

ওই যে ইফোর্ট নামক ছোট্ট একটা শব্দ, অনেক বড় অর্থ বহন করে!ছোট ছোট কাজ, এই ধরো দু মিনিটের চায়ের আড্ডা কিংবা ৫ মিনিটের ৫ টা কথা সারাদিন ভালো রাখতে পারে।অনেকেই ঝাপিয়ে পরবে এখন এটা বলতে যে,এসব টিভির স্ক্রিনেই সুন্দর। তাই?স্ক্রিনেই সুন্দর বুঝি?তবে তোমরা জানোই না,বাস্তব কতটা নাটকীয়তায় ভরপুর।স্ক্রিনের পুরো ব্যাপারগুলো আমরা বুঝি,আন্দাজ করে ফেলি কি হতে পারে। বাস্তবে আন্দাজ তো দূর,কল্পনাও করা যায় না। কথা গুলো বলতে বলতে রিমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মুক্তি তার হাতটা চেপে ধরে বললো,এত ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে গেছে সব,আমার ডেস্টিনি, আমার লিমিটেশন,কাজ সব।এখন আমার পরিপূরক আমি নিজেই।রোজ স্কুল থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে ৫ মিনিট বিশ্রাম, বড় এক মগ ঘন দুধের চা,সাথে দুটো বেলা বিস্কুট এটাই আমার সন্ধ্যা। ফ্রেশ হয়ে হাতের মুঠো মেপে ভাত বসিয়ে দি,সাথে মাছের ঝোল, কখনো বা ভাজাভুজি, ব্যস আমার খাবার তৈরি। এর বাইরে আমার কোনো জীবন নেই।তবে কি জানিস তো,একটা ব্যপার বুঝলাম, মানুষ একা হলে নির্দিষ্ট কিছুর প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। এই যেমন,কেউ নেশায় জড়ায়,কেউ নারীতে।মুক্তি জানতে চাইলো,তুই কিসে জড়ালি?চায়ে চুমুক দিতে দিতে উত্তর দিলো রিমি- চা\'য়ে।দুইজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলো,কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে থাকা একঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো,লাল রঙা ফুলে দুইজনের কোল ভরে গেলো।তুই চাইলে আমার কাছে এসে দুদিন থাকতে পারিস কিন্তু? রিমি বললো, দরকার কি?এইতো বেশ,মনুষ্যসমাজ থেকে দূরে আছি।তোর সঙ্গ পেলে,আবার অভ্যাস না হয়ে যায়।তবে হ্যাঁ, তুই আয় না সময় করে। আমার দুইরূমের পায়রা খোপ দেখে যা।ঘড়িতে তখন ৬ টা বেজে এসেছে।কিন্তু চারদিকটা পুরো অন্ধকার হয় নি,কেমন একটা সোনালী আভা ছড়াচ্ছে!রিমি একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করে, মুক্তি ওর সবথেকে কাছের বন্ধু।প্রায় ৩ বছর পরে দেখা।এই দেখাটাও মুক্তির ইচ্ছায়।রিমি বলে উঠলো, তোর মনে আছে,এই গাছের পাশে একটা ঝালমুড়ির ভ্যান বসতো।আমরা কলেজ ছুটির পরে রোজ খেতাম।মনে থাকবে না আবার? তুই আর অংশুদা একবার কম্পিটিশন করে ১০ ঠোঙ্গা খেলি,এরপর তোর সেকি অসুস্থতা!রিমি চুপ হয়ে গেলো।অংশু,রিমির প্রেমিক ছিল।দুই ব্যাচ বড়।বইয়ের মতো সুন্দর প্রেম ছিল ওদের। তবে সেটা ছিল বইয়ের পৃষ্ঠার মতো, সীমিত। অংশুদা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়,আর কখনো যোগাযোগ করে নি।গোটা ৩ টা বছর পরিবার,পাড়া-প্রতিবেশীদের কথা হজম করে অপেক্ষা করেছিলো রিমি।সারাজীবন হয়তো অপেক্ষা করতো যদি না সেদিন,পিন্টুর ফোনে অংশুদার বিয়ের ছবি না দেখতো।রিমির হাত ধরে বললাম তুই আরেকবার সব নতুন করে শুরু কর।রিমি বললো, নতুনত্ব নষ্ট হয়ে গেছে।চাইলেই মরা গাছে ফুল কিংবা শুকনো নদীতে জল আসে না।আমি তো বেশ আছি।সারাদিন স্কুলে থাকি।বাচ্চাগুলো আমায় ঘিরে রাখে।নিজের কাজ নিজে করি,সময় কেটে যায়।তবে হ্যাঁ, আমাদের এই বিশ্রী সমাজ মেয়েদের একা থাকাটাকে সুযোগ ভেবে নেয়।তাদের কাছে ভালো থাকাটা নয়,ভালো দেখানোটাই মূখ্য।রোজ একবার করে দারোয়ান আমাকে বলে, কিছু লাগলে যেন উনাকে বলি।