
প্রতিবছর নুরুদ্দিনেরা ক্ষেতে সোনার ফসল ফলায়; ঝড়, বৃষ্টি, রোদ আর খরা মাথায় নিয়ে ওদের ফসল ফলাতে হয়। সেই ফসলের গন্ধে সকলের স্থায়ী সুখ বর্ধিত হয়; জীবন রক্ষা হয়। আর নুরুদ্দিনদের আগামীতে ঋণ পাবার পথটা পরিস্কার করতে হয়।
চৈত্রমাস▪পার্থসারথিএত রৌদ্র কি গায়ে সয়! চারদিকে শুধু তপ্ত বায়ুর হানাহানি। এতটুকু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার উপায় নেই। রৌদ্রের খরতাপে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। গাছের পাতা পর্যন্ত নেতিয়ে পড়ছে। খোলা জায়গায় পাখির ওড়াউড়ি বন্ধ; গাছের ছায়া খুঁজে ঘাপটি মেরে বসে বসে প্রমাদ গুনছে কখন সামান্যতম শীতল বায়ুটুকু পৃথিবীর বুকে বর্ষিত হবে। কিছু শকুন মাঠের প্রান্তে কী যেন খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। মরা কুকুর অথবা গরু নতুবা অন্যকিছু হবে; রোগে অথবা অন্য কোন কারণে মৃত্যুকে বরণ করেছে সেটা। আর তারই প্রাণবর্জিত দেহ এখন শকুনদল ছিঁড়ে ছিঁড়ে পরমতৃপ্তিতে খাচ্ছে। শকুনদলের কখনও খাবারের অভাব হয় না। দুর্ভিক্ষে ওদের ভুড়িভোন আরও পোক্ত হয়। একটা কুকুর হাঁফাতে হাঁফাতে গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর মাটিতে লেপটে শুয়ে পড়লো। জিহ্বা বের করে আয়েস-আরামের জন্য প্রাণপাত করছে। থেকে থেকে একটু হালকা বাতাস বইতে শুরু করলো। বাতাসতো নয় যেন তপ্ত আগুনের আঁচ, এ বাতাস সহ্য হয় না। সবুজ ক্ষেতের মুণ্ডুপাত হচ্ছে রৌদ্রের খরতাপে। যেদিকেই তাকানো যায় চোখে ভেসে ওঠে কেমন যেন একটা অদৃশ্য অথচ দৃশ্যমান আগুনের শিস, লেজ পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে ওঠছে। আর এসব আগুনের শিস চোখে জলতরঙ্গের মতো ভেসে ওঠে। যেন চিতায় রেখে সবুজ ক্ষেতগুলোকে পোড়ানো হচ্ছে। অথচ পুড়ছে না, কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রান্তরটা। যদিও সবুজ বললাম আসলে ছাইমাখা সবুজ। কারণ গাছের প্রতিটি ডগা রৌদ্রের তাপে ঝলসানো। চৈত্রের এই খরতাপে ঠিক মতো দৃষ্টি মেলে কিছু দেখার উপায় নেই। চোখজোড়া কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে।নুরুদ্দিন শেখ একবার ক্ষেত আবার আকাশ দেখছেন। দৃষ্টিতে ধরা দেয় শুধু চৈত্রের খরতাপ। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় বসে আছেন। বারবার আকাশে দৃষ্টি রাখছেন- উত্তরে, দক্ষিণে, পূবে, পশ্চিমে ও উপরে অবশেষে মাটিতে এসে স্থির হয় শূন্য দৃষ্টি। মেঘের এতটুকু রেখা পর্যন্ত চোখে ঠেকেনি। শুভ্র মেঘ মাঝে মাঝে ওড়ে যেতে দেখে আশার বিন্দুগুলি নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু শুভ্র মেঘরাশি যখন শুভ্রই থেকে যায় তখন বুকের ভেতর