আমার নাম মিনহাজ। একজন লেখক হিসেবে খ্যাতি বলতে যা বোঝায়, তার থেকে আমি অন্তত তিন কাঠি কম। তবে আত্মীয়দের কাছে আমি \"বেকার কবি\" নামেই বেশি পরিচিত। কিন্তু ভাগ্যের লিখন একদিন এমনই হলো, লেখক থেকে আমি হয়ে গেলাম জামাই। সেটা আবার এমন এক শ্বশুরবাড়িতে, যেখানে মেয়ের চেয়ে বইয়ের দাম বেশি জানে।বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল হঠাৎ করেই। মেয়েটির নাম ছিল ফারিয়া। দেখতে সুন্দর, নম্র স্বভাবের—সব মিলিয়ে যেন কবিতার পাতার কেউ। আমার সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল, আমি যদি কবিতা পড়ে শুনাই, সে মুখে হাসবে, কিন্তু মনে মনে বলবে, \"বেকুব!\"তবে যতই আমি নিজেকে সাহিত্যিক ভাবি না কেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে দেখেছিল একেবারে অন্য চোখে—মাঠে গরু হারানো রাখালের মতো। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া নিয়ে এতটা প্ল্যান করেছিলাম, যেন প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছি। পকেটে কলম, ব্যাগে তিনখানা নিজের লেখা বই (যার একটিও কেউ কখনো কিনেনি), আর মুখে একগাল ভদ্র হাসি।শ্বশুর মশাই প্রথমেই প্রশ্ন ছুড়লেন, আপনি তো লেখক? বাড়িতে ইনকাম কই? এখনো তো গরীব রইলেনআমি হেসে বললাম, স্যার, সাহিত্যই তো বড় সম্পদ!তিনি নাক টেনে বললেন, তাইলে মেয়েরে কবিতা খাওয়াইবেন?শ্বশুর মশাইয়ের কথা শুনে মনে হলো, এই পরিবারে সাহিত্য বলতে বোঝায় এসএসসি বোর্ড বইয়ের বাহিরে সবই \'অপ্রয়োজনীয় কল্পনা\'। আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম, — না স্যার, কবিতা না, মাঝে মাঝে ম্যাগাজিনে লেখাও ছাপে। সম্মানীও মেলে…— সম্মানী কয় ট্যাকা?এই প্রশ্নটা এমনভাবে করলেন, যেন আমি কিডনি বিক্রি করে বিয়ে করতে এসেছি! ফারিয়া পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটি মৃদু হেসে বললো, — বাবা, উনি সাহিত্যিক, বুঝেই তো বিয়ে দিলেন! — তোর কবিতা পড়ার অভ্যাস আছে?— না বাবা, ওনার জন্য শুরু করবো।এই কথা শুনে আমার বুকটা গর্বে ফুলে গেল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই শাশুড়ি বললেন, — বুয়া, জামাইরে একটু দুধ-সেমাই দাও। কবিতার মানুষ, বেশি মসলায় অসুবিধা হয় কিনা!আসল বিপত্তি শুরু হলো পরদিন সকালে। আমি ভাবলাম, শ্বশুরবাড়ি মানেই আদর-আপ্যায়ন, ঘুম থেকে উঠলেই চায়ের কাপ হাতে হাজির হবে কেউ। কিন্তু আমার ভাগ্যে জুটলো — জামাইবাবু, এক মগ পানি আনবেন টিউবওয়েল থেকে?হাতের কলম ফেলে, বালতির হাতল ধরতে ধরতেই মনে হলো — জীবনের সবচেয়ে বড় চরিত্রবদল — লেখক থেকে পানিবাহক!টিউবওয়েল থেকে পানি এনে শাশুড়ির হাতে দিতেই তিনি বললেন, — জামাই দেখি ফিটই আছে! এইবার বাজারটা করে আনেন, হাতে লিস্ট ধরিয়ে দিলেন।আমি ভাবলাম, বাজারে গেলে হয়তো গ্রামের মানুষজন বলবে— এই যে, শহরের লেখক জামাই আসছেন! কিন্তু বাস্তবে বাজারে ঢোকার সাথে সাথে এক মুদি দোকানদার বলল, — নতুন জামাই নাকি? লেখক? একটা সেলফি দেন ভাই!