

ফোনের রিং বেজেই যাচ্ছে,,,আশুতোষ জানে কে ফোন করছে।এই ফোনটার অপেক্ষা কখনোই করতে হয় না।না চাইলেও রোজ ৪/৫ বার করে তো ফোন আসবেই।প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে কলটা কেটে,সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রেখে দিলো সে।তখন ঘড়িতে বাজে সকাল ১০ টা।সকালে না খেয়েই ভার্সিটি চলে যাওয়ার এক বাজে অভ্যাস আশুর।ক্যাম্পাসের হাবিজাবি খাবার কিনে খেয়ে দিন পগারপার। সেইম নাম্বার থেকে আবার ফোন আসে,তখন ক্লাস চলছিলো।রিংটোনের শব্দে স্যার বিরক্ত হয়ে বললো,নূন্যতম ম্যানারস না জেনে ভার্সিটি ভর্তি হও কেন তোমরা?সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে কল ব্যক করে যা নয় তাই বলা শুরু করে দিলো - তোমার কি বোধবুদ্ধি হবে না? সারাদিন কল দাও,সময় বুঝো না,পরিস্থিতি বুঝো না।এত কল দেওয়ার কি আছে? তোমার জন্য আজকে ক্লাসে স্যারের কথা শুনতে হলো,এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে আমার মাথা হেট হয়ে গেলো,কি জানতে চাও বলো?সকাল থেকে নাহয় তুমি ১০ বার ফোন দিয়েছো।অপরপ্রান্ত থেকে একটা কোমল কন্ঠ বলে উঠে, ভালো আছিস বাবা?তুই তো সকালে খাস না আলসেমি করে, তাই ভাবলাম মনে করিয়ে দি কিছু খেয়ে নে।তখন যে তোর ক্লাস ছিল জানতাম না,তুই তো আমায় বলিস না কখনো কিছু। আশুতোষ রেগে বললো-এইসব বলতে তুমি কল করেছো?তোমার কি কাজ নেই মা?এসব কোনো কথা হলো?নারীকন্ঠে কোনো ক্ষোভ নেই,শুধু মমতা।আচ্ছা বাবা আমার ভুল হয়েছে, এখন খেয়ে নে কিছু। মায়ের এই হেসেখেলে কথা বলাটা আজকাল বড্ড গায়ে জ্বালা ধরায়।সময় বুঝে না, পরিস্থিতি বুঝে না সারাক্ষণ ফোন দিয়েই যায়।খেয়েছি কিনা এটা জানতেও কেউ কেন ফোন দিবে?মায়ের সাথে কথা বলাটা আজকাল খুব বিরক্তির একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।সবচেয়ে বড় কথা, সারাদিন মায়ের এই ফোন বন্ধুমহলে \"মাম্মাস বয়\" বলে পরিচিত করে তুলছে আশুকে। তার উপর মায়ের আজগুবি সব প্রশ্ন,খেয়েছিস,ঘুম হয়েছে, পেট ঠিকাছে? এসব যখন পাশ থেকে বন্ধুরা শুনে হা হা করে হেসে উঠে। কি যে লজ্জা লাগে! রুমমেটরা তো প্রায় বলে, তোর উচিত আন্টির আঁচল ধরে ঠাকুরমার ঝুলি শুনা। মাকে কে বুঝাবে এই লজ্জার কথা।সেদিন তো বলেই বসলো, ও ম\'নাই তোর জন্য এবার বাড়ি আসলে কুমড়োশাকের বড়া বানাবো।পাশ থেকে বন্ধুদের হাসির শব্দে মা অপর পাশ থেকে বলে উঠলো, কিরে মনাই?হাসছে কেন ওরা?আশু ঘট করে কল কেটে দিলো,লজ্জায় যেন মাথাকাটা গেলো।প্রতিনিয়ত বাজে আচরণ করে মায়ের ফোন কেটে দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আশুতোষের জন্য। সেদিন,২২ই শ্রাবণ সকাল থেকে টানা বৃষ্টি। ভার্সিটি যাওয়ার জো নেই।নরম বিছানার গরম উমে আশুতোষ ঘুমুচ্ছে।সকাল থেকে মা ফোন দিবে জেনে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখেছে সে,মহা আপদ!কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে খেতে বলবে।ব্যাচেলর লাইফের ঘুম,সে কি আর ভাঙে!ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা ৭ টায়।