

স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ারটা করে রোজ দুপুর পোনে দুইটা নাগাদ খাবার আসে।খাবারের স্বাদ অতুলনীয়, কে বা কারা রান্না করে সেটা জানা নেই।খাবার টা খেয়ে বারবার মায়ের মুখটা মনে পরলেও,বাস্তবে মাকে দেখতে কেমন, সেটা অজানা শর্মিষ্ঠার।বাবা-মায়ের সেপারেশন হয়েছে যখন ওর বয়স ৩। মায়ের সাথে নিয়ে যেতে দেয় নি বাবা।এটা ছিল বাবার একটা শর্ত,হয় আমার সাথে থাকো নাহয় মেয়েকে ছাড়ো। মা চেয়েছিলো,মেয়েকে নিয়েই বাবাকে ছাড়তে। শর্ত দেওয়ার কিছু দিন পরেই বাবার জন্য নতুন পাত্রী দেখা শুরু করে ঠাম্মী।বাবার সে বিয়েটা হয় নি কেন জানি। দাদুবাড়ি থেকে মাকে নাকি এক রকম জোর করেই নিয়ে গিয়েছিলো।শর্মিষ্ঠার ছোট বেলা বলতে, দুতলা বাড়ির দক্ষিনমুখো ঘরটাই,ঘরে মায়ের কোলে অন্নপ্রাশনে তোলা একটা সাদা-কালো ছবি ছিল।মায়ের মুখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো সেখানটাই।মাধ্যমিক দিয়েই শহরে চলে আসে শর্মি।এখন একটা ছোট্ট পার্টটাইম চাকরি আর পড়াশোনা একসাথে চালিয়ে নিচ্ছে ।বাবার সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে, বছরে একবার পূজোয় বাড়ি যাওয়া হয়,ওই দু-তিনদিন সময় কাটানো। এতে অবশ্য শর্মি বা তার বাবা,কারোরই কিছু যায় আসে না। যত বড় হয়েছে শর্মির কাছে মনে হয়েছে, সমাজে টিকে থাকতেই বাবা তাকে রেখেছেন। অন্যথায়, স্নেহ,মায়া মমতা উনার ভিতর তেমন নেই।শহরে মেয়ে কেমন আছে,বেঁচে আছে কিনা সেসবের খোঁজ উনি কোনকালেই নেন না। আর আত্মীয় স্বজন? তারা বহুদিন আগেই,শর্মির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে, হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।প্রথম প্রথম শহরে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হলেও,একটা সময় পর,এই শহর ছেড়ে তার যেতে ইচ্ছা করে না। যে বাড়িতে সে থাকে, বেশ পুরোনো বাড়ি।বাড়ি নই বরং বৃদ্ধাশ্রম বললে ভালো হয়।এই বিশাল শ্যাওলা পরা বাড়িটায়,৪তলা।একেক একেক তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট। তবে শর্মি থাকে চিলেকোঠার ঘরে। ওখানটাই একটা রুম খালি ছিল।এই বাড়িটাই তার অনেক সময় কেটেছে,কিন্তু কারো সাথে তেমন আলাপ নেই।এই বৃদ্ধাশ্রমটা স্বেচ্ছাসেবীদের অর্থে পরিচালিত হয়। বিভিন্ন সময় নতুন নতুন বৃদ্ধাদের আগমন ঘটে। বক্সটা নেন বলে দুবার টোকা দিয়ে চলে গেলে ১৪/১৫ বছরের ছেলেটা। দরজা খুলে শর্মি খাবার টা নিলো। এখানে তিনটা স্টিলের বক্স,দুটোয় তরকারি, বাকি একটাই ভাত।খাবার গুলো মুখে দিলে, শর্মির চোখ থেকে জল পরে, স্কুল-কলেজে যখন সবাই মায়ের বানানো টিফিন আনতো,বেঞ্চের এককোনায় বসে প্যাকেট থেকে কেক,বিস্কুট বের করে কুটকুট করে খেতে সে।