(আমি মিষ্টু।আমার পরিচয়টা এখানে একদমই প্রয়োজনীয় না।আজকে একটা গল্প জানাবো, খুব সাধারণ গল্প।হতে পারে সবার সাথে মিলে যাবে। কিছু গল্প খুব কাঁদায়,আমিও কেঁদেছি আজ।দাদুবাড়ির পুরানো ট্রাঙ্ক ঘাঁটাঘাঁটি করে একখানা ডায়েরি পেলাম,আমার দিদার ট্রাঙ্ক নাকি এটা।ডায়েরিতে চোখ বুলাতে গিয়ে একটা টুকরো লাল কাপড়ে চোখ আটকে গেলো।ব্যস,পড়তে শুরু করলাম)ওই যে লাল শাড়িটা,বড্ড প্রিয়!সেদিন যখন ভাঙা টিনে জড়িয়ে ছিড়ে গেলো,টপটপ করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো চোখ থেকে। আমার সিঁদুর রঙা শাড়িটা।কি সুন্দর মোটা সোনালী পাড়!রোদে আমার শাড়িটা চকচক করতো।যখন আমি গায়ে হাওয়া লাগাতে বের হতাম, মাখনের মতো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে, মনে হতো ভাগ্যিস আমার একটা লাল শাড়ি ছিল!১২ হাতের একটা শাড়িতে এত মায়া লুকিয়ে থাকে, না ছিড়লে জানতামই না।মায়া!শব্দটা কেমন রহস্যময় না?মায়া মাথায় আসলেই মনে হয় চারদিকটা ধোয়া,আর মাঝে বসে আছে অসংখ্য মরীচিকা।এই শাড়ির গল্পটা কি শুধু আমার?লাল টুকটুকে শাড়ি, সোনালী পাড়ে কতশত স্মৃতি নিয়ে ঘুরে একটা মেয়ে সেকথা কি কেউ ভেবে দেখেছো?চুপিচুপি মায়ের আলমিরা খুলে,নাক ডুবিয়ে শাড়ির গন্ধ নেওয়া মেয়েটা একদিন ভাবে,কবে যে মায়ের মতো আলমিরা হবে!তারপর? টুক করে একটা শাড়ি নামাতে গিয়ে,মায়ের বকুনি দিয়েই শুরু হয় প্রতিটা মেয়ের \'প্রথম শাড়ি\'র গল্প।গায়ে শাড়ি জড়ানোর পর সেকি লজ্জা!নিজেকে আয়নায় দেখে,কখনো অপ্সরী,কখনো কারো ঘরনী কখনো বা কারো মা ভাবা মেয়েগুলোই একদিন বাস্তবেই সব ভাবনার সত্যি রূপে পৌঁছে যায়।তখন কিন্তু তাদের আর সত্যি টা ভালো লাগে না।এই যে লাল শাড়িটা, আলমিরার আশেপাশে ঘুরঘুর করে দেখতাম।কখনো সাহস করে হাত বুলাতে গিয়েই ভাবতাম,দিলুম বোধহয় ফেলে,এই এলো মা তেড়ে।তারপর,একদিন অন্য এক লাল শাড়িতে মুড়িয়ে মা পাঠিয়ে দিলো আমায়,নিজের আলমিরা গুঁছাতে।কান্না, সেকি কান্না!চাই না আমার লাল শাড়ি,লাগবে না আলমিরা।মা বুকে জড়িয়ে বললো,মা ও নাকি চায় নি কখনো।তারপর?মায়ের ওই যে,ভাতের মাড়ে মড়মড়ে লাল শাড়িটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলে।আমি আরেকবার \'লাল শাড়ি\'টা বুকের কাছে জড়িয়ে নাক চেপে গন্ধ নিলাম।কি সুন্দর ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ! আহা!সব গন্ধ ছাপিয়ে,একটা মা\'মা ঘ্রাণ নাক আসলো।এই ঘ্রাণ টা শুধু আমি পেতাম।ওই যে,রাতে মায়ের গা ঘেঁষে ঘুমানোর সময় যে ঘ্রাণটা আসে,মুখ ধুয়ে মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে গিয়ে যে ঘ্রাণটা পাও,ঘরে ঢুকে যে ঘ্রাণটা পাও। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সেই ঘ্রাণটার কথাই বলছি,তোমরা বুঝতে পারছো?ওটাই \'মা\'মা\' ঘ্রাণ।একদিন আমারও আলমিরা হলো,ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ আমার শাড়ি থেকেও বের হয়।আমি নাক ডুবিয়ে যেই গন্ধ নিতে যায়,মায়ের ঘ্রাণটা আর আসে না!তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে \'লাল শাড়ি\'টা নিলাম।