সূক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করেন নুরুদ্দিন। তবুও তিনি আশা ছাড়েননি। একটু নড়েচড়ে শরীরটাকে ছাঁয়ায় মেপে বসালেন। মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলেন। বুকের পাঁজরগুলো যেন গায়ের গেঞ্জি ভেদ করে বাইরে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ছেঁড়া গেঞ্জিতে বুকের পাঁজরের কাটিগুলো ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। জালের ফাঁক দিয়ে যেমন মাছের প্রকার নির্ণয় করা যায় ঠিক তেমনই নুরুদ্দিনের বুকের পাঁজরগুলো দেখা কোন কঠিন কাজ নয়।বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টির কোন লক্ষণ আজও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে শেষ পর্যন্ত আবার হয় হামিদ মহাজন অথবা হারাধন মহাজনের কাছে যেতে হবে- এই চিন্তায় মাথাটা যেন চিনচিনিয়ে ওঠল নুরুদ্দিনের। তাছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিছু পেতে হলে ক্ষেতের যত্ন তো করতেই হবে। যদি গাছই না থাকে তবে ফসল আসবে কোত্থেকে। ক্ষেত ফেটে একেবারে চৌচির। জমির ফাটল একেক স্থানে ফুট পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই ভাব। যেন সর্বদা বলছে- ‰আমার বুকে পানি দাও, পানি। নয়তো আমার বুক সোনার ফসলে হাসবে না।\'- এই চিন্তাটাই নুরুদ্দিনের মাথায় ঢেউ খেলছে সমুদ্রের গর্জনের মত। ক্ষেতের হা-করা মুখগুলোতে পানি না ঢাললে সর্বনাশ হয়ে যাবে! আজই পানির ব্যবস্থা করতে হবে।*হামিদ মহাজন আর হারাধন মহাজন একই ধরণের লোক। তবে দু\'জনের মধ্যে হারাধন মহাজন একটু নরম প্রকৃতির লোক। হারাধন মহাজনের কাছেই এলো নুরুদ্দিন; হারাধন মহাজনের ধান-চাউলের আড়ৎ আর টাকা দাদনের ব্যবসা। সুদে-আসলে প্রতিবছর পরিশোধ না করলে, কারো সাথে হারাধন মহাজনের লেন-দেন চলে না। এ ব্যাপারে নুরুদ্দিন হারাধন মহাজনের খুব প্রিয়পাত্র। কারণ সে প্রতিবছর কথামতো সব সুদ-আসল পরিশোধ করে দেয়।গতবার তুমি কিন্তু সম্পূর্ণ টাকার সুদ দাওনি! এবার তা\' হিসেব করে দিয়ে দিও ভাই। নইলে আমার কাছে আর টাকা পাবে না, তা\' এখনই বলে দিচ্ছি। তোমার বিপদের সময় আমি তোমাকে সাহায্য করি। আমাকে না দেখলে আমি যে মারা পড়বো।– এই বলে হারাধন মহাজন আড়মোড়া ভেঙে ক্যাশবাক্সা জড়িয়ে ধরে আরাম করে বসলেন।নুরুদ্দিন শেখ কম্পিত কন্ঠে বললেন- বাবু, সে\'বার খুব বিপদে ছিলাম তাই সব দিতে পারিনি। এবার সব দেনা শোধ করে দেবো।ঠিক আছে, যত লাগে নিবে আমিতো তোমাকে কোনদিন মানা করিনি। সময় মতো ফেরৎ পেলেই হলো।– বেশ শুষ্ক কন্ঠেই নুরুদ্দিনের উদ্দ্যেশে হারাধন মহাজন কথাগুলো বললেন।হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়েই নুরুদ্দিন নির্বিকার। দৃষ্টিটুকু অন্য কোথাও ক্ষণিকের জন্য লুকাবার চেষ্টা করলো। সে মনে মনে ভাবছে; এবারও যদি ফসল ভালো না-হয় তবে পথে বসতে হব। আর ঋণের টাকার কথাতো সব চিন্তার বাইরে।ক্যাশবাক্স থেকে টাকা বের করে নুরুদ্দিনের হাতে তুলে দিতে দিতে হারাধন মহাজন আবার বললন- এবারতো অনেক নিচ্ছো, শোধ করতে পারবেতো?সব আল্লাহর ইচ্ছা!- নুরুদ্দিন হাসবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কষ্টের তোড়ে হাসিটা তেমন ফুটে ওঠেনি।তা\'তো বুঝলাম, তোমার ইচ্ছেটাও কিন্তু পুরোপুরি রাখতে হবে।– এই বলতে বলতে হারাধন মহাজন ক্যাশবাক্সটাকে জড়িয়ে ধরলেন। আবারও বললেন- ‰এবার কিন্তু আর পাবে না। পরে আবার আমাকে পথে বসতে হবে।– এই বলে দরজার চৌকাঠের উপর টানানো দেব-দেবীর ছবির দিকে প্রণাম ঠুকে মনে মনে আশীর্বাদ চেয়ে নিলেন।ঠিক আছে দাদা, এবার আর চাইতে আসবো না।– বলে হারাধন মহাজনের দোকান-ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেন নুরুদ্দিন শেখ। বারান্দায় এসে খানিক চিন্তা করলেন। তারপর বাড়ির দিকেই পা বাড়ালেন তিনি।ঋণ ঋণই তবু একটু শান্তি। হামিদ মহাজনের কাছে গেলে অনেক পঁচা-বাসী খারাপ কথা শুনতে হয়। টাকা দিবে ঠিকই তবু নানান কথা শোনাবে। আসলে গালিগালাজ এখন বুলিতে রূপান্তর হয়ে গেছে। একশ\' কথার মাঝে দাড়ি, কমাসহ গালি দেবে তো টাকা দিবে, এর আগে নয়। কথায় কথায় হামিদ মহাজনের চলে গালির মহড়া। এর জন্যই নুরুদ্দিন প্রথমে আসে হারাধন মহাজনের কাছে তারপর অগত্যা হামিদ মহাজনের কাছে যান। হারাধন মহাজন যে গালি দেন না তা\' নয়, তবে গায়ে সহ্য হবার মতো। ।*গভীর নলকূপ হতে পানির ভাগ আগামিকাল থেকেই আসবে। অবশ্য নুরুদ্দিন যখন পানির জন্য আগাম দিতে গেল তখন মঈন শেখ বলেছিল- ‰নগদ টাকা দেবার দরকার নেই। ধান ওঠলে ধান দিও।\' নুরুদ্দিন তাতে রাজি হননি। কারণ ওভাবে ঘরের খোরাক বলতে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না।আগামিকাল ক্ষেতের বুকে পানির ছোঁয়া লাগবে। নুরুদ্দিনের চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটেও যেন বিলীন হয়ে গেল। বাজারে রওনা হওয়ার সময় হাতে টাকা দেখে কনিষ্ঠা মেয়ে ফাতেমা একগাল হেসে জিজ্ঞ্যেস করেছিল- ‰বা\'জান আটা আনতে যাচ্ছো?\' উত্তরে নুরুদ্দিন কিছুই বলেননি। কষ্টের অসহ্য যন্ত্রণার একটা কুণ্ডলী যেন শ্বাসনালী চেপে ধরেছিল। কথা বলার এতটুকু শক্তি বা ইচ্ছা ছিল না। কিছু একটা বলা দরকার।