
রোশনীরা বেঁচে থাকলে বেগম রোকেয়া হয়, মাদার তেরেসা হয় আর মরে গেলে হয় হৈমন্তী, শকুন্তলা। সমাজ তাদের আসবাবপত্রের মতো ব্যবহার করে কিন্তু দহনে পোড়ে তার পরিবার, প্রেমিক কিংবা প্রিয়জন ।
সিগারেটে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতেই রুহিত চায়ের অর্ডার দেয়। সিগারেট আর চা একসাথে খাওয়া তার পুরোনো অভ্যাস। রুহিত খেয়াল করলো দোকানটার স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। আগের বাক্স টিভির জায়গায় এখন চলছে স্মার্ট টিভি। আগে যেটাতে বাংলা সিনেমা চলতো এখন সেখানে হিন্দি মুভি চলে। এখন যেটা চলছে তার নাম ‘থ্রি ইডিয়টস’। রুহিত নিজেও মুভিটা দেখেছে। সিনেমার প্রতি রুহিতের আগ্রহ বেড়েছে মূলত রোশনির কারণেই। আগে যেখানে সে কালে-ভদ্রে সুযোগ পেলে সিনেমা দেখত এখন সে নিয়মিত সুযোগ করে সিনেমা দেখে।এই যেমন গতকাল দেখেছে জুলিয়া রবার্টস’র নটিং হিল। রজার মিশেল পরিচালিত এই রোমান্টিক কমেডি চরিত্রে জুলিয়া রবার্টস যেন অবিকল রোশনি।স্কুলের ইউনিফর্ম পরে দুজন ছাত্রও এককোনে বসে সিগারেট খাচ্ছে। রুহিত সিগারেট খায় প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় অথচ এখনো সে মুরুব্বী বা বয়োজেষ্ঠ কেউ থাকলে সিগারেট মুখে তোলার সাহস করে না । অথচ ছেলে দুটি কেমন নিঃসংকোচ, নির্বিকার! তাদেরই একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করছে-এই মুভির আসল ইডিয়ট কে-রাজু, ফারহান নাকি র্যাঞ্চোরদাস?মানুষের চিন্তা কখনো কখনো যে তার কাছের মানুষের আচরণ সংক্রমণের দ্বারা প্রভাবিত হয়, রুহিত এখন সেটা টের পাচ্ছে। তবে আক্রান্তকাল আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে, করোনাকালীন সময়ে। মিস করোনা’র দ্বারা।‘’মিস করোনা’’-হ্যা রুহিত এই নামেই নং টা স্টোর করেছে ফোনে। মেয়েটার আসল নাম রোশনি কিন্তু রুহিত তাকে পরবর্তীতে এনামেই বেশি ডাকতো। রোশনি থাকলে এতোক্ষনে ছেলেদুটোকেই আগে ইডিয়ট বানিয়ে ছাড়তো। প্রথমে কড়া হেডমাস্টার এর মতো সিগারেট বন্ধ করাতো। তারপর বলতো-এবার বল আসল ইডিয়ট কে? ছেলেদুটো হয়তো নিজেদেরকেই ইডিয়ট ভাবতে শুরু করেছে তখনই রোশনির উত্তর- আসল ইডিয়ট হচ্ছে এই ছবির কাহিনীকার। বল কেন? ছেলেদুটো এবারও সুযোগ পাবে না। তার আগেই রোশনি\'র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু, ঠিক এভাবে--দেখ, ছবিতে দেখানো হয় ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল রেজাল্টে র্যাঞ্চোরদাস প্রথম হয় অথচ রাজু আর ফারহান তার রেজাল্ট খুজতেছিলো নিচের দিকে! এত কাছে থেকেও ওরা কিছু বুজতে পারলো না কেন? আর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে যে কয়েক বছর লাগে যেখানে অনেকগুলো পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়, কাহিনীকার সেটাও মিস করেছেন। কাজেই প্রকৃত ইডিয়ট আসলে কাহিনিকার নিজে।