#গল্প:\'সারগাম\'✍নাদিয়া নওশাদ টুসটুসে ফোলা ফোলাদুটো গাল, মায়াবী দুটো চোখ,মাথাভর্তিএক ঝাঁক ঘন কোঁকড়া চুল--বছর সাতেকের ছোট্ট মেয়ে \'সারগাম\'। মায়ের খুব আদরের হলেও সারাক্ষণ নানু আর মায়ের শত বারণ,\"এটা করো না,সেটা করো না\" শুনে যেতে হয়। সারগাম বয়সে ছোট ঠিকই কিন্ত যথেষ্ট বুদ্ধি মাথায়। সারগামের মা তাজরীন মুখে কিছুই বলে না তবে সারগাম যখনই তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে তখনই বলে,\"বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন।\"সত্যিটা আসলে একটু ভিন্ন। ছোটবেলায় বাবা মায়ের শখ পূরণ করতেই একজন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে তালিম নিয়ে গান শিখেছে তাজরীন। একবার একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়েই আলাপ হয় শোয়েবের সাথে।সেখান থেকেই প্রণয়,পরিণয়। সারগামের বয়স যখন মাত্র দুই বছর তখন সারগামের বাবা শোয়েব এক নারী অফিস কলিগের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাজরীন সারগাম এর লালন-পালন এ এতোটাই ব্যস্ত থাকে যেবিষয়টি বুঝতে পারেনি। একদিন শোয়েব এর মোবাইলে একটা এসএমএস আসে,ঘটনাক্রমে তাজরীন সেটি পড়ে আর বুঝতে বাকিনেই যে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। তখন মিউচুয়াল ডিভোর্স এর মধ্য দিয়েদুজনের সেই বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি হয়ে যায়। তারপর থেকেই সারগামকে নিয়ে তাজরীনের ঠাঁই হয় তার বাবার বাড়িতে। যেহেতু গানই তাজরীন এর প্রাণপ্রিয় তাই গানকে সম্বল করেই তাজরীন একটা গানের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। সারগামের দেখভালের দায়িত্ব নানু আর মা ভাগাভাগি করে নেয়। মাথার ওপর তাজরীনের বাবার তৈরি করা দোতলা বাড়িটা থাকাতে রক্ষা। মা আর মেয়েকে নিয়ে শেষমেশ এ বাড়িতে টিকে থাকতেতো পারছে তাজরীন। সারগাম পাশের আনন্দ কলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের কাছে গানের হাতেখড়ি তার। ডিভোর্স এর পর শোয়েব তাজরীন এর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল কিন্ত তাজরীন সাফ \'না\'জানিয়ে দেয়। তবে সারগাম এর জন্য প্রায়শই নতুন ফ্রক, পুতুল,চকলেট বক্স পাঠাতে থাকে। সারগাম জানে এক অ্যাঞ্জেল ওর জন্য এই উপহারগুলো পাঠায়। আজ পর্যন্ত সেই অ্যাঞ্জেলকেদেখতে পায়নি সে। পনের বছর পর আজ সারগাম বাইশ বছরের যুবতী। নানুমণি পরপারে চলে গেলেন বছর খানেক হল। পড়াশোনা,গান আর মায়ের সান্নিধ্য এই নিয়ে তার জীবন। চোখে একরাশ সোনালী স্বপ্ন গানের জগতে নিজেকেপ্রতিষ্ঠিত করার। আজ ঢাকার ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে সারগাম গান পরিবেশন করবে। যথাসময়ে অনুষ্ঠানে সারগাম এর গান শেষ হল। গানের খাতা আর টুকিটাকি সব গুছিয়ে মায়ের সাথে বাড়ির জন্য রওনা করবে এমন সময়হঠাৎই শোয়েব এসে সারগাম আর তাজরীনের সামনে এসে দাঁড়াল। এত বছর পর আচমকা শোয়েবকে চোখের সামনে সশরীরে উপস্থিত হতে দেখে তাজরীন একটা বড় ধাক্কা খেল। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কোনওমতে নিজেকে সামলে সারগামকে টেনে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শোয়েব তাজরীনকে বলল,\"কেমন আছ তাজরীন?\" কোনও কথার উত্তর না দিয়েই তাজরীন সারগামকে নিয়ে অনুষ্ঠানের জায়গা থেকে বেরিয়ে গেল। সারা রাস্তায় একটা কথাও বলল না। বাড়ি ফিরে সারগাম মাকে জিজ্ঞেস করল,\"লোকটা কে মা?\"অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর তাজরীন রাগে ফেটে পড়ে বলল,\"সে তোমার বাবা।\" কথাটি শোনার সাথে সাথে সারগাম একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তাজরীন তখন বলল,\"ছোটবেলা থেকে এ যাবৎ সব উপহার দিয়ে গিয়েছে,কথিত অ্যাঞ্জেল আর কেউ নয় বরং তোমার বাবা ব্যবসায়ী শোয়েব আহমেদ।\" তখন সারগাম মাকে প্রশ্ন করল,\"তাহলে এতদিন ব্যাপারটি লুকিয়ে গিয়েছো কেন? কেন সবকিছু খুলে বলোনি?\" তাজরীন তখন বলল শোয়েব তাকে অন্য একজনের জন্য ঠকিয়েছে। তাই সে চায়নি শোয়েবের ছায়া সারগামের ওপর পড়ুক। সব শুনে সারগাম মাকে আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়েখুব কাঁদলো। বলল,\"তুমি একদম চিন্তা করোনা মা,যে তোমাকে আর আমাকে এভাবে ছেড়ে গিয়েছে,তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে,সে কখনও আমার আপনজন হতে পারে না।\" এ ঘটনার দু-তিনদিন পর সারগামের মোবাইলে একটা কল আসে। কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে শোয়েব বলে উঠল,\"কেমন আছো মামণি? আমি তোমার বাবা বলছি, তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই।\" শুনে সারগাম বলল,\"ঠিক আছে আজ বিকেলে \'বসুমতি ক্যাফেটারিয়া\' তে আমি আপনার সাথে দেখা করব।\" কল ছাড়ার পর তাজরীনকে সারগাম বলল,\"যে কষ্টের জীবন মা তুমি আমাকে নিয়ে যাপন করেছ তার অবসান করতে একবার হলেও আমার শোয়েব আহমেদের সাথে কথা বলতেই হবে।\" কথামতো নির্ধারিত জায়গায় সারগাম শোয়েবের সাথে দেখা করল। শোয়েব সারগামকে বলল,\"কি খাবে মামণি?\" তখন সারগাম বলল,\"আমি এখানে খেতে আসিনি। আপনি আমার মা আর আমাকে যে জীবন উপহার দিয়েছেন তাতেই আমরা অনেক খুশি। আমাদের থেকে দূরে থাকলেই আমরা ভালো থাকব।\" এরপর সেখান থেকে দ্রুত বাড়ি চলে এলো। বাইশ বছর আগের সেই ছোট্ট সারগাম আজ গানকে অবলম্বন করেই সম্মুখে এগিয়ে গেল, স্ব-শিক্ষা ও মায়ের প্রদত্ত শিক্ষার শক্তিতে সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে,নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
0 Comments