সবাই যখন মায়ের হাতের রান্না নিয়ে গল্প করতো, সে গালে হাত দিয়ে শুনতো। সবাই তো বলেই বসতো,তুইও কিছু বল,আবার হেসে হেসে বলতো ও কি করে বলবে, ওরা মা ওকে ফেলে চলে গেছে। ভাতের বাটিটা উপুড় করে সব ভাত পাতে নিলো ।ছোট চিংড়ি দিয়ে আলু,পটলের তরকারি, অন্য বাটিতে পাঁচমিশালি মাছের একটা আইটেম। ঢাকনা খুললেই এত ঘ্রাণ আসে,তাতেই পেট ভরে যায়। বিকাল ৫ টাই টিউশন, খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ শুয়ে না থাকলে শরীর খারাপ করে শর্মির।ঘুমিয়ে পরলো সে,ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন! দেখলো,তার রুমে থাকা ছবির মধ্যে থেকে মা বেরিয়ে এসেছে,শর্মির গালে একটা চুমু খেয়ে বললো আয় খুকী তোর চুল বেঁধে দি।হঠাৎ বাবার গলার আওয়াজে ছুট্টে গেলো সে,বাবা নতুন জামা এনেছেন। সে জামা পরে, চুল বেঁধে, মা-বাবার সামনে ঘুরেঘুরে নাচছিলো মেয়েটা,হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পরে যায়।ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠে, তখন ৪.৫০। এমন অবাস্তব স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পরলো টিউশনির জন্য। বাড়িটাতে একজন নতুন বৃদ্ধা এসেছে,ভ্যানে করে মালামাল তুলছে। শর্মি একবার তাকালো সেদিকে,দেরি হয়ে যাওয়ায় তড়িঘড়ি করে বের হয়ে পরে।এই বাড়ির যিনি দারোয়ান, খুবই রাগী মানুষ। মাঝেমধ্যেই শর্মির সাথে ঝগড়া করে, সময়মতো না ফেরা নিয়ে, লোকটা তার চাকরির খাতিরে করলেও,শর্মি কখনো কিছু বলে না।তার বাড়ি ফেরা,না ফেরা নিয়ে কারোর তো কোনো চিন্তা নেই,উনি অন্তত একটু বকাঝকা করে এটাই তার কাছে ভীষণ ভালো লাগার।যে ছেলেটা খাবার দিয়ে যায়,আজকে তাকে দোতলার একটা ঘর থেকে বের হতে দেখে, ভাবলো হয়তো এই ঘরে খাবার দিয়ে তার ফ্ল্যাটে যাবে। খাবার টা নেন, বলেই এক মিনিটও দাঁড়ায় না সে,কিন্তু আজ দরজায় টোকা দিয়ে হাতে হাতে খাবার বুঝিয়ে দিলো।তোমার নাম কি? সাজু।আপনের?শর্মিষ্ঠা।ওও,ভালা নাম।তোমার বাড়ি কোথায়?বাড়ি নাই,আপনাদেরকে এখানে, আরো দুইটা অনাথ-আশ্রমে খাওন দি,যেখানে পারি থাইকা যায়।তই এহন আমার কষ্ট কমছে,আপনাদের এখানে যিনি খাওয়ন দিতো,উনারে বাড়ি থাইকা বাইর কইরা এহানে দিয়া গেছে,অহন থাইকা উনি এহানেই রানবো,দুই তলায় আছে উনি।বের করে দিয়েছে?কেন?তুমি কি উনাকে চিনো নাকি?ধুরু কেন বাইর করছে,আমি কেমনে কমু।হ চিনি,উনি সব জায়গায় খাওয়ন দেয়।ছেলেটা চলে যায়।খুব ইচ্ছা করছিলো রাঁধুনি মহিলাটিকে দেখার, এত সুস্বাদু রান্না করে যিনি।আজ যাবো, কাল যাবো করে আর যাওয়া হচ্ছিলো না তার।একদিন টিউশনি থেকে ফিরতে, দেখা করতে গেলো,দরজায় টোকা দিলো।মলিন চেহারার, চামড়া কুঁচকানো,কপালে ভাঁজ পরা,জীর্ণশীর্ণ শরীরের এক বৃদ্ধা দরজা খুলে বললো,কাকে চাই?কাউকে চাই না,আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।আমার সাথে কিসের দরকার?কোনো দরকার নেই,এমনি।ভেতরে আসবো?