রুহিত খেয়াল করলো, তার ভাবনাগুলো রোশনি\'র হয়ে কাজ করছে ঠিক ছেলেদুটো যেভাবে ইডিয়ট এর প্রভাবে নিজেদের স্টুডেন্ট সত্তা ভুলে গেছে। সে ছেলে দুটোকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।রুহিত ফোনটা বের করে। কয়েকবার রোশনীকে কল এ নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু নং টা বন্ধ পায়। কিন্তু ও তো বলেছিলো কখনোই এই নং টা নষ্ট করবে না। ব্রেকাপ সত্বেও রুহিত গতবছর জন্মদিনে ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল, রোশনি সিনও করেছিলো। কিন্তু কোনো উত্তর আসে নাই। রুহিত হোয়াটসঅ্যাপ খোলে, মেসেজটা তার মুখস্ত তবুও সে প্রতিটা লাইন ধরে ধরে পড়ে-“এখনো অসমাপ্ত লানচোন নেই গরম স্যুপের ঘ্রান, সুঘ্রাণে তোমার চুল নেই লাল ঠোঁটের আহবান, সেই ঝুমকো কানের দুল’’।রোশনি বই পড়তে পছন্দ করতো, কবিতার ছন্দে মেসেজ পছন্দ করতো। অথচ---ভালোবাসা বুঝি এমনি, যার মায়ায় পরে রুহিত একদিন সব রাগ বিসর্জন দিয়েছিলো আজ সে রাগই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।রুহিত যেখানে বসে আছে সেখান থেকে রেস্ট্ররেন্ট টা স্পষ্ট দেখা যায়- ‘দ্য লান্চোন’-আগে ফুটওভার ব্রিজের পাশেই ছিলো কিন্তু অবস্থান উন্নত হয়ে এখন এটি পাশের নতুন বিল্ডিং এর ৪ তলায় বসেছে।রুহিত খেয়াল করলো ফুটওভার ব্রিজটাও আর নাই। অথচ এই ফুটওভার ব্রিজ, রেস্ট্ররেন্ট, চায়ের দোকান আর এর আশপাশের অলি-গলি সব রোহিত চিনেছে রোশনির কাছ থেকেই। রোশনির সাথে রুহিতের প্রথম দেখা এক ভীষণ ঝড়-বৃষ্টির দিনে। ঠিক ঝড়ের মতোই রোশনি আসে তার জীবনে।দুপুরের খাবার খেয়ে রুহিত আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ছিল হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতেই বিদ্যুৎ চলে যায়। মুহূর্তেই দিনের আবহ যেন রাতের অন্ধকারে রূপ নেয়।বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, রুহিত জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বারান্দায় কারো অবয়ব খেয়াল করলো। মেঘে মেঘে বিপরীতমুখী আকর্ষণের প্রভাবে সৃষ্ট এ আলোর ঝলকানি বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা মানলেও এই মুহূর্তে যেটা ঘটছে তার কোনো ব্যাখ্যা রুহিতের কাছে নেই। ছুটতে থাকা এক একটা বিদ্যুতের ঝিলিক প্রতিসরণের সূত্র মেনে তীব্র বেগে যেন রুহিতের অন্তরাত্মা ভেদ করে চলেছে ।রুহিত আপাদমস্তক বোঝার চেষ্টা করলো । মুখের উপর ভেজা কালো কেশ আড়ালে একজোড়া রহস্যময় চোখ তাতে অন্তঃপুরের টান, গড়িয়ে পড়া জলের ধারায় কম্পিত ওষ্ঠাধর যেনো এন্টার্কটিকার ডোম ফুজি তাতে বিস্তৃত ভয়ানক শীতলতা, আধো ভেজা কাপড়-পরতে পরতে যেনো আগ্নেয়গিরির উদগিরণ ।