গ্রাম থেকে শহরে আসতে প্রায় ঘন্টা তিনেক লাগে, তবুও মায়ের কাছে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।যাক সেসব,ঘুম ভেঙে মোবাইল হাতে নিয়ে আশুর চোখ কপালে মায়ের নাম্বার থেকে ৫০+ ফোন,শ্যামল কাকা ১০ বার ফোন করেছে,ছোট বেলার বন্ধু বিশু ১১/১২ টা কল দিয়েছে। গ্রাম থেকে এত ফোন এসেছে দেখে একটু ভয়ই পেয়ে গেলো সে।ঘটনা কি?মায়ের নাম্বার কল ব্যাক করতেই বিশু রিসিভ করে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে, এখন তোর সময় হলো? কি হয়েছে প্রশ্ন করতেই,এমন উত্তর পাবে কখনো ভাবে নি সে।অপরপ্রান্ত থেকে বিশু বললো আজ দুপুর ১২ টার দিকে মাসিমা মারা গেছে। তোকে সবাই মিলে কত ফোন দিলো,কতভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো, তুই যেন থেকেও নেই।তোর মা\'টা তোর জন্যই মরলো।তুই কল ধরছিস না দেখে ব্যাগ নিয়ে এই বৃষ্টি -বাদলের মধ্যে শহরের জন্য বের হয়,রাস্তায় বাজ পরে,উনি পথেই মারা যান। তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, এক সময় মোড়ল বললো দাহ করে ফেলতে, কারণ বৃষ্টি বাড়ছিলো। বিশু একটানা কথাগুলো বলছিলো। এক মূহুর্তের জন্য পৃথিবীটা যেন উল্টো হয়ে গেলো আশুর,মনে হচ্ছিলো শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ,ব্রেইন কাজ করছে না,গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না,কান থেকে মোবাইল নামানোর শক্তিটুকুনও পাচ্ছে না,সামনে যা দেখছে সব ঝাপসা,প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি হচ্ছে,সবকিছু ঘুরছে,উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না।অস্পষ্ট স্বরে একবার বললো, \" মা\"। নাজমুল ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো,হয়ছে টা কি?আমার মা\'টা না মরে গেছে রে।কি বলিস এসব,নাজমুল জিজ্ঞেস করে। তাড়াতাড়ি চল,বের হ।আশুতোষকে নিয়ে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিলো।পৌঁছাতে প্রায় রাত ১০ টা বেজে গেলো।ততক্ষণে সব শান্ত,ঘরে ঢুকে আশু দেখলো বারান্দার খাটটা ফাঁকা,রান্নাঘরটা ফাঁকা,পিছনের রুমটাও।বাড়ির উঠোনে বসে আছে বিশু,মোড়ল কাকা,আর উত্তরগ্রামের রহিমা খালা।আশুকে দেখে একরাশ ঘেন্নায় মোড়ল বললো, এতদিন মেলা আফসোস করতাম,আল্লাহ কেন একটা সন্তান দেয় না আমাকে, আইজ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়,হয়তো দিলে সে পোলা তোমার মতো অমানুষ হইতো।মোড়ল মনে হয় এই কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। বিশু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,তুই পারলি বন্ধু এমন টা করতে? তোর মা ছাড়া এই গেরামে আমার কেউ ছিল না,তুই পারলি আমার মা\'টারে মাইরা ফেলতে।প্রত্যেকটা দিন অপেক্ষা করতো,তুই আসবি,তুই ফোন করবি।এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তোর জন্য উঠোনে সবজি চাষ করতো।তোর কি কিচ্ছু মনে নেই,কিভাবে মাসিমা তোরে মানুষ করলো,তোর বাপ তো তোরে ৮ বছর বয়সে রেখেই মারা গেলো।তারপর থেকে শুধু তোর জন্য এই মহিলাটা নিজের সারাজীবন দিয়ে দিলো,কিছু মনে নেই?