কিন্তু যখনই ক্ষেতের ফাটলগুলো চোখের জানালায় ভেসে ওঠে তখন কন্ঠনালী যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ফলন না হলে যে, সারা বৎসর না খেয়ে থাকতে হবে। তাই এখন নিজেদের চেয়ে ক্ষেতের খাবারের জরুরী প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে না খেয়েতো আর বাঁচা যায় না। মেয়ের চোখে চোখ রাখতে খুব লজ্জাবোধ হচ্ছিল নুরুদ্দিনের। এতটুকু মেয়েকে প্রায় সারাদিন কিছুই না-খেয়ে থাকতে হয়। বেলা প্রায় গোধূলী লগ্নে অথচ এখনও ভাতের হাড়ি চুলায় বসেনি। ঘরে দশ-বারোটি পেট। পকেট থেকে বাকি টাকাগুলো হাতে নিয়ে হিসেব করলেন নুরুদ্দিন।পাঁচ কেজি আটা, বড় বড় দেখে দুটো লাউ আর কিছু ক্ষিরাই কিনলেন। এবার লাউয়ের ফলনটা ভালো হওয়াতে এলাকার লোকজন যা\'হোক কোনমতে বেঁচে-বর্তে আছে। তার সাথে ক্ষিরার ফলনটাও ভালো হয়েছে। চৈত্র মাস তাই আটার দামটা আকাশ ছুঁই ছুঁই ভাব, তের টাকা আটার কেজি সত্যিই কল্পনাতীত। আটা তো নয় যেন স্বর্ণ। প্রতিটি রুটি গলায় যেন কাঁটা হয়ে বাঁধে।বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিলাসবাবু আর আহাদ মিয়া আটার বস্তাকে এখন স্বর্ণের বস্তা মনে করেই প্রতিদিন নমস্কার বা সালাম ঠুকেন। চালান আনেন আটা আর বুদ্ধির প্যাঁচে করে ফেলেন সোনা। আহা! কি শান্তি।– বলেই বিলাসবাবু আর আহাদ মিয়ারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন আর প্রতিদিন মনের অজান্তেই ভুঁড়িতে হাত বুলান কিছুক্ষণ পরপর। উনারা আগেই টের পেয়ে যান কখন বাজারে আটা ছাড়লে রাক্ষসের মতো গিলে খাবে। সেভাবে হিসাব করেই আগে থেকেই আটার বস্তা গুদাম ভর্তি করে রেখে দেন। যখনই বাজারে মালের টান পড়ে তখনই মাল খালাস করেন তার আগে নয়। প্রতিযোগিতার বাজার তাল মিলিয়ে চলা বড়ই দুষ্কর ব্যাপার। ট্রাকের পর ট্রাক মাল আসে আর চৈত্রমাসে ব্যবসা চলে দেদারসে। কিন্তু এর মাঝে সবার খবর সবাইকেই রাখতে হয়। এই বাজারে এরাই রক্ষক আবার এরাই ভক্ষক। সবকিছু এরাই গড়বে আবার এরাই নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। সরকারের সুদৃষ্টি যেহেতু মূল্য নির্ধারণে ছায়া মাড়ায় না তখন এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কে কত দামে কিনল আর কত দামে বিক্রয় করলো তা\' দেখার কোন প্রয়োজনবোধ কোন মহলই মনে করেন না। আয়কর সাহেবরা আয়করগুলো বামহাতে নেন। তাই নেক নজর যতটুকু পারেন বিলাসবাবু আর আহাদ মিয়াদের ওপর উনারা রাখেন। সরকারের ভাণ্ডারে হয়ত কলমের খোঁচায় আশীর্বাদের মত কিছু ফেলে দেন। নয়তো এমন হবে কেন? যখনই চৈত্র মাসের অভাব চরম আকার ধারণ করে তখনই নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য হু হু করে বেড়ে আকাশের তারা হয়ে যায়। আর তা\' দেখে দেখে অসহায় কৃষকগণ জিহ্বা বের করে কেবল নিজের গাল চাটেন। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে জোছনাভরা তারার মেলা উপভোগ করেন কল্পনাবিলাসী হয়ে। আবার যখন ক্ষেতের সোনালী ফসল মাথায় বয়ে এনে হাসির ঝর্ণা ছড়িয়ে দেয় বাংলার কৃষক বাংলার বুকে তখন বিলাসবাবু আর আহাদ মিয়ারা বেজাড় মুখে কলম চুষে। আর নিজেদের গদিঘরের সরকার বলেন- ‰চুপচাপ বসে থেকে কয়েকদিন বাজারটা একটু যাচাই করো। তারপর ধীরে ধীরে মাল কিনবে।\' কিন্তু নুরুদ্দিনদের, ক্ষেতের ধান ঘরে তোলার আগেই বাজারে নিয়ে যেতে হয়। চৈত্রের খরতাপের প্রভাবে অনাহার ক্লিষ্ট নুরুদ্দিনরা প্রায় সর্বহারা হয়ে পড়ে। তাই ধান কেটেই ওগুলো বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেই হয়।ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায় মনের মতো এবং যুৎসই খরিদ্দার পেতে। এই ভরমৌসুমে বাজারের বড়বড় ব্যবসায়ীরা এবং চালকল মালিকরা হলো কৃষকদের খরিদ্দার। বিলাসবাবু আর আহাদ মিয়াদের পেটতো অভাবের তাড়নায় চু-চু করে না যে, মাল না-কিনলে পেটে আগুন জ্বলবে। উনারা দরদাম নির্ধারণ করে দিয়ে বাজারে দালাল লাগিয়ে দিয়ে টাকার বাক্স নিয়ে গদিঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। এই সুযোগে দালালরাও বাজারটাকে হাতে নিয়ে দল বেঁধে লোফালুফি করে; ওদেরওতো কিছু কামাতে হবে নাকি? আর বাজারে প্রতিযোগিতার ব্যাপার থাকা সত্ত্বেও তখন সকল ব্যবসায়ী একত্রে জোট বাঁধে। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে আর কৃষকদের মনের মতি-গতি পর্যবেক্ষণ করে। অবশেষে মূল্য নামের পাখিটি মাটিতে লুটোপুটি খায়। আর তার সাথে বাংলার কাণ্ডারী কৃষকদের প্রাণ ব্যবসায়ীদের পদদলনে একীভূত হয় মাটির বুক। ব্যবসায়ীদের মনগড়া দাম নির্ধারণের কাছে কৃষক সম্প্রদায়গণ অনন্যোপায় হয়ে দালাল আর ব্যবসায়ীদের কাছে নিজেদের সপে দেন। কারণ তাদের কোমড়ে যে দড়ি বাঁধা; বেশিদিন অপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। অতিসত্ত্বর ঋণ পরিশোধ করতে হবে নইলে জোয়াল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে জীবন থেকে।*নানান চিন্তা-ভাবনা এই মুহূর্তে মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে নুরুদ্দিনের। আবার ফাঁকে ফাঁকে হিসেব কষছে ধান ঘরে তোলার পর কাকে কত পরিশোধ করতে হবে। মুহূর্তেই নুরুদ্দিনের মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল; এবারও অবস্থা একই বরং আরও নাজুক হবে। এমনও হতে পারে আগামির অভাবটা আরও পূর্বলগ্নেই দেখা দিতে পারে। যাক্ সবই আল্লাহর ইচ্ছা; নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। বাড়ির আঙিনায় এসে স্ত্রী বিলকিসকে চড়া গলায় ডাক দিলেন। বিলকিস বানু যন্ত্রমানবের মতো ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন। ঘরের খাবার স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে নুরুদ্দিন ক্ষেতের