রুহিত যেন খেই হারিয়ে ফেলে, সব কিছুই কেমন এলোমেলো মনে হয় । প্রকৃতির ঝড় ক্রমাগত তার হরমোনকে প্রভাবিত করছে , জীবনের সাতকাহন পার হবার এইতো সময়। আগ্নেয়গিরির বুকে ঝাপিয়ে পড়ার প্ররোচনায় কিছুতেই স্থির রাখতে পারছে না নিজেকে।আর রোশনি! রোশনি যেন ঝড়ের ঝাপটায় ভেসে আসা সেই সুখ পাখি যার উপস্থিতি’য় একাকিত্ত ভাংবে নীড় । রোশনি খেয়াল করলো একটা আগত উষ্ণ হাত তাকে মেঘের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য ডাকছে, রোশনীও সেই মেঘের ভেলায় নিজেকে সপে দেয় বিনা দ্বিধায় ।যে পাখিটি একা নীড়ের স্বপ্ন বুনেছে এতোদিন, আজকের বর্ষা তার। আজকের দিন তার বজ্রের হুমকি উপেক্ষা করার। আজকের সময় তার মেঘের আলিঙ্গন পাবার, যে আলিঙ্গনের উষ্ণতায় সূর্য ঢেকে যাবে লজ্জায়। পৃথিবীর সকল প্রলয়ের বেগ এ প্রনয়ের আবেগের কাছে আজ তুচ্ছ।অন্ধকারে ভালো কম থাকে বলেই তার রং কালো, তবুও যতটুকু ভালো তার আনন্দ নিখাদ। সেই আনন্দের ঢেউয়ে রুহিতের জীবন নদী আজ উথাল-পাতাল।রুহিত খেয়াল করলো ঝড় থেমে গেছে, আস্তে আস্তে সূর্য আলো বাড়িয়ে চলেছে । প্রকৃতির সজীবতায় একাত্ম হয়ে এরইমধ্যে বিদ্যুৎও চলে এসেছে ।কিন্তু তার ঘোর কাটছে না । ওদিকে রূপম(রুহিতের ভাই) আসার সময় হয়ে গেছে ।জীবনে নানাভাবে পোড় খাওয়া মানুষ রুহিত। খুব ছোট বেলায় মা-বাবা হারানো একমাত্র ভাই কে নিয়ে ব্যাচেলর জীবনে আজ এখানে তো কাল ওখানে। একমাসও হয় নাই রুহিত এই বাসায় উঠেছে। মফস্বল এলাকায় একতলা এই টিনশেড বাড়িটি প্রথমে বিরক্তিকর হলেও আজ যেন সেটা স্বর্গ মনে হচ্ছে ।রুহিত সাধারণত গলির দোকানটায় বসে না কারণ এখান থেকে ওদের বাসাটা স্পষ্ট দেখা যায় কিন্তু আজ এখানেই বসে সিগারেট খাচ্ছে, উদ্দেশ্য একটাই- যদি রোশনি\'র কোনো খোঁজ পাওয়া যায়।পরপর তিনদিন তাকে দেখতে না পেয়ে রুহিত যারপরনাই হতাশ। ওদিকে অফিসেও ঠিকমতো কাজে মন বসাতে পারছে না।অবশেষে এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে ফুটওভার ব্রিজের পাশে রোশনি কে আবিষ্কার করে রুহিত।রোশনির ইচ্ছা ছিলো সাতদিন রুহিতের সামনে আসবে না কারণ টানা সাতদিন এখানে এইসময় দাঁড়িয়ে থেকেও সে রুহিতের দৃষ্টিসীমায় আনতে পারেনি নিজেকে। কিন্তু এ অপেক্ষার দহনে আজ সে নিজেও যে পুড়ছে। অপেক্ষাটা তাই তিনদিনের বেশী হয়নি।রুহিত আঙুলে তাপ অনুভব করে , সিগারেটটা এরই মধ্যে নিজের শেষকৃত্য শেষ করেছে। রুহিত পিছনে ফিরে তাকায়, ফুট ওভার ব্রিজটা দেখার চেষ্টা করে কিন্তু এটাতো এখন কেবলই স্মৃতি।রুহিত আবারও ট্রাই করে, ফোন নং টা এখনো বন্ধ দেখাচ্ছে।