সেলফির মধ্যে দিয়েই প্রথমবার মনে হলো, লেখক পরিচয়ের কিছু উপকারও আছে। কিন্তু এরপরই সে বলল, — আপনার লেখা আমি পড়ি নাই, কিন্তু ফারিয়ার জন্য খুব ভাগ্যবান হইছেন।মানে আমি একটা লাইভ লাইব্রেরি, কিন্তু সবাই কভার দেখে রেটিং দিচ্ছে! বাজার করে ফিরে এলাম, পকেটে মাত্র ২০ টাকা বাকি। শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন, — এই যে জামাইবাবু, আপনি যে গল্প লেখেন, একখান গল্প বলেন তো?আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, একটু সাহিত্য ঢেলে দিই। শুরু করলাম এক প্রেমের গল্প — নদীর ধারে, নৌকায় প্রেম, বৃষ্টিতে ভিজে নায়িকা কাশছে...শাশুড়ি ফিসফিস করে বললেন, — ইশশ! বিয়াই এইসব গল্পে পটায়া আইছে মনে হয়! ফারিয়া তখন পাশে বসে মুখ লুকিয়ে হাসছে। আমি থেমে গিয়ে বললাম, — না না! সবটাই কল্পনা!শ্বশুর বললেন, — তাহলে ঠিক আছে। কল্পনায় থাকেন। বাস্তবে মুরগিটা ছেটে দেন তো।মুরগি ছেঁটার কাজে হাত লাগালাম। কলমের বদলে ছুরি ধরা সহজ নয়। মাথায় টুপ করে প্রশ্ন আসলো, হেমিংওয়ে যদি মাছ ধরতে পারে, আমি মুরগি ছেঁটতে পারি না কেন?কিন্তু ঠিক সেই সময় শালারা এসে বললো, — জামাইভাই, গোঁফটা একটু মুছে নেন। রক্ত লেগেছে।আমি আয়নায় তাকিয়ে দেখি, গোঁফে সত্যিই লেগে আছে— সাহিত্যের রঙ নয়, মুরগির রক্ত।এই কি সেই জীবন, যেখানে আমি \'জীবন\' শব্দটা কাব্যে ঢেলে দিতাম?বিকালে এক প্রতিবেশী এলেন। শ্বশুর মশাই পরিচয় করিয়ে দিলেন, — এই আমাদের জামাই। শহরের ছেলে। লেখক। ফেসবুকে ৪ হাজার ফলোয়ার আছে।প্রতিবেশী বললেন, — ওইসব লেখক-ফেসবুক তো ঠিক আছে, কিন্তু ট্যাকা কামায় কত?মনে মনে বললাম, আবু হেনা রনি আর আমি— দুজনেই হাসাই, পার্থক্য টাকায়।তবে সন্ধ্যায় একটু সান্ত্বনা মিললো। ফারিয়া চুপচাপ এসে বললো, — তুমি কি আমার জন্য একটা ছোট কবিতা লিখবে? আমি চোখ বড় করে বললাম, — তুমি পড়বে?— হুম।কলম ধরলাম, লিখলাম:\"এই ঘরের কোণে বসে, তোমার মুখেই আলো ভাসে, বাকিরা জিজ্ঞেস করে ‘কী লেখো?’ তাদের বলি— রানির হাসি।”ফারিয়া হেসে বললো, — তোমাকে এখন দেখতে একদম কবির মতো লাগছে।আমি বললাম, — পেছনে মুরগির গন্ধ আছে কিন্তু।বিয়ের পর প্রথম শুক্রবার, ভেবেছিলাম হয়তো শ্বশুরবাড়িতে স্পেশাল কিছু হবে—হয়তো নতুন জামাইকে নিয়ে গল্প, কবিতার আলোচনা, রকমারি খাওয়াদাওয়া। হলোও বটে! শাশুড়ি সকালে ডাকলেন, — জামাইবাবু, আজকে মেজবান আছে, একটু তাড়াতাড়ি উঠেন। কাজ আছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম, — কাজ? মানে কবিতা লিখতে হবে?— না রে বাবারে! চেয়ার-টেবিল প্যান্ডেলে পৌঁছায়া দেন তো আগে। লোকজন আইতেছে।আমি ভাবলাম, শ্বশুরবাড়ির মানুষজন বুঝে গেছে—লেখকদের শরীর-মন দুইটাই হালকা। তাই কাজে লাগিয়ে নিচ্ছে!মেজবানে লোকজন আসছে, খাচ্ছে আর বলছে, — এই যে জামাইবাবু, শুনেছি ফেসবুকে আপনার বড় নাম!— নাম তো আছে, কিন্তু কোরমার হাড্ডি গেল কই? কেউ কেউ বলছিল, — আপনার গল্পগুলো পড়ে বুঝি না ঠিক, কিন্তু আপনার স্ত্রী ভাগ্যবতী, আপনি কবি!আমি মুচকি হেসে বলি, — গল্প না বোঝা ভালো, তাহলে বাস্তব মনে হবে না। সে রাতে, ক্লান্ত শরীরে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম—সবাই ঘুমোচ্ছে। শুধু আমি, লেখক জামাই, বসে আছি বারান্দায়, হাতে চা, চোখে আকাশ। হঠাৎ ফারিয়া এসে বসলো পাশে, বলল— — তোমার এই লেখক জামাই জীবনটা কি খারাপ? আমি বললাম, — না, শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় আমি জীবন লিখি, জীবন আমাকে লেখে।সে হেসে মাথায় হাত রেখে বলল, — তাহলে চল, একসাথে লিখি নতুন গল্প—তুমি কলম ধরো, আমি পাশে থাকি।আমি বললাম, — তুমি পাশে থাকলেই তো আমার লেখার মানে হয়। কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। আমি এখন শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে শুধুই ‘লেখক’ না — ‘আপন জামাই’।আমি একদিন বইয়ের কথা তুলতেই শাশুড়ি বললেন, — বই তো ঠিক আছে, কিন্তু তোমার রান্না নিয়ে একটা বই লেখো না?আমি ভাবলাম, হ্যাঁ! “জামাইয়ের ঝাল ঝোল” নামে যদি একটা বই লিখি — হয়তো সেটা সবার বেশি বিক্রি হবে।তবু মাঝেমাঝেই ফারিয়া এসে পাশে বসে। সে আমার লেখা পড়ে, ভুল ধরায়, হাসে, কখনো চোখ বড় করে বলে— — এটা কি আমাকে নিয়ে লিখছ?আমি হাসি, বলি— — তুমি তো সব গল্পেই থাকো, শুধু নামে আলাদা। অবশেষে এক সন্ধ্যায় আমি আমার নতুন বইয়ের নাম ঠিক করলাম— “ফারিয়ার জামাই”বইয়ের ভূমিকায় লিখলাম: এই বই কারো ভালোবাসার গল্প নয়। এটা এক লেখকের সেই যাত্রা, যেখানে কলমের কালি শেষ হয় রান্নাঘরের মসলা দিয়ে।বইটি যখন প্রকাশ পেল, ফারিয়া বলল, — তুমি এখন শুধু আমার জামাই না, পাঠকেরও জামাই হয়ে গেছো।আমি বললাম, — তা-ই হোক। কিন্তু আমি চিরকাল তোমারই গল্পের মূল চরিত্র হয়ে থাকতে চাই।
\"সাদিয়ার জামাই\" এক তরুণ লেখক মিনহাজের বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তার মজার, বেমানান আর বাস্তবতামিশ্রিত জীবনযাত্রার কাহিনী। শহরের \'বেকার কবি\' থেকে গ্রামের \'জামাই\' হয়ে ওঠার পথটা নানা হাস্যকর ঘটনায় ভরা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার সাহিত্য নিয়ে তেমন আগ্রহী নয়, বরং বাজার, মুরগি ছাঁটা, পানিবহন, এমনকি প্যান্ডেলের চেয়ার-টেবিল তোলা—সব দায়িত্বই তার কাঁধে। মাঝে মাঝে লেখক পরিচয়ের কদর মিললেও তা শুধু কথার খাতিরে। তবুও স্ত্রীর ভালোবাসা, কবিতার প্রতি আগ্রহ আর নিজেদের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো তাকে সাহিত্যের মতোই মধুর করে তোলে। শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের জীবন, রান্নাঘর আর ভালোবাসার গল্পকে একত্র করে \"ফারিয়ার জামাই\" নামে বই লিখবে।
বাহ, গল্পটা দারুন।