ইঙ্গিত আমি বুঝি তবে বাসাটা ছাড়তে পারি না।মানুষের মায়া কাটাতে শিখে গেলেও,অন্য এক মায়া জড়িয়ে ধরেছে।রোজ বিকেলে ব্যাল্কোনির কার্নিশে ছোট্ট একটা সাদা বিড়াল আসে। সারাদিন জমানো খাবার গুলো দি।সকালটাই এক ঝাঁক চড়ুই এসে কিঁচকিঁচ করে, মুড়ি ছিটিয়ে বিদেয় করি।আজকাল তো,কোথা থেকে জানি এক কুকুর আসে,দোতলায় ঘর আমার। নিচে দাঁড়িয়ে ঘেউঘেউ করে জানান দেয় তার আসার খবর।এদের ছেড়ে কি করে আসি বল তো?মুক্তি বললো,এভাবে আর কত দিন? আমি তো সব মেনে আর মানিয়ে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম।নতুন করে স্বপ্ন বুনেছিলাম।অতীতটা দম বন্ধ করে, রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম।বিনিময়ে কিছুটা যত্ন আর ইফোর্ট পাওয়ার ছিল।সারাটাজীবন কাঙাল হয়ে ঘুরেছি।কেউ তো আমায় একটু যত্ন করলো না।আর কিভাবে নতুন করে শুরু করা সম্ভব বল তো? আমি তো বাকি ৫ টা মেয়ের মতো ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডে থাকতাম।রঙিন সব স্বপ্ন রোজ চোখের কোণে উঁকি দিতো। মুক্তি বললো,তুই লিখালিখি করিস না?ধুর, ওসব তো বাচ্চামো ছিল। লিখতে গেলে উচ্ছ্বাস লাগে। আমি তো নেতিয়ে পরা কলমির ডগা।রোজ একবার করে বেঁচে ফিরি।ক্লান্ত শরীর আর অসুস্থ মনটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি।হঠাৎ রিমির একটা ফোন আসে।বিদ্যুৎ বিল নিয়ে এসেছে।ঘড়িতে তখন ৭.৩০ টা।চারদিক টা অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের সোনালী আলো চারদিকে। রিমি বললো,আমি আসি রে দেরি হয়ে গেছে। মুক্তি বললো আরো কিছুটা সময় থাক।আমার বর আসবে,আমাকে নিতে পরিচয় করিয়ে দি।রিমি বললো,আরেকদিন।তাঁতের শাড়ি,গলায় কাঠের একটা ছোট মালা,বাঁ হাতে কালো ঘড়ি,পায়ে সাধারণ চটিজুতা আর মাঝারি একটা পাটের ব্যাগ - সব দেখে কেউ বুঝবে না এই মেয়েটা বাকি সবার থেকে আলাদা।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় গটগট করে হেঁটে চলে যাচ্ছে রিমি।কি অন্যরকম একটা আত্মবিশ্বাস, একরোখা, জেদি রাখছিলো! সাধারণের বেশে এক অসাধারণ নারী।বাসায় ঢুকতেই দারোয়ান বললো, কি আপা আজ এত দেরি?প্রায় ১২ বছর পরে আজ অতীত নিয়ে কথা বললো রিমি। উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দেয় সে,এই পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এক দম্পতি এসেছে।এরা সারাক্ষণই খুনসুটিতে মেতে থাকে, নতুন বিবাহিত হয়তো। রিমি কখনো এদের দিকে তাকায় না,আজ দেখছিলো। এরা প্রচন্ড হাসাহাসি করে টিভিতে কোনো একটা ড্রামা দেখছে।ড্রামাটা মেইবি দুটো টিমের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখাচ্ছিলো।রিমির হঠাৎ খুব বুকে ব্যাথা করে উঠলো,চোখের কোণে জল!আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলো - আমি কাঁদতেও পারি?\'অবশেষে যখন বিয়ের জন্য রাজি হয়,বাবা একটা ছেলে ঠিক করে আমার জন্য। লোকসমাজের মুখে কুলুপ এঁটে দিতে গিয়ে ভালো করে খোঁজও নেয় না। বিয়ের পরে নিজের অতীত ভুলে যেই একটা নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছি,ওখানেও আমি ঠকলাম।দু-কাপ চায়ের আড্ডা, জোছনা দেখা,রবীন্দ্রনাথের গল্পে মগ্ন হয়ে চুল বাঁধতে ভুলে যাওয়া,বিকেলবেলায় শিউলি কুঁড়ানো কিছুই হয় নি।লোকটা আমায় অপেক্ষা করতে বলতো।আমিও বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতাম।লোকটা ঘরে ফিরতো না।তারও বা দোষ কি?দুটো বউ সামলানো কি মুখের কথা! পাড়ার সবাই বলেছিলো,এই মেয়ের বিয়ে হবে না।বুড়ি হয়ে গেছে, অথচ তখন সবে আমার ২৪।সুরুজ, আমার পাড়ার ছোট ভাই বলেছিলো আমায়,দিদি তোর বরটা বিবাহিত রে।হেসে বললাম ধুর পাগল।কি জানি হয়তো সবসময়ই ধুর পাগল বলে উড়িয়ে দিতাম।তবে সুরুজ আমার ভালো চাইতে গিয়ে বড্ড খারাপ করে ফেললো।চোখে আঙুল দিয়ে লোকটার পরিচয় জানিয়ে দিলো।কেঁদেছি সেদিন,কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।স্বপ্নে দেখলাম-আমার বর মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে রিমি,আমার ভুল হয়ে গেছে,আজকের পর থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু হবে। স্বপ্নের উপর ভরসা করে কখনো প্রশ্ন করি নি তাকে। দু\'বছরের মাথায় ডিভোর্স পেপার এনে দিয়ে সব আদ্যোপান্ত বললো সে। চুপচাপ কালো কালীতে নিজের নাম লিখে দিলাম।একটা প্রশ্ন করলাম শুধু -আমায় বিয়ে করলে কেন?উত্তর শুনে বুঝলাম বড়লোক মানুষের কত রকমের শখ থাকে। উত্তর ছিল,তার বউকে হিংসে অনুভব করানো। মা-বাবা ঘরে জায়গা দিলো সেদিন।প্রতিবেলায় নিয়ম করে কথা শুনাতো।ভাগ্যিস পড়াশোনা কিছু ছিল। একটা চাকরি জুটে যেতেই চলে আসলাম সব ছেড়ে। বেছে নিলাম আমার এই রোবোটিক জীবন।রিমি খুব কষ্ট করে নিজেকে আজ এখানে এনেছে।চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে।কালকের জন্য তৈরি হতে হবে। স্নান করতে যাওয়ার আগে পুরোনো অভ্যাস,গান চালিয়ে দেওয়া।আজ কি মনে করে যেন-\"ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে,আমার নামটি লিখো\" শুনছিলো আর গুনগুন করছিলো । স্নান সেরে এসে বহুদিন পরে আয়নার সামনে বসলো রিমি। সাজগোছ করে আপনমনে নেচে বেড়াচ্ছলো। ড্রয়ার খুলে ১২ বছর আগের ডায়েরি টা বের করলো। লাল কলম দিয়ে আজকের তারিখ লিখে, হেডলাইন দিলো- \'নবারম্ভ\'।রিমির মনে হলো,জীবনে একজন মানুষ থাকা সত্যি খুব প্রয়োজন। হোক না সে বন্ধু, বা প্রেমিক।রোজ দেখা না হোক,একদিন মুখোমুখি হয়ে সমস্ত কথা বলবো।কিন্তু এই প্রয়োজনীয় মানুষগুলো সবসময়ই হারিয়ে যায়।তবুও আমরা হন্যে হয়ে মানুষ খুঁজি, একটু কথা বলার জন্য, প্রাণ খুলে হাসার জন্য, চিন্তিত মস্তিষ্ক আর ক্লান্ত মনকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য একটা কাঁধ খুঁজি। আজকের ভোরটা একটু বেশি সুন্দর। নতুন শাড়ি আর হাল্কা সাজগোছ করে স্কুলের জন্য বের হলো রিমি।তাকে দেখে আজ বসন্তের ফোঁটা প্রথম ফুল মনে হচ্ছে,ভোরে সূর্যের মিহি উত্তাপ যেমনটা শীতে স্বস্তি দেয় অনেকটা তেমন,চাঁদের আলোয় পুকুরের জলের মতো টলটলে লাগছে তাকে।গেইট আসতেই দারোয়ান বলে উঠলো- কি গো আপা যান কই এই সাইজ্জা??খুব সুন্দর দেহায় তো।এর আগে কখনো এ লোকের কোনো কথার উত্তর আমি দিই নি।আজ একগাল হেসে বললাম,শাড়িটা সুন্দর না শফিক ভাই?ভালো করে দেখে বলুন তো,আপনার বোনের মতো সুন্দর লাগছে কিনা?লোকটা থতমত খেয়ে বললাম,জ্বে আপা জ্বে।স্কুল যেতে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ পরে, ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছিলো খুব।রিমি হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরলো,লাল ফুলগুলো তার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করতেই রিমি গেয়ে উঠলো - \"ও জীবন তোমার সাথে কাটাবো রূপকথাতে,আজ ইচ্ছে মতো ভেসে\"।
0 Comments