রুহিত একসময় রোশনিদের বাসায় প্রায়ই যেত। আদিরা বেগম খুব যত্ন করে তাদের খাওয়াতেন। এই মহিলা রোশনী’র পালিত মা, এক নিভৃত পল্লীর অন্ধকার জীবনে রোশনীকে রাখতে চাননি কখনো, চেষ্টা করেছেন পড়ালেখা শিখিয়ে সভ্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কিন্তু নিজের এক প্রাণঘাতী রোগ তার সেই প্রচেষ্টা থামিয়ে দেয় যখন রোশনি কলেজে পড়ে।মায়ের শারীরিক অসুস্থতা আর সংসারের বোঝা বাধ্য হয়েই রোশনীকে দায়িত্ত্ব নিতে হয়। কিন্তু এই দায়িত্বের বোঝাই আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে থাকে।প্রচন্ড একরোখা আর জেদী স্বভাবের রোশনি কখনোই চায়নি রুহিতের কাছে সাহায্য নিয়ে তাদের সম্পর্ককে ছোট করতে অপরদিকে রোশনি\'র এই এলোমেলো ছোটাছুটি রুহিত সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে।যার চূড়ান্ত রূপ পায় মাত্র সাতদিনেই। রুহিত রোশনীকে আদিরা বেগম ভাবতে শুরু করে। সন্দেহের শুরুটা মোড়ের চায়ের দোকানের লোকজনের কথাবার্তায় আর রোশনি\'র হঠাৎ হঠাৎ আড়ালে চলে যাওয়া তার মনে এতোটাই ক্রোধ আর ঘৃণার জন্ম দেয় যে একসময় সে সিদ্ধান্ত নেয় এখান থেকে চলে যাবে। তাছাড়া রোশনীকে আর আগের মতো যখন তখন ফোনে পাওয়া যায়না, ওদিকে রূপমও ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। সিদ্ধান্ত টা তাই রুহিতের জন্য আরো সহজ হয়ে যায়।একসপ্তাহের মধ্যে রুহিত ঢাকায় বাসা ভাড়া করে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। যদিও রোশনি শেষবারের মতো রুহিতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অথচ রুহিত তাকে দিগুন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বুকে অজস্র যন্ত্রনার কাটা আর রুহিতের অপমানের তীর সহ্য করেও রোশনি সেদিন মুখফুটে কিছু বলে নি শুধু তাকিয়েছিলো নিঃশব্দে।তার কিছুদিন পরেই পৃথিবী স্থবির হয়ে যায় লকডাউন এর ছোবলে এবং সাথে হয়তো তাদের সম্পর্কও।রুহিত সেদিনের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। যেকরেই হোক রোশনীকে খুঁজে বের করে তার সামনে দাঁড়াবে, তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে। নং টা এখনো বন্ধ।অবশেষে রুহিত সিদ্ধান্ত নেয় আদিরা বেগমের বাসায় যাবে। কিন্তু ওরা কি এখনো থাকে ওই বাসায়? রুহিতকে কি আর আগের মতো মেনে নেবে? যদি সামনে না আসে তবে!!মনের ভিতর সুনামির ভয়, তবুও পাহাড় সম প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে যায় রুহিত।জায়গাটায় আর আগের মত চঞ্চলতা নাই। সামনের ফাঁকা জায়গায় নতুন ছয়তলা বিল্ডিং উঠেছে। পিছনেই বাড়িটি, এতোটাই জরাজীর্ণ দেখলে মনে হয় কেউ থাকে না বহুকাল। ভিতরে কোনায় পাতা বