

ঘড়িতে বাজে রাত ১টা। সাব্বিরের মোটেও ঘুম আসছে না। বিছুদিন আগেই সাব্বির পনেরোতে পদার্পন করলো। সাব্বিরের বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। বড় ভাই শাকিল ইন্জিনিয়ার । বড় ছেলে ইন্জিনিয়ার হওয়াতে ছোট ছেলেকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেন আসিফ সাহেব। আসিফ সাহের আর কেউ নন, সাব্বিরের বাবা। অবশ্য এ শখ তার মাথায় এমনি এমনি আসেনি। সাব্বিরের খালাতো বোন ঝুমা বড় ডাক্তারের পদে আছেন।আসিফ সাহেব প্রায়শই বলে থাকেন তোমার খালাতো বোন একটা মেয়ে হয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি ডাক্তারি করে থাকে , সেখানে তুমি ছেলে হয়ে কেনো ডাক্তার হতে পারবেনা বলো তো?সাব্বিরের মাথায় এখন নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অবশ্য ডাক্তার হওয়ার ব্যাপারে না, - অসুখের ব্যাপারে। কিছুদিন ধরে সাব্বিরের মা সুফিয়া বেগম সর্দি-কাশিতে ভুগছেন, বাবার প্রচণ্ড জ্বর, একবার বাড়ে। মা জ্বরপট্টি লাগিয়ে দেন, আবার কমে কিছুক্ষণ পর আবার বাড়ে, এভাবেই চলছে দিন কাল। শাকিলের মাইগ্রেনের পেইন এর কারণে কাজ ঠিকমতে করতে পারছে না। আসিফ সাহেব এর এক বন্ধুর ওষুধের দোকান আছে। ওখান থেকে ওষুধপত্র এনে নিয়মিত খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার নাম নেই।বাসায় একমাত্র সাব্বির ই এখন সুস্থ । অবশ্য কিছুদিন আগে টাইফয়েড থেকে মুক্তি পেয়েছে।সাব্বিরদের পরিবারে কার নজর লেগেছে কে জানে। অসুস্থতা লেগেই আছে। সাব্বির মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগলো কেনো এতসব অসুস্থতা এই পৃথিবীতে?ইশ! যদি অসুখ বিসুখ না থাকতো তাহলে কতই না মজা হতো! ঠান্ডা লাগলে মজার আইসক্রিম টা খাওয়া যায় না।জ্বর উঠলে খাবার গুলো তিতা লাগে। শান্তিমতো ঘুমানো যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে দু\'হাত তুলে দোয়া করলো সাব্বির।সহজ সরল মনে বলতে লাগলো - \'হে আল্লাহ,এই দুনিয়া থেকে সকল রোগ, অসুখ বিসুখ দূর করে দাও।\' এতটুকু বলে ছোট্ট করে আমিন বলে দু\'হাত মুখে বুলিয়ে নিলো।বালিশটা ঝেড়ে নিলো। অতঃপর চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা। চোখে নেমে এলো প্রশান্তির ঘুম। ঘড়িতে বাজে সকাল ন\'টা।সুফিয়া বেগম অনবরত ডেকে চলেছেন সাব্বিরকে। ছোটবেলায় এই ছেলে সহজে ঘুমাতো না।ঘুমালেও একদম কাঁচা ঘুম ছিল ছেলেটার।