আলোর মশাল হাতে, তবুও মলিন

ঘরটায় আলো জ্বলছে, অথচ চারদিকে যেন অদ্ভুত এক অন্ধকার।একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে আছেন আবিদ রহমান—এককালে যাকে সবাই ডাকত \"আলোকদূত\" নামে। কথায়, কাজে, স্বপ্নে সে ছিল নেতৃত্বের প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মেধাবী, ছাত্র রাজনীতিতে দৃঢ়, সমাজসেবায় অগ্রগণ্য। মনে সবাই বিশ্বাস করত, এই মানুষটি একদিন কিছু করবে—বিশ্ব বদলাবে না হোক, অন্তত একটা দেশের মানচিত্রে নতুন রেখা টানবে।আবিদ নিজেও বিশ্বাস করত তা।তার হাতে ছিল আলোর মশাল—জ্ঞান, সাহস, সততা, আর স্বপ্নের এক অগ্নিশিখা।তবু কীভাবে যেন… সেই মশালটাই নিভে গেল।আলোর উৎস হাতে থাকলেও জীবনটাই হয়ে পড়ল মলিন।বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। সংসারের ভার চেপে বসল কাঁধে।প্রেমিকার পরিবার বলল, “আবিদের আদর্শ দিয়ে পেট চলে না।”বন্ধুরা একে একে চাকরি, সংসার, বিদেশ, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঢুকে গেল।আবিদ দাঁড়িয়ে থাকল একাই—মর্যাদার এক বোবা মিনারে, যার নিচে পচতে লাগল না-পাওয়া স্বপ্নগুলো।প্রথমে শিক্ষকতা—কিন্তু মাথা নিচু করে অনৈতিক আদেশ মানতে অপারগ।তারপর সাংবাদিকতা—সত্য লেখার দায়ে চাপ আসল ওপরে থেকে।শেষে এক ছোট এনজিও—কিন্তু তাতেও দলাদলি, হিসাবি স্বার্থের বেড়াজাল।একটা একটা করে পথ বন্ধ হলো।আবিদ কেবল সরে এল—বারবার।প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে এক কথাই ভাবে—“আমি কি পালিয়ে এসেছি? নাকি নিজের সঙ্গে হার মেনেছি?”তার আলোর মশাল এখনো নিভে যায়নি।কিন্তু সেই আলোয় শুধু স্পষ্ট হয়… নিজের মুখের ক্লান্ত ছায়া।সে এখন আলো ছড়ায় না,শুধু কুয়াশায় মোড়া আত্মজিজ্ঞাসার প্রদীপ হয়ে আছে।একদিন তার এক ছাত্র, আজকের প্রখ্যাত নেতা, রাস্তায় দেখে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়।আবিদ হাসে না। শুধু বলে,“তুমি ঠিক করেছ। আমি শুধু স্বপ্ন দেখেছিলাম।তুমি সেটা বাস্তব করেছ—যেভাবেই হোক।”রাত গভীর হয়।একাকী ঘরে নিঃশব্দে জ্বলে থাকে টেবিল ল্যাম্প।আর টেবিলে পড়ে থাকে তার সেই পুরোনো ডায়েরি—প্রথম পাতায় লেখা:“আলো হাতে মানুষ হাঁটে,কিন্তু পথ না থাকলে সে আলো শুধু নিজের মুখই জ্বালায়।”