পরিনতি মিষ্টার পার্থ সেন শহরের নামকরা এক ব্যাবসায়ী।কি নেই উনার!গাড়ি,বাড়ি সব।টাকার বিছানায় ঘুমানো যেন উনার অভ্যাস।উনার স্ত্রী মিসেস সেন নিজেই একজন সফল বিজন্যাসউইমেন।বলা বাহুল্য তাদের বিশাল অট্টালিকায় তারা দুজন ব্যাতিত কেউ থাকে না।দারোয়ান, মালি,কাজের লোক আছে অবশ্য।তবে নিজের বলতে মিষ্টার আর মিসেস সেন। এই কোটিপতি দম্পতি দূর্ভাগ্যবঃশত নিঃসন্তান।বাহ্যিকভাবে,সেন দম্পতিকে যেন আর্দশের প্রতিমূর্তি বলা যায়।সদা হাসৌজ্জ্বল,পরোপকারী দুইজন কে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আপনা-আপনি।পরিচালনা করে দুখানা বৃদ্ধাশ্রম,তিনটা এতিমখানাও।রোজ শুক্রবার,নিজেদের চালিত আশ্রম গুলো ঘুরে বেড়ানো টা সেন দম্পতির নিয়ম বলা যায়।যদিও তাদের ঘুরার জন্য জায়গার অভাব নেই,দেশ-বিদেশে ঘুরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এই তথাকথিত আর্দশ দম্পতি। আজ উনাদের ২০ বছরের বিবাহবার্ষিকী।সেই উপলক্ষে এতিমখানা আর বৃদ্ধাশ্রমে বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজন চলছে।সেন গিন্নি নিজে হাতে পরিবেশন করবেন আজ।একেকটা বছর পূর্ন হয়, আর গিন্নীর চোখের জল শুকিয়ে আসে,আর কত কাঁদা যায়?একটা সন্তানের জন্য দেশ-বিদেশের ডাক্তার, তাবিজ-কবজ কি করেন নি উনারা?কিন্তু কি জানি স্রষ্টা কেন নারাজ?সেই যাইহোক, সেদিন বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে, যথারীতি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলেন তাঁরা।কিছুটা সময় সেখানে কাটানোর পরে এতিমখানার উদ্দেশ্য বের হবেন,ঠিক সেই সময় পার্থ সেনের চোখ আটকে যায়।গেটের বাইরে এক বৃদ্ধা,জীর্ন শরীর,ছেড়া শাড়ি,ভাঙা একটা থালা হাতে ভিক্ষা করছেন।মিষ্টার সেনের বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো। কি দেখছেন উনি?উনার স্ত্রী এসে ধাক্কা দিয়ে বললো, কি হলো চলো?দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্ত্রীকে আঙুলের ইশারায় বৃদ্ধা টিকে দেখালেন পার্থ সেন। দুজনেই যেন থ হয়ে গেলেন। বৃদ্ধার চোখ পরলো উনাদের উপর।দূর্বল শরীরে এগিয়ে এসে,স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন মিষ্টার সেনের গালে।ভালো আছিস বাজান?মিষ্টার সেনে সামনে ভেসে উঠলো সে ২০ বছর আগের স্মৃতি, যেদিন উনি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছিলেন। নতুন বউয়ের উনার মা বাবার সাথে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে বলে,সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিলেন।ভুলে গিয়েছিলেন বাবা মারা যাওয়ার পরে উনার মায়ের করা প্রতিটি ত্যাগের কথা।কি করে মানুষের বাড়িতে দিনরাত কাজ করে উনাকে পড়াশুনা করিয়েছিলেন।ব্যাস,সেদিন যে বের হয়ে আসলেন,আর কখনো খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি।বুড়ি মা টা কি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন?আজ এত বছর পরে দেখে,সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো।পার্থ সেনের স্ত্রী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো,হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো তিনি।বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,মা তুমি এখানে?একগাল হেসে উত্তর দিলো,সেকি মা বলে ডাকছিস যে?মা, ডাকিস না রে বাজান,ওই ডাকের মূল্য বুঝিস না তো তুই।আজো সেই ছোট্ট টি রয়ে গেলি,মূল্য বুঝতে পারিস না কিছুর।পার্থ সেন চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন মায়ের দিকে। কিছু বলার জন্য কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিরবতা ভেঙে বৃদ্ধা বললো,তা তোর ছেলে মেয়ে কই রে বাজান?দূর থেকে দেখা তো একটু।মাথা নিচু করে উত্তর দিলো পার্থ, আমার কোনো সন্তান নেই মা।ফোকলা দাঁতে ফিক করে হেসে উত্তর দিলো বৃদ্ধা, উপরওয়ালা কথা শুনেছে,আমি চাই নি রে বাজান,তুই ও আমার মতো কষ্ট পা কোনোভাবে।আফসোস করিস নে সন্তান নেই বলে।থাকলে হয়তো আজ তোর পরিনতি ও আমার মতো হতো ।এই কথা বলে বৃদ্ধা হাঁটা ধরলো বিপরীত মুখী হয়ে।মিষ্টার আর মিসেস সেনের মুখের বুলি যেন আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো,চোখ দুটো আজ বাঁধ ভেঙেছে তাদের। ডাকতে গিয়ে ও \"মা\" বলে ডাকতে পারলো না। গ্লানিবোধটুকু আজ দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে তাদের।
0 Comments