আহ!কি মধু!কি মায়া!কি আদর আদর ছোঁয়া পাচ্ছি।আমি মায়ের গন্ধ পাচ্ছি! একদিন বিকেলে যখন জানালা খুললাম,দেখলাম গোলাপী বাগানবিলাসে পুরো শহর ছেঁয়ে আছে।জানো তো!ওই সোনালী পাড়ের লাল শাড়িটা মায়ের বড্ড প্রিয় ছিল।কখনো কাউকে হাত লাগাতে দিতো না। কত মিনতি করতুম,ও মা একটু পরিয়ে দাও! মায়ের ছাপ ছাপ কথা - না বাপু,আরো শাড়ি আছে ওখান থেকে একটা নিয়ে আসো পরিয়ে দি।কিন্তু এটা না।মনে মনে ভেঙচি কেটে মা কে বলতাম - নিজের মেয়েকেও দিতে চায় না,ইশ কেমন একটা মা জুটলো আমার!যেদিন মা আমায়, নিজের আলমারি গুছাতে পাঠিয়ে দিলো,হাতে ওই লাল শাড়িটা দিয়ে বলেছিলো,যত্ন করে রাখিস - এটা আমার মায়ের শাড়ি।তারপর থেকে আমি যত্ন শিখলাম। বিকালে একদিন মা কাঁদছিল দেখে,গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম - তোমায় সাজিয়ে দেই?তারপর সেকি হাসিঠাট্টা! সেই প্রথম মায়ের সোনালি পাড়ের শাড়ি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হলো আমার! ছুট্টে গিয়ে বাগানবিলাসের কয়েকটা পাপড়ি এনে মায়ের খোঁপায় গুঁজে দিয়ে ভাবলাম - একটা মানুষ এত সুন্দর কিভাবে হতে পারে! পান খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁট, আধপাকা চুল,সোনালী পাড়ের লাল শাড়ি পরে - একটা জ্যান্ত পরী দেখছিলাম আমি।আজ আবার চোখে পরলো,বাগানবিলাসের গোলাপী আভা।লাল শাড়িটা বের করলাম,মায়ের মতো করে সাজলাম। তবুও আমার অনেক খামতি। মাথায় দুটো ফুল গুঁজে নিয়ে আনমনে কথা বলতে বলতে ভাবলাম, মনে হচ্ছে মা আমায় জড়িয়ে আছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। ঘরে ফেরতে যাবো তখনই,জং ধরা টিনের খোঁচায় আমার মায়ের লাল শাড়ির খানিকটা ছিড়ে গেলো।চোখ আমার ঝাপসা হয়ে এলো, টলমল করে গড়িয়ে পরলো চোখের জল। টুকরো লাল কাপড়টা হাতে তুলে নিলাম। হাতে নিয়ে যা বুজলাম,শাড়ির আর দোষ কি - তিন প্রজন্মের শখ মেটাচ্ছে।শাড়িটা আলতো হাতে ভাঁজ করতে গিয়ে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে মা কে বললাম - যত্ন করে রাখতে পারি নি,কেন যে দিতে গেলে তোমার শখের জিনিসটা! আধপুরানো বাদামী ডায়েরিটা খুলে একটা স্যাপটিপিন দিয়ে টুকরো কাপড় টা আটকে নিলাম।তারপর? আমার মায়ের ঘ্রাণটাকে প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিলুম।মনে হলো,সোনালী পাড়ের লাল শাড়িটার কথা কি কেউ কখনো জানতে পারবে?কারো কি কখনো মনে হবে, এই শাড়িটা আস্ত একটা স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের চেয়ে কম নয়!কেউ কি কখনো বুঝবে, এটা মান্ধাতার আমলের শাড়ি ছাড়াও একগাদা আদরমাখা কোনো মায়ের গায়ের ঘ্রাণ!ডায়েরিটা খুলে গোটা একটা কাহিনি লিখলাম, নাম দিলাম - \"সোনালী পাড়ের লাল শাড়ি\" টুকরো লাল কাপড়টা জুড়ে দিলাম পিন দিয়ে ।(ডায়েরিটা বন্ধ করার পরেও কান্না থামছে না।তিন পৃষ্ঠার স্মৃতিচারণে এত মায়া!ছুট্টে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলুম।আমার উদ্ভট আচরণে মা খানিকটা বিস্মিত হলেও,বিরক্ত হয় নি।শরীর খারাপ নাকি জানতে চেয়ে,আমার পিঠে হাত বুলাতে লাগলো)।
0 Comments