মনে হলো যেন অনিচ্ছাসত্ত্বে মহিলা তাকে ভেতরে বসালো।কি বলে কথা শুরু করলে সবকিছু সুন্দর দেখায়,শর্মি তা জানে না,তাকে কেউ শিখায় নি।ছোটবেলা থেকে একা মানুষ হওয়ায়,খুব চুপচাপ থাকে সে।আপনার রান্নাগুলো খুব মজা খেতে।ভ্রু কুঁচকে বৃদ্ধা বলে, তুমি কি করে জানলে আমি রান্না করি?না শুনেছি আমি।শর্মির মনে হলো,এই মহিলা বোধহয় খুব নটঘটে টাইপ।সে বেরিয়ে গেলো।ঘরে ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসলো।ট্রাংকটা খুলেই মায়ের ওড়নাটা বের করে জড়িয়ে ধরে সে।তখনই দরজায় টোকা পরে। চোখ মুছে দরজা খুলতে দেখে,বাচ্চা ছেলে একটা টিফিন বক্স নিয়ে বললো,নেন, আপনার জন্য ওই বুড়িমা দিছে।কি আছে এতে?আমি কেমনে কমু কি আছে, খুইলা দেহেন।বক্সটা খুলতেই,পায়েসের মিষ্টি ঘ্রাণ, আহ!কতদিন পরে। লাস্ট খেয়েছিলো,গত পূজোয়। বৃদ্ধা মহিলাটার প্রতি কেমন একটা কৃতজ্ঞতা কাজ করছে তার,বাটিটা ধুয়ে দিয়ে আসতে গেলো।আবার কি চাই?বৃদ্ধা দরজা পুরো না খুলেই জিজ্ঞেস করে।বাটিটা,,,,,,,হ্যাঁ, রাতের খাবারের সাথে দিয়ে দিলেই তো হতো,এই বলে বাটিটা নেয়।শর্মির খুব খারাপ লাগে, সে কখনোই কারো ঘরে যায় না,এই প্রথম কারো সাথে কথা বলতে এলো,সেখানেও অপমান।চলেই যাচ্ছিলো, মহিলাটি তাকে ডাক দিয়ে বলে, এই মেয়ে শুনো।হ্যাঁ বলুন,তুমি কি রান্না পারো না?না, শিখা হয় নি।ঠিকাছে, কাল থেকে আমার কাছে শিখবে,দু একটা করে, কেমন? কেন জানি না,শর্মির মনের ভেতর একটা ঝলক বয়ে গেলো,খুশির ঝলক,মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো সে।সেদিন রাত ২ টা নাগাদ জ্বর এলো তার।কি জ্বর, কি জ্বর! গা পুড়ে যাচ্ছিলো।সারারাত ছটফট করে কাটালো,দরজায় টোকা পরলো,খাবার লন।খাবার সে নিতে পারে নি,বিছানা থেকে উঠার শক্তি নেই।রাত বাড়তেই জ্বর বাড়তে লাগলো,গলায় শুকিয়ে কাঠ,একটু জল পেলে ভালো হতো।হঠাৎ কে যেন তার মুখে জল দিলো, কাতর চোখ জোড়া খুলে সে বললো,\"মা\"!তারপর মাথায় জল দেওয়া,গা মুছিয়ে দেওয়া হতে শুরু করে সব,জ্বরের ঘোরে সে ধরেই নিলো,এটা অবশ্যই মা।জ্বর ছাড়লো,পরদিন সকাল ৭.৪০ মিনিটে।চোখ খুলে দেখে বৃদ্ধা মহিলাটা,তার খাটের এক কোনায় বসে আছে। সে উঠে বসে,বৃদ্ধা নড়েচড়ে উঠে বলে, এই মেয়ে ঘুম ভেঙেছে?উঠে কিছু খেয়ে নিবি আয়। সে বুঝতে পারে, কাল রাতে মা নই,এই ভদ্রমহিলা ছিলেন।দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে একা একা শুয়ে ভাবছিলো শর্মি।এই প্রথম কেউ তাকে এত যত্ন করলো,মাথায় জল দিলো,জলপট্টি দিলো।তার মনে আছে, যখন সে কলেজে পড়তো,ভীষণ জ্বর হয়েছিলো,সারারাত ছটফট করেও এক ফোটা জল পাই নি।পরের দিন,হোস্টেলর আয়া এসে দেখে সে অজ্ঞান, তারপর ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার কেন জানি মনে হলো-\"মা থাকলে মনে হয় এভাবেই যত্ন করে \"।