আর বর্তমানে একদম তার উল্টো। আধঘন্টা ধরে ডাকলেওঘুম ভাঙ্গে না। অবশেষে সুফিয়া বেগমের ডাকা সফল হলো। সুফিয়া বেগম অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন। তার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সর্দি কাশি একেবারেই বিদায় নিয়েছে। সাব্বিরের মনটা খুশি হয়ে গেলো। মুখ-হাত ধয়ে নাস্তার টেবিলে বসতেই সাব্বির লক্ষ করলো- আসিফ সাহেব বেশ সুখের সঙ্গেই নাস্তা করছেন, তৃপ্তিসহকারে পেট ভরে খাচ্ছেন। সাব্বির জিজ্ঞাসা করলো-বাবা, জ্বর কমেছে? আসিফ সাহের প্রফুল্ল কন্ঠে জবাব দিলেন-কমেছে বৈকি, একেবারেই নাই হয়ে গেছে। ততক্ষণে সুফিয়া বেগম এসে বললেন-শাকিলের মাথাব্যথাটাও একদম চলে গেছে। সাব্বিরের বাবা অবাক হয়ে বললেন-বাহ্। বেশ ভালো তো, আমাদের সবার উপর কিসের ম্যাজিক ঘটলো কে জানো একথা বলে বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। সাব্বির মনে মনে বললো-ম্যাজিক না বাবা, এ আমার দোয়ার ফল। এভাবে দিন যাচ্ছে, মাস পেরোচ্ছে একদিন বাবা টিভিতে এক অপ্রত্যাশিত নিউজ দেখতে পেলেন, রিপোর্টার বলছেন, পৃথিবীতে এন্টিভাইরাসের আগমন ঘটেছে যা পৃথিবীর সকল জীবাণু ধ্বংসে অবদানরেখেছে। পৃথিবী থেকে অসুখ-বিসুখ বিদায় নিয়েছে। এ কথা শুনে প্রায় পুরো পৃথিবীর সকল মানুষই খুশি।সাব্বিরের কাছে আজ অন্যতম সুখের দিন মনে হচ্ছে। এমন দোয়ার কারণে নিজের ওপর গর্ববোধ হচ্ছে তার। সে ভাবতেও পারেনি তার এমন দোয়া আল্লাহ্ এতো সহজে কবুল করে নেবেন। হঠাৎ একদিন ঝুমা ফোন করলো। সুফিয়া বেগম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না ।এত বছর পর ঝুমার ফোন!সুফিয়া বেগম যতটা অবাক হলেন ততটা দুশ্চিন্তাও ও করলেন। কি কারণ হতে পারে ফোন দেওয়ার? কোনো বিপদ হয়নি তো। সুফিয়া ফোনটা রিসিভ করলেন। -কি খবর খবর সুফিয়া খালা কেমন আছো তোমরা? - আমরা ভালো আছি। তোর কি খবর? এ প্রশ্নটা সুফিয়া ভয়ে ভয়ে করলেন। মনে হাচ্ছিলো উত্তরটা তিনি ভালো শুনবেন না। ফোনের ওপাশ থেকে ঝুমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে খবর আরকি! ঘরে বসে বেকারভাবে দিন কাটাচ্ছি। -বেকারভাবে বলতে? -মানে পৃথিবীতে তো এখন অসুখবিসুখ নেই, তাই কেউ ডাক্তারের কাছে আসে না। আমার চেম্বারটা খালি পড়ে আছে। বলতে পারো পুরো হাসপাতালটাই অচল হয়ে গেছে। সাবিনা ও বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। -সাবিনা কে? -ও আচ্ছা, সাবিনার কথা তো তোমাকে বলাই হয়নি। সম্প্রতি নার্স হিসেবে জয়েন করেছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বাবার অনেক টাকা খরচ করে নার্সিং এ ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু নার্সিং এ ঢুকে তো কোনো লাভ হচ্ছে না। বাবার টাকাগুলো পানিতে গেলো বলে মনে হচ্ছে তার। পরিবারের হাল ধরতে হিমশিম খাচ্ছ। আসিফ সাহেব ফিটফাট হয়ে অফিসে যাচ্ছেন। সাদা ফুল হাতা শার্ট, কালো রংয়ের প্যান্ট সাথে একটা লাল টাই পড়েছেন। মানিব্যাগ টা খুঁজে পাচ্ছেন না। ঘড়িটাও হাতে দিলেন। তিনি সুফিয়াকে ডাকলেন। সুফিয়া জবাব দিলেন-আসছি। ফোনটা রেখে আসিফ সাহেবের কাছে গিয়ে ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ টা বের করে ছিলেন। সাথে টিফিন বক্স টাও ধরিয়ে দিলেন। আসিফ সাহেব বের হলেন। তবে আজ তিনি আশেপাশে কোনো রিকশা খুঁজে পাচ্ছেন না। দু\' একটা রিকশা সামনে দিয়ে যাচ্ছে তবে প্যাসেঞ্জার সহ। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সামনে তারই বয়সী এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন। ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমালটা বের করার মুহূর্তে পকেট থেকে কি একটা কাগজ যেনো পরে গেলো। আসিফ সাহেব কাজটা উঠিয়ে ভদ্রলোককে ডাকলেন-এই যে শুনুন। ভদ্রলোক পিছনে ফিরে তাকালে - আরেহ জাভেদ তুই! জাভেদ হচ্ছেন আসিফ সাহেবের সেই বন্ধু যার কাছ থেকে ঔষধপত্র কিনতেন। জাভেদ সাহেব কিছুটা হাসার চেষ্টা করলেন। অকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। -কিরে? তোর কি হলো? - আ....আমার? কই? কিছু না তো। জাভেদ সাহেবের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মিথ্যে বলছেন, আসিফ সাহেব আবারও জিজ্ঞাসা করলেন। এবার জাভেদ সাহেব আর মিথ্যা বলতে পারলেন না। বলতে লাগলেন- এখন তো কেউ ঔষধপত্র কিনতে আসেন না, তাই আমার কেনা ঔষধগুলো ফার্মাসিতে পড়ে আছে, কখনও ভাবিনি পৃথিবীতে এমন পরিবর্তন আসবে আর আমার ব্যবসা অচল হয়ে পড়বে! বুঝে উঠতে পারছিনা কি করবো! আসিফ সাহেব জাভেদ সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আর কিছুই বললেন না। রাত ১০টা বাজে, ডাইনিং টেবিলে সকলে একসাথে খেতে বসেছে। আসিক সাহেবের পাতে ভাত দিতে দিতে আসিফ সাহেব বলে উঠলেন জাভেদ সাহেবের কথা। আর জাভেদ সাহেব এর জন্য বেশ আফসোস করতে লাগলেন। আসিফ সাহেবের পাছে মুরগীর মাংস তুলে দিতে দিতে সুফিয়া বেগম ঝুমা ,সাথে সাবিনার কথা বললেন, এ সকল কথা শুনে সকলের মনটা খারাপ হলো। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ হলো সাব্বিরের। আজকের এই পরিস্থিতির পেছনে নিজেকে দায়ী মনে করছে সে।সে তো মানুষের বড্ড ক্ষতি করে ফেললো। উপকার করতে গিয়ে অপকার করার অবস্থা! সুফিয়া বেগম অনবরত ডেকেই চলেছেন সাব্বিরকে। এই সাব্বির ওঠ, ন\'টা বেজে গেছে। হুট করে চোখ খুললো সাব্বির। ওহ! তাহলে এতোবড় একটা স্বপ্ন দেখলো সে! সফিয়া বেগম হালকা কাশি দিয়ে বলে উঠলেন-আয় নাস্তা খেতে। এবারে মায়ের কাশি শুনে অসুখ বিসুখের কথা চিন্তা করে সাব্বিরের মনটা আর খারাপ হলো না। বরং মনে হতে লাগলো হাফ ছেড়ে বাঁচলো, অতঃপর নিত্যদিনের কার্যলিপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আমি রাদিয়াহ সারওয়া। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে অধ্যয়নরত। গল্প লেখার পাশাপাশি কবিতা এবং দু-চারটে লাইন লিখে থাকি। মূলত শিক্ষামূলক এবং সামাজিক লেখার প্রতি আমার আগ্ৰহ বেশি
0 Comments