উদ্দ্যেশে রওনা হলেন। আর যাওয়ার আগে বলে গেলেন; বড় ছেলে দু\'জনকে ক্ষেতে পাঠানোর জন্য। এছাড়া বিলকিস বানুর সাথে তেমন কোন বাক্য বিনিময় করেননি নুরুদ্দিন। যদিও অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে; এত ফসল হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রায়ই না খেয়ে কষ্ট করতে হয়। হয়ত ভেবে-চিন্তে কিছু না পেয়ে অবশেষে নিজের কপালকে দায়ী করেন অথবা আল্লাহর কৃপার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অতীতের দিনগুলো কীভাবে অতিবাহিত হলো তার কোন পর্যবেক্ষণ ওরা কেউ কোনদিন করে না। আর যারা পর্যবেক্ষণ অথবা হিসাব করে তারা এই দুর্বিষহ পাঁক থেকে মুক্ত হয়।নতুন ধান যখন ঘরে ওঠে তখন সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়। মাছ, সবজি, জিলাপী, আইসক্রম, নারকেল, হাড়ি-পাতিলসহ নানা জাতীয় প্রসাধনী সামগ্রী ইত্যাদি নিয়ে যখন ফেরিওয়ালারা আসে তখন গ্রামের বধুরা ধানের বিনিময়ে এসব কিনে রাখে। আর প্রতি বছর একটি করে মুখ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেদিকে কোন হিসাব নেই বা হিসাব করার প্রয়োজনবোধ কখনও মনে জাগ্রত হয় না। মোটা পাইপের মুখ থেকে পানি বের হয়ে ক্ষেতের দিকে ধাবিত হচ্ছে প্রবল স্রোত হয়ে; পরমতৃপ্তিতে তাকিয়ে দেখছে নুরুদ্দিন। নালা ক্ষেতে ক্ষেতে মুখ করা আছে; গড়িয়ে গড়িয়ে ক্ষেতে প্রবেশ করছে। পানি ক্ষেতে প্রবেশ করছে আর ফাটা দাগগুলো রাক্ষসের মতো গপাস গপাস করে যেন গিলে খাচ্ছে। পরম স্নেহের দৃষ্টিতে শুষ্কপ্রায় ধান গাছের ডগায় হাত বুলাচ্ছে আর বারবার নীল আকাশে তাকিয়ে দেখছে নুরুদ্দিন। আকাশের কোথাও সামান্যতম মেঘের ছোঁয়া নেই; আকাশ একেবারে ফকফকা পরিষ্কার। আজ সম্ভবতঃ পূর্ণিমা; রাতে পূর্ণ চন্দ্রিমা পৃথিবীর বুকে দিগন্তছোঁয়া আলো ছড়াবে। শুভ্র মেঘ উড়ে উড়ে দূর আকাশের বুকে মিলিয়ে যাবে। আর সেদিকেই নুরুদ্দিনের দৃষ্টি থাকবে সর্বক্ষণ। নুরুদ্দিন প্রতিবারই চৈত্রমাসে আকাশ দেখে আর ক্ষেতের খাদ্য যোগায়। নিজের খাবার রীতিমতো না জুটলেও ক্ষেতের খাবার জোগার করতে হয়। প্রতিবছর নুরুদ্দিনেরা ক্ষেতে সোনার ফসল ফলায়; ঝড়, বৃষ্টি, রোদ আর খরা মাথায় নিয়ে ওদের ফসল ফলাতে হয়। সেই ফসলের গন্ধে সকলের স্থায়ী সুখ বর্ধিত হয়; জীবন রক্ষা হয়। আর নুরুদ্দিনদের আগামীতে ঋণ পাবার পথটা পরিস্কার করতে হয়। শেষ রচনাকাল: ২২.০৫.১৯৯২, জগন্নাথ হল, ঢাবি
প্রতিবছর নুরুদ্দিনেরা ক্ষেতে সোনার ফসল ফলায়; ঝড়, বৃষ্টি, রোদ আর খরা মাথায় নিয়ে ওদের ফসল ফলাতে হয়। সেই ফসলের গন্ধে সকলের স্থায়ী সুখ বর্ধিত হয়; জীবন রক্ষা হয়। আর নুরুদ্দিনদের আগামীতে ঋণ পাবার পথটা পরিস্কার করতে হয়।
0 Comments