তি মিলবে। সব হানাহানি, রক্তপাত, বোমা-ধোঁয়া বন্ধ হবে। সকলেই গনভবন অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ সোহাগের মনে হলো, বিজয় মানেই তো খুশি আর খুশি হলেই তো ফুল বা এই জাতীয় কোন কিছু লাগে। সে ফুল খুজতে লাগল। কত ফুলগাছ ছিল নীলক্ষেত ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। চারদিকে যেন জ¦ালাও পোড়াও একটা অবস্থা। চারদিক থেকে তখনও মুহুর্মুহু গোলাগুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ, পুলিশ ও এ্যাম্বুলেন্সের অনবরত সাইরেন, চারদিকের গুমোট ও ভয়ংকর পরিবেশ নিরীহ সোহাগকে কাবু করতে পারেনি। সোহাগের মনে শুধু এটাই দুঃখ, এত নিরীহ মানুষকে মেরে হাসিনার কি লাভ হলো? আমাদের উপরে এত অত্যাচার করে কার লাভ হলো? আন্দোলনে হতাহতদের স্মরনে আজ সকলে গন ভবনে এক হচ্ছে। তাদেরকে সম্মান জানাতে তো ফুল অবশ্যই লাগবে। তাজা ফুল না পাওয়া যাক অন্তত ফুলের একটা ছবিও যদি পাওয়া যেত তবুও শহীদদের একটু ভালবাসা জানানো যেত। কাঠ কয়লার পোড়া ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে আধপোড়া বিদেশী ম্যাগাজিনের অংশ বিশেষ ওর চোখে পড়লো। রাস্তার ওপাড়ে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পোড়া ছাই কালির পাশে ম্যাগাজিনটা চকচাক করছে। জাপানী চেরী ফুলের উজ্জ্বল ছবিগুলোতে রোদের আলো পড়তেই আরও চকচক করছে। বিপদের কথা হলো রাস্তার ওপাশে পুলিশের মারমুখি মনোভাব। কিছুতেই রাস্তা অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে থেকে থেকে। আবার নানান বিষয়ে বাববিতন্ডাও হচ্ছে। দুই পক্ষই রাস্তা ছেড়ে দিয়ে যে যার জাইগায় ফিরে যেতে বলছে। শিক্ষার্থী জনতা আমৃত্যু লড়াই করার ঘোষনা দিয়েছে দেশব্যপী, এটাই বার বার তারা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ম্েযধ সোহাগ রাস্তা পার হয়ে আধপোড়া ম্যাগাজিনটা ঝেড়ে মুছে হাতে নিল। চারদিককার টিআর সেলের বিষাক্ত ধোঁয়ার কুন্ডলী তাকে কাঁবু করতে পারলো না। জাপানী চকচকে ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর চেরী গাছের পোস্টারটি ছিঁড়ে সে বুক পকেটে রাখলো। এটি যে তার বিজয়ের পরম স্মারক। বুকের বামপাশের পকেটে সে অর্ধপোড়া ছেড়া পোস্টারটি বামহাত দিয়ে একবার দেখে নিল ঠিক আছে কিনা। আর লাল একটি ফুলের ছবি সে হাতের মুঠোয় শক্ত করে রেখে দিল মনে শক্তির উৎস হিসাবে। সোহাগ এক দৌড়ে রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে দাড়াল। দশ হাত দুরেই পুলিশের মারমুখি অবস্থান। সব বন্দুকের নলগুলো কেমন ভয়ংকরভাবে তাক করা। অন্যদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় ব্যস্ত হাজারো শিক্ষার্থী জনতা। সোহাগ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল সে পুলিশের দিকে যাবে। কারন আর যাই হোক পুলিশ তো আর তাকে মারবে না। হয়ত একটু তাড়া দেবে। সেও চাচ্ছে পুলিশের ব্যারিকেড টপকে গন ভবনের দিকে অগ্রসর হবে। কারন সেখানেই বিজয়ের শেষ হাসি হাসতে হবে। সবাই বলছে ঐ পাপের প্রাসাদ আজ ধ্বংস করে দেয়া হবে। সোহাগের কাছে ব্যাপারটা খুবই রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। অপরদিকে ভীড়ের তোড়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে নিজের হ্যাংলা পাতলা শরীরটা নিয়ে সে আর কষ্ট করতে চাইল না। কারন কাল থেকে সে না খাওয়া। শরীরেও খুব বেশী শক্তি অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া ওর কাঙ্খিত ফুলের পোষ্টারটা তো আছেই। হাতেরটাও আছে ঠিকঠাক মতোই। সোহাগ কি ভেবে পুলিশের দিকে দুই পা এগোতেই হঠাৎ ওর মনে হলো বামপাশের বুক পকেটে রাখা চেরী ফুলের আধপোড়া ছেড়া পোস্টারটিতে কেউ যেন প্রচন্ড জোরে গুতো দিল। ও শুধু ওর বাম পাশের পকেটের দিকে