শরীর একটু ভালো লাগতেই সন্ধ্যা করে সে ভদ্রমহিলার ঘরে যায় ,জিজ্ঞেস করে উনি কি করে জানলো সে অসুস্থ? তোর ঘরের বাইরে খাবার পরে ছিল,সাজু এসে বলে,তারপর গিয়ে দেখি তোর দরজা খোলা।শর্মির মনে ছেলেটা তাকে খাবার দিতে এসেছিলো।আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন,অনেক ধন্যবাদ। ওসব ধন্যবাদ দিয়ে কি হবে বাপু?চোখের সামনে তো আর কাউকে মরতে দেখতে পারবো না। শর্মি হেসে দেয়,ভদ্রমহিলা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। শর্মি হাসতে হাসতে বলে, আপনার আমাকে রান্না শেখানোর কথা ছিল।কখন থেকে শেখাবেন? ও শেখাবো নে,আগে তুই ভালো হ মেয়ে। আজকে বৃদ্ধাকে অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, বেশ হেসে হেসে কথা বলছেন। এরপর থেকে রোজ সন্ধ্যায় দোতলায় চলে যায় শর্মি,রান্না শেখাটা তো উছিলা মাত্র।ভদ্রমহিলার সাথে সময় কাটানো, হাসাহাসি করা,গল্প করা,সব মিলিয়ে বেশ ভাব হয়ে যায়। এর মধ্যে একদিন কথার ছলে তিনি বলেই ফেলেন, কেন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। \" মা মারা যাওয়ার পরে, কদর করার কেউ ছিল না। মাথা গুঁজার জায়গা নেই দেখে,ভাই,ভাইয়ের বউদের আশ্রয়ে ছিলাম। তাও বিনেপয়সাতে না,কিসব হোম ডেলিভারি করতো।আমার রান্নার হাত ভালো বলে সারাটাদিন চুলোর ধারে বসিয়ে রাখতো। আমিও তো বুড়ো হয়েছি,সবসময়ই পারি না। একদিন শরীর খারাপ হয়ে পরে, ডাক্তার আনে।কোনো কাজ করতে মানা করে দেয় ডাক্তার।তাও যেতাম উনুন ধরাতে,অল্পস্বল্প রান্নার যোগান করতে পারলেও।দিন-রাত খাটার মতো শক্তি আর নেই। আর কি,রেখে গেলো এখানে।পর্যাপ্ত ইনকাম না করে বসে বসে কি আর খাওয়া চলে? শর্মির চোখে জল,সে জড়িয়ে ধরে বললো তুমি তো এখনো রান্না করো,কষ্ট হয় না?নারে বোকা মেয়ে,১০ জনের দুইবেলার রান্না,আর ১০ বাড়ির দুইবেলা রান্নায় অনেক ফারাক\"।কেমন একটা মা-মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। শর্মির অবসর সময় এই বুড়ির কাছেই কাটে।হাসাহাসি, খুনসুটি, খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে শর্মি যেন মায়ের কাছে আছে। সব হয়তো এভাবেই আগাতো।কিন্তু সেদিন,,,,,ভদ্রমহিলা, ট্রাংক খুলে শাড়ি বের করছিলো। হঠাৎ,,,, শর্মির চোখে পরে একটা ছবি,একটা ফটোফ্রেম। সেই একই ফটোফ্রেমটা তার কাছেও আছে।অন্নপ্রাশনে মায়ের কোলে বসা ছবিটা।শর্মি জানতে চাইলো,ওইটা কার ছবি?বাচ্চা মেয়েটা কে?ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি করে লুকিয়ে বললো,কেউ না,কেউ না।নিজের ঘরে চলে এলো সে,বুকটা কেমন ভারী-ভারী লাগছে,দম আটকে আসছে। ওই দোতলায় থাকা মহিলাটা,আমার মা?ট্রাংক থেকে ছবিটা বের করে হু হু করে কাঁদছিলো সে। অপেক্ষা করলো,একদিন, দুইদিন,তিনদিন এভাবে এক মাস।কত চেষ্টা করলো,মায়ের মুখ থেকে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের গল্প শুনতে, সব জানতে। অপেক্ষা করলো একবার মা যদি বলে, জানিস আমারও একটা মেয়ে ছিল,এই দেখ ছবিটা।ওমনি সে জড়িয়ে ধরে বলবে,এক দেখো আমার কাছেও আছে,আমি তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটা।কিন্তু না,মা বলে নি একবারের জন্যও।যেন এক অজানা ভয়,প্রকাশ করলেও যেন ভয়। শর্মির বিশ্বাস হচ্ছে না,এটা তার মা,এত বুড়ো হয়ে গেছে। যদিও মায়ের মুখের লাবন্যতা তার মনে নেই।তার খুব ইচ্ছা করছে জানতে, প্রশ্ন করতে, অনেক প্রশ্ন। \"আমায় ফেলে কেন চলে গিয়েছিলে মা?তুমি জানো,তুমি যাওয়ার পরে কেউ আমাকে ভালোবাসে নি,কেউ কোলে নেয় নি,কেউ চুমু খায় নি।সবার মা ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতো,কত কাটা ফুটেছে হাতে কেউ খাইয়ে দেয় নি আমায়।টিফিন পিরিয়ড সবার মায়ের হাতের রান্নায় ক্লাসরুমটা ম\'ম করতো। আমার অসুখ হতো, নিজেই নিজের যত্ন নিতাম।আমার সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোতে কেউ পাশে থাকে নি।যেদিন টিউশন স্যার আমায় খারাপ স্পর্শ করলো,আমি কাউকে বলতে পারি নি মা।রাতে যখন ঘুম ভেঙে যেতো,কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি।কেউ আমাকে সাহস দেয় নি কখনো। সবাই হাসতো,তুমি নাকি আমাকে ফেলে চলে গেছো। বাবা কখনো আমাকে বুঝে নি,কখনো আমার আঙুল ধরে স্কুল নিয়ে যায় নি,কখনো আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে নি,\" আমি আছি তোর সাথে \"।কেউ আমার বন্ধু হতো না,ওদের ঘরে মানা করে দিতো আমার সাথে না মিশতে। তোমরা আলাদা হয়ে নিজের মতো করে বাঁচলে,আমায় কেন সুস্থ জীবন দাও নি মা?সবার মা চুল বেঁধে দিতো,আমি রোজ রাতে প্রার্থনা করতাম,বিশ্বাস করতাম ম্যাজিক করে ঈশ্বর তোমায় এনে দিবে, তুমি আমায় বিনুনি করে দিবে। কিন্তু ঈশ্বর ম্যাজিক করে নি।আমায় ফেলে কেন চলে এলে? আমায় সাথে আনলে না কেন?সাথেও আনো নি,কখনো একটু দেখাও করো নি। আমার মিষ্টি শৈশবটা তোমরা নষ্ট করে দিলে।তোমাকে ঘিরে কোনো স্মৃতি তৈরি হতে দিলে না কেন মা?মাকে নিয়ে গল্প করার মতো সুযোগ দিলে না কেন? প্রশ্নের শেষ নেই আজ,কিন্তু সে কোনো প্রশ্নই করে না মা তো তাকে সামনেই আনতে চান না।শর্মি সিদ্ধান্ত নেয়,সে চলে যাবে এই বাড়িটা ছেড়ে। পরদিন সকালে বাড়ির মালিককে সে মিথ্যা বলে, তার অন্য জায়গায় চাকরি হয়েছে, যাতায়াতের সমস্যা হচ্ছে,বাড়িটা সে ছেড়ে দিবে। দুইদিন পর সে বাড়ি ছেড়ে দেয়,অটোরিকশায় উঠে পরে। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করে কই যাবেন আপা?কোনো উত্তর না পেয়ে নিজ মনেই বলে, মনে হয় মাথায় সমিস্যা আছে। একটা পিচঢালা রোড,সুনসান চারদিকে, একটা টংয়ের দোকান।দাঁড়ান,টাকা বের করে দিলো রিকশাওয়ালাকে।রাস্তার পাশে একটা কাঠের বেঞ্চ,সেখানে গিয়ে বসলো শর্মি।হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো - অর্জুন মল্লিক। ইনি শর্মির জন্মদাতা পিতা,কখনোই মেয়েকে ফোন দেয় না।শুধু তখনই দেয়,যখন গ্রামে কোনো নিমন্ত্রণ বাড়িতে উনাকে যেতে বলে। ফোন দিয়ে টাকা চাইবে,অমুকের ছেলের অন্নপ্রাশনের দাওয়াত, টাকা পাঠাস,কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে।শর্মি জানে আজও হয়তো, কারো বিয়ে বা অন্নপ্রাশন, অথবা উনার ওষুধ শেষ। ইনি কখনো জিজ্ঞেস করে নি,কিভাবে টাকা কামায় সে,কোথায় থাকে সে? মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো, পরপর তিনটে কল আসে, শর্মি মোবাইলটা বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রেখে স্বস্তির একটা হাসি দেয়।অপরদিক থেকে মল্লিক বাবু শুনেন, আপনি যেই নাম্বারে কল করেছেন,সেটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।এই রোডে রোদ পরে না,মায়ের মতো বড় বড় গাছগুলো ছায়া দিয়ে আগলে রাখে পথচারীদের। শর্মি এগুচ্ছে,জানে না কোথায় গিয়ে থামবে। অন্যদিকে, সাজু টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ভদ্রমহিলার কাছে এসে বললো,বুড়িমা ওই দিদিটা নাই ঘরে, মনে হয় চাকরিতে গেছে। ভদ্রমহিলা হাসে,চাকরিতে যায় নি,ও চলে গেছে, আর আসবে না কখনো।আপ্নে কেম্নে জানলে বুড়িমা?ভদ্রমহিলা, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাতেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো চোখ থেকে। তোর যেদিন ওমন জ্বর বারবার \"মা,\" মা\" করছিলি,আমি তো তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, মা নেই তোর।কিন্তু আমি তখনও জানতাম না,তুই আমারই মেয়ে।ট্রাংক থেকে তোয়ালে বের করতে গিয়ে যখন ফটোটা দেখলাম,দুনিয়াটাকে বড্ড ঘেন্না লাগছিলো আমার। বিছানায় শুয়ে তুই যখন কাতরাচ্ছিলি, ইচ্ছে করছিলো,তোকে জুবুথুবু করে কোলে নিয়ে বসে থাকি,সেই ছোট্টবেলার মতো। এত অবিচার করার পরেও,তুই আমার ছবিটা রেখে দিলি এত যত্নে! আমি তো তখন থেকেই জানি, তুই আমার শমি। আমি কখনো চাই নি,তুই আমাকে যেন চিনতে পারিস, জানতে পারিস।দূর থেকে তোকে আদর করবো,ভালোবাসবো।শেষ বয়সে এসে অন্তত তোকে কাছে পেয়েছি এটা নিয়েই তো গদগদ হয়েছিলাম খুশিতে। কিন্তু ঈশ্বর চান নি,আমি খুশি থাকি।ঠিক তুই জেনেই গেলি,আমি সে মা,যে কিনা তোকে ফেলে চলে এসেছিলাম।আমি অপেক্ষা করেছিলাম তোর জন্য ২৩ বছর। যখনই অপেক্ষা ফুরালো, আমি দূর্বল হয়ে পরলাম,ভয় পেয়ে গেলাম।তোর মুখোমুখি হওয়ার মতো সাহস আমার নেই।তোর অপেক্ষা আমি বুঝেছি,আমার মুখ থেকে সব শুনতে চাওয়ার আকুলতা আমি অনুভব করেছি।কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি চাই নি,তুই আমার কাছে থাক,আমাকে প্রশ্ন কর,আমার জড়িয়ে ধর।সারাজীবন কোনো মমতা,দায়িত্ব পালন না করে এখন এসে দায়িত্ব নেওয়ার মুখ নেই আমার। আমি জানতাম,তুই চলে যাবি,চলে গেলেই তুই ভালো থাকবি।আমি চাই তুই অভিমান কর,সেসমস্ত অভিমান ঘেন্নায় রূপ নিক,তুই আমাকে ঘৃণা কর আমি চাই। শর্মিষ্ঠা মল্লিকের নিষ্ঠুর মা মীনাক্ষী মল্লিক সর্বদা সবার নিকট একজন অমানুষ হিসেবে বেঁচে থাক। তখন গোধুলি,আকাশ জুড়ে সোনালী রঙের আভা আর আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলা।শর্মি হাঁটছে,সে জানে মা তাকে খুঁজবে,কে জানে হয়তো কাঁদবে।তবে উনি কখনোই জানবেন না,শর্মি উনার মেয়ে।মা কাঁদছে,সত্যিই কাঁদছে,ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। শর্মির দেখলো দুটো ছেলে,ছোট একটা কুকুরছানা নিয়ে দৌড়াচ্ছে,পেছন পেছন মা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছে।বাচ্চা দুটোর পথ আটকে দাঁড়ালো সে। আরে সরেন সরেন আপু,পেছনে কুকুর, কামড়ে দিবে।দুইজনের হাত ধরে ফেলে সে।চলো তোমরা, আজকে থেকে আমার সাথে থাকবে। বাচ্চা দুটো ভয়ে আঁতকে উঠে,আপনি কি ছেলেধরা? উম,ছেলেধরা না,বাচ্চাধরা,ছেলে মেয়ে সবাইকে ধরি।আমরা কিন্তু মাকে বলে দিবো।শর্মি জিজ্ঞেস করলো,কুকুর কেন তাড়া করছে?আরে কুকুরের বাচ্চা আছে ৬ টা, আমরা একটা পালবো,সেজন্য নিছি।এজন্য তাড়া করছে। আচ্ছা,তোমরা কি ভাই? উত্তর এলো তারা দুই ভাই।শর্মি বলে,চলো তোমাদের একজনকে আমি পালবো,বাকি একজন তো আছোও। না না, আমরা মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না, খাইতে পারি না। আপনি কে,চিনি না জানি না,কেন যাবো?তোমরা মাকে ছাড়া থাকতে পারো না,খেতে পারো না, অপরিচিত কারো সাথে যাও না।অথচ বাচ্চা কুকুরটাকে ওর মায়ের থেকে নিয়ে পালাচ্ছো,সেও তো ছোট, কি করে থাকবে মাকে ছাড়া।তোমরা তো অপরিচিত। ছেলে দুটো একে অন্যর দিকে তাকিয়ে কুকুর ছানাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। মা কুকুরটা ছুটে আসে,বাচ্চার কাছে, জিহবা বের করে পুরো শরীরে বুলাচ্ছিলো বাচ্চার। ছোট্ট বাচ্চাটা লেজ নেড়ে, বুঝিয়ে দিচ্ছিলো সে কতটা খুশি। শর্মি তাকিয়ে দেখছে, মা কিভাবে আদর করে। হঠাৎ মনে হলো, কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, কৃতজ্ঞতা নিয়ে, যেন চোখে জল টলমল করছে। সেও তাকালো কৃতজ্ঞতা নিয়ে, এই অবলা প্রানীটি শর্মির চোখে কৃতজ্ঞতা বুঝলেও,কারণ কখনোই বুঝবে না। শর্মি চাইও না কেউ তাকে বুঝার চেষ্টা করুক,কেউ তাকে ভালোবাসুক,কেউ তাকে জড়িয়ে ধরুক।সে হাঁটতে লাগলো, কুকুর গুলোও তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।একবার পেছন ফেরে দেখে সে,আর মনে মনে বলে, Leave me alone . I will become the most selfish person from today.এরা ইংরেজি বুঝে না,বাংলা বুঝে না,এরা মূর্খ।মা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করলে,বাচ্চাগুলো অপরিপক্ক গলায় কেঁউকেঁউ করে উঠে।
0 Comments