বিশুর চোখের জল শুকিয়ে গেছে,গলার আওয়াজ বন্ধ,বুকের ভেতর কেমন যেন করছে- মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে হৃৎপিণ্ডটায় আঘাত করছে। অনেক কষ্টে সে বললো-মা\'কে দেখবো একটু,শ্মশানটা কোনদিকে? বিশু,শ্মশানে এনে বললো,শেষ দেখাটাও তোর কপালে ছিল না,ভালোই হলো ভগবান তোর হাতে উনার মুখাগ্নি করায় নি,,একটা কথার উত্তর দে তো-শহরে গেলে কি মানুষ বাপ-মারেও ভুইলা যায়?ওই মরার শহরে কি মায়া নাই?সব সুনসান, কেউ নেই,গভীর রাত-মায়ের পোড়া দেহেটা মাটির নিচে,আর তাঁর অমানুষ ছেলেটা বসে আছে,একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আশুর খুব ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে, সে চেষ্টা করছে কাঁদার কিন্তু পারছে না। একটা ভীতু ছেলে পুরো রাত শ্মশানে বসে আছে, বাজ পরছে,বৃষ্টি বাড়ছে, মায়ের শ্মশানের উপর মোটা প্লাস্টিকের কাপড় দিয়ে আবরণ দেওয়া।আশু চাচ্ছিলো একটা বাজ পরুক,তার উপর, প্রচন্ড জোরে।আশুর মনে হলো,ওর চোখ থেকে জল পরছে কিন্তু বৃষ্টির জলে সব মুছে যাচ্ছে। মাথার উপর যেন কেউ একটা ছাতা নিয়ে দাঁড়ালো,উপরে তাকাতেই দেখলো,\"মা\"।বিশাল একটা কালো ছাতা নিয়ে আশুর মাথায় ধরে আছে আর বলছে - ঘরে যাহ বাবা,বৃষ্টিতে ভিজলে তোর জ্বর হয়,ঘরে যাহ,শরীর খারাপ করবে।প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠে ছেলেটা,তার আহাজারি যেন ঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী, চিৎকার করে কাঁদছে সে - মা,মা, ওমা বলে একটানা ডেকেই যাচ্ছে, কিন্তু মাটির নিচ থেকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আশু বলছে,আর একবার ফোন দাও তুমি, বিশ্বাস করো আমি সাথে সাথে ধরবো,তুমি যা বলবে তাই করবো,তুমি একবার ফোন দাও মা।কেউ ফোন দেয় নি,কেউ বাবা বলে ডাকে নি।নাজমুল এসে, আশুকে নিয়ে গেলো।ঘরে ঢুকেই আশুর মনে হলো,এই ঘরটা একটা প্রাচীন রাজবাড়ী । এই বাড়িতে যে রানী থাকতো,সে মারা গেছে,ঘরটাতে কোনো প্রাণ নেই,অস্তিত্ব নেই,মায়া নেই,মায়ের গায়ের ঘ্রাণ নেই,মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ নেই,আছে শুধু মায়ের শাড়ি,হাঁড়িপাতিল আর মায়ের হাতে গুছিয়ে রাখা আশুতোষের জামা-কাপড়।আশু পাগলের মতো মায়ের খাটে গিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগলো।নাজমুলের দিকে তাকিয়ে বললো,দেখ দেখ আমার মায়ের গায়ের ঘ্রাণ, কি মিষ্টি!কোথাও পাবি না!বছর ঘুরে নতুন বছর এলো- আশুতোষের চাকরি হলো,প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসে সে,নিজ হাতে মায়ের শ্মশানটা পরিষ্কার করে।মায়ের শাড়ি জড়িয়ে রাতে ঘুমুতে যায়,মায়ের পুরোনো চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়। বন্ধুমহলের কাছে সে এখন অগ্রহণযোগ্য, আধপাগল। নাজমুল ব্যাতিত কেউ তার সাথে কথাও বলে না। আশুর নিজ মনে কথা বলা,মাঝরাতে উঠে কান্না করা,হঠাৎ হঠাৎ এবনরমাল আচরণ সব মিলিয়ে এক অন্য মানুষ সে। সারাদিন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন অবশ্যই \'মা\' ফোন দিবে। আর সেদিন সে সাথে সাথে ফোনটা ধরে মায়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলবে।
0 Comments