হাতটা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। মুহুর্তেই সোহাগের শুকনো দেহটি ধপ করে পীঁচঢালা সংগ্রামী রাজপথে পড়ে গেল। যেন কাঠের কোন পুতুল হঠাৎ পড়ে গেল। ক্ষনিকের জন্য ওর মাথা থেকে ফুল ও পোস্টারের চিন্তা দূরে চলে গেল। ওর মা ও বোনের কথা খুব মনে পড়লো। ওরা তাকে অনেক জোরে চিৎকার করে ডাকছে নাম ধরে। সোহাগও তার মা ও বোনকে প্রানপনে ডাকছে। কিন্তু কেউ ই কারও কথা শুনতে পারছে না। তাকে যেন অন্য অনেকে ডাকছে তাদের কাছে। সবার হাতে বিজয়ের পতাকা আর তার দেয়া আধাপোড়া চেরী ফুলের পোস্টার। আস্তে আস্তে সোহাগের শরীরটা আরও নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগলো। এত কিছুর মাঝেও তার মনে হতে লাগল সুন্দর সুন্দর সব মলাটের দামী বই পড়া বা নিজের নামে বই বের করা। তা আর হলো না। বিজয় কেমন দেখতে হয় বা বিজয় হলে কি হয় সেটাও তার দেখা হলো না। কিভাবে বিজয়ের ফুল দিতে হয় সেটাও তার অজানা থেকে গেল। প্রবল বাধা ও হতাহতের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনা বোন রেহানাকে সাথে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেল। চারদিকে মানুষের উল্লাসে উল্লাসে আনান্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো। কোটি জনতা রাস্তায় নেমে আসলো। কাতারে কাতারে মানুষ আল্লাহর দরবারে শুকরীয়া আদায়ে নিয়োজিত হলো, কান্ন্কাটি করছে আনন্দে। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত রাগ-কষ্ট-ক্ষোভের অনুভূতি প্রকাশ করলো। অত্যাচারি সকল থানা, আওয়ামীলীগের সকল সংঘঠনের অফিস কার্যক্রম, শেখ মুজিবের সকল ম্যুরাল, মুর্তি ভেঙ্গে চুঁড়মার করে গুড়িঁয়ে দিল কিক্ষুব্ধ জনতা। কেউ শুরু করলো লুটপাট, কেউবা বিক্ষুব্ধ হয়ে ধ্বংসলীলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো, কেউবা আঘাত করে প্রতিশোধ নিতে শুরু করলো। এর মাঝে সোহাগের মতো শত সোহাগ হারিয়ে গেল। এমন শত সোহাগের রক্তের উপরে নির্মিত হয়েছে ২০২৪ এর নতুন বাংলাদেশ। হাজারো মানুষ আহত হয়ে কাঁতরাচ্ছে দেশজুড়ে। সোহাগের মনের ইচ্চা মতো হয়ত সে বড় বড় বই পড়তে পারেনি। নিজের নামে বই ছাপাতে পারেনি। কিন্তু তাদের এই বিরত্বগাথাঁ যুগের পর যুগ মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে। তাদের আত্বত্যাগের গল্প শুনে উৎসাহ পাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। তারুন্যের নতুন বাংলাদেশে অবশ্যই তাদের মর্ম বোঝানো হবে। সোহাগের বামপকেটে থাকা বিজয়ের স্মারক আধপোড়া ছেড়া চেরী ফুলের পোস্টারের মূল্য একদিন অবশ্যই হবে এই মুক্ত বাংলায়। বৈষম্যহীন, মুক্ত, স্বাধীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে থাকি আমরা সাধারন নাগরিকেরা। স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবো লিখতে পারবো আর কম পয়সায় পরিবার পরিজন নিয়ে দিনপাত করবো। এটাই সামান্য প্রত্যাশা আমাদের । সোহাগদেরও তো হয়ত এতটুকুই চাওয়াই ছিল। সেটা যতদিন না পূরণ হবে ততদিন আমাদের মুক্তি আর সোহাগের বাম পকেটে রাখা আধপোড়া ছেড়া পোস্টারর মতোই নির্বাক ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসাবে অতল গহŸরে থেকে যাবে। ঐ ছেঁড়া পোস্টারটিই হতে পারে আমাদের প্রেরনার উৎস।
গল্পটি জুলাই অভ্যুত্থানের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। গল্পে উল্লেখিত মানুষদের সঠিক পরিচয়ে সন্দেহ আছে কারন এদের সম্পর্কে খন্ডিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি একদম সত্য। নামটি শুধু কল্পনপ্রসূত।
ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন, কবিতা, ছড়া ও গল্প লেখার অভ্যাস। তবে সংবাদ পত্রে প্রতিবেদনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক লেখালেখির শুরু।
0 Comments