কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত সম্পর্কের হালচাল
বাংলা সাহিত্যের ক্ষুদ্র একজন পাঠক হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লেখার মত পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার নেই। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ব্যাক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে লেখার চেষ্টা করলাম। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে।রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক মধুর সম্পর্ক। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে না জেনেই আমরা নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালাই । কখনো কখনো সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছেন, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। আজ আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে সে সম্পর্কের ইতিবৃত্তই তুলে ধরবো।কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে। দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১০-তে আর তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। অর্থাৎ গীতাঞ্জলি যখন প্রকাশিত হয় তখন কাজী নজরুলের বয়স ১২ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স প্রায় ১৪ বছর।১৯১৬ সালের ঘটনা। নজরুল তখন বর্ধমান জেলার সিয়ারসোল হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। কিশোর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের মনে অসীম ভক্তির জন্ম হয়। একবার খেলার মাঠে বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে কিছু অপ্রিয় কথা বলায় নজরুল রেগে গিয়ে বাঁশ দিয়ে বন্ধু জগৎ রায়ের মাথায় এমন আঘাত করেছিলেন যে, মাথা ফেটে রক্তপাত হয়েছিল। সে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নজরুলের শাস্তি হয়েছিল আদালত যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ নজরুল আদালতে দাড়িয়ে থাকবেন।১৯২০-এর দিকে নজরুলের যখন বাংলা সাহিত্যে আগমন, তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁর গৌরবের পূর্ণতায়। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর প্রভাব প্রায় সবদিকেই। ওই সময় কোলকাতার ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘নবযুগ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নজরুলের কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রকাশ হতে থাকে। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায়ও নজরুল নিয়মিত যেতেন। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়তেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান নজরুল। এটাই ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। যদিও বিস্ময়ের ঘোরে নজরুল কোনো কথাই বলতে পারেননি সেদিন। এরপর থেকে তাদের উভয়ের চিঠি-পত্র আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। চিঠি-পত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজি’ বলতেন।প্রথম দেখার দুই মাস পর ১৯২১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কবিগুরুকে বলছিলেন, ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলির সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবিগুরু বললেন, তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার গীতাঞ্জলির গান সবতো আমারই মনে থাকে না।”একবার কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক নজরুলের কাছে এসেছিলেন কবিতা নেওয়ার জন্য। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের চেয়ে নজরুলের গানের বেশি প্রশংসা করলেন। নজরুল তখন রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন, “আমরা যদি কেউ না জন্মাতাম, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না, রবীন্দ্রনাথের গান বেদমন্ত্র, তাঁর গান ও কবিতা আমাদের সাত রাজার ধন মানিক। লেখা নিতে এসেছেন, নিয়ে যান, লেখা নিতে এসে এ রকম আমড়াগাছি যেন আর না শুনি।”নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামও নজরুল রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নিয়েছিলেন। ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’ চরণ থেকেই নজরুল ‘অগ্নিবীণা’ নামটা নিয়েছিলেন।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের ষাটতম জন্মদিন পালনের সভা হয় ১৯২১ সালে। নজরুল সভাকক্ষে ঢুকেই সোজা মঞ্চে উঠে বিশ্বকবিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাথায় আশীর্বাদ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন। মঞ্চ থেকে নামার মুখেই রবীন্দ্রনাথ খপ করে নজরুলের হাত ধরে টানলেন। “না নজরুল, তুমি নিচে নয়, তুমি এই সভায় আমার পাশেই বসবে।” ভাবতে পারেন ৬০ বছরের বিশ্বকবির পাশে ২২ বছরের বিদ্রোহী কবি। তখনও নজরুলের প্রথম কবিতার বইটি বেরোয়নি।সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে স্মরণসভা হয়। সেখানেও নজরুলকে পাশে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এদিন সভায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ লিখেছেন, ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবিগুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবিগুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়।৭ জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে চিৎকার করছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। এটাই আগের দিন ছাপা হয়েছে ‘বিজলী’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতায় জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’ বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের আনন্দে উদ্বেলিত নজরুলকে বুকে টেনে নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবির স্বীকৃতি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।কবি কাজী নজরুল ধূমকেতু নামক একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। নজরুলরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে টেলিগ্রাম করে আশীর্বাদ চাইলেন।রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠালেন, “কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু –আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরেউড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!অলক্ষণের তিলক রেখারাতের ভালে হোক্ না লেখা,জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরেআছে যারা অর্ধচেতন।”ধূমকেতু পত্রিকার প্রতি সংখ্যাতেই কবিগুরুর এই বাণী লেখা থাকতো।১৯২২ সালে দুর্গাপূজার আগে ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে বিদ্রোহাত্মক কবিতা প্রকাশের জন্য কাজী নজরুল ইসলামে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হন এবং কারাবরণ করেন। কারারুদ্ধ নজরুলের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করলেন তাঁর নতুন গীতিনাট্য ‘বসন্ত’। পরিবার- পরিজনের বাইরের কাউকে নোবেল বিজয়ী কবিগুরুর এটাই ছিল প্রথম উৎসর্গ করা লেখা। জেলে নজরুলের উদ্দেশে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মারফত বই পাঠিয়ে, রবীন্দ্রনাথ বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘তাকে বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’‘গুরুর আদেশ শিরোধার্য’, বলে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে সেদিন বিদায় দিয়েছিল নজরুল।”জেলখানায় থাকার এক পর্যায়ে নজরুলসহ অন্য বন্দিদের উপর অমানবিক আচরণ ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে ব্রিটিশরাজের পুলিশ। নজরুল এর প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেন। কেউ নজরুলের অনশন ভাঙাতে পারছিল না। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলঙে। কবি নজরুল ১৪ দিন যাবৎ অনশনে থাকায় তার প্রায় ১৩ কেজি ওজন কমে যায়। এই খবর বিভিন্ন মাধ্যমে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট পৌছায়। কবিগুরুর কাছে নজরুলের বন্ধুরা চিঠি লেখেন, তিনি যেন নজরুলকে অনশন থেকে নিবৃত্ত হতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ স্নেহের নজরুলের দুর্দশায় কাতর হলেন এবং আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠিকানায় নজরুলকে উদ্দেশ্য করে টেলিগ্রাম পাঠালেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” কিন্তু সে টেলিগ্রাম কবির হাতে পৌঁছেনি। জেল কর্তৃপক্ষ “Address not found;” লিখে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়।তৎকালীন সমাজের অনেক লেখকই মহৎপ্রাণ দুই কবির সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। এক পর্যায়ে তারা কিছুটা সফল হয়েছিল। একবার নজরুলের রক্ত অর্থে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন – এ কথা রটিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকেও নজরুল সম্পর্কে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। তাই এমন একটি কথা শুনে নজরুল খুব ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি লিখলেন, ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’। যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতায় আরবি-ফারসি ব্যবহারের প্রশংসা করেছিলেন, তিনি কী করে অমন কথা বলতে পারেন? কিন্তু পরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তিনি নজরুলকে সে কথা বলেননি। রবীন্দ্রনাথও ব্যথিত হয়েছিলেন, নজরুল কেন রটনাটি বিশ্বাস করলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের এই বিতর্ক থেকে ফায়দা তোলার জন্য ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা উঠেপড়ে লাগল। শেষ পর্যন্ত আমাদের চাটমোহরের হরিপুরের জমিদার বাড়ির সন্তান বীরবল খ্যাত প্রমথ চৌধুরী ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় ‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানটি ব্যাখ্যা করেন এবং অনভিপ্রেত এই বিতর্কের অবসান ঘটান। নজরুলও তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। ১৯২০-১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে এই একটি ‘খুনের মামলা’ অভিমান পর্ব ছাড়া আর কোনো বিরোধের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না।ঘটনার পরের বছরেই ১৯২৮-এ নজরুল তাঁর কাব্যসংকলন ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করলেন রবীন্দ্রনাথ কে। কবি নজরুল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করে লিখেন “বিশ্ব কবিসম্রাট শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাস নিয়ে নরেশ মিত্র সিনেমা বানালেন। সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নজরুলকে অনেকেই মানতে পারেননি। রবী ঠাকুর তখন নজরুলকে বলেন তোমার চেয়ে আমার গান কি ওরা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’১৯৪১ সালের মে মাসে কবিগুরুর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নজরুল লিখলেন কবিতা‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। কবিতাটিতে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, কবিকে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ হয়তো আর পাবেন না। তাঁর সে আশঙ্কা সত্য হয়েছে। সে বছরই বাংলা ১৩৪৮ সা লের ২২ শ্রাবণ (১৯৪১ খ্রীস্টাব্দের ৭ আগষ্ট ) রবীন্দ্রনাথ মারা গেলে শোকে বিহ্বল নজরুল সেই দিনই লিখলেন ‘রবিহারা’ কবিতা। তিনি আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন এবং আবৃত্তি করেন,‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলেশ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলেউদাস গগনতলেবিশ্বের রবি ভারতের কবিশ্যাম-বাংলার হৃদয়ের ছবিতুমি চলে যাবে বলে’।বেতারে এই কবিতাটি আবৃত্তি করার সময়ে নজরুল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি, তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে একটি গান রচনা করে সুর দিলেন – ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না’ রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে, সমৃদ্ধ হয়ে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে ভিন্ন এক পথ ধরেইএগিয়েছেন নজরুল। তাই তো তিনি বলছেন,“একা তুমি জানিতে হে কবি, মহাঋষি,তোমারি বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু।”কবিগুরুর মৃত্যুর একবছরের মধ্যেই ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই মাত্র ৪৩ বছর বয়সে হঠাৎ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন।পরিশেষে আমি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটা গানের অংশ দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি ।সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথচেতনাতে নজরুলযতই আসুক বিঘ্ন-বিপদহাওয়া হোক প্রতিকূলএক হাতে বাজে অগ্নিবীণাকন্ঠে গীতাঞ্জলিহাজার সূর্য চোখের তারায়আমরা যে পথ চলি।
কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত সম্পর্কের হালচাল
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক মধুর সম্পর্ক। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে না জেনেই আমরা নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালাই । কখনো কখনো সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছেন, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। আজ আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে সে সম্পর্কের ইতিবৃত্তই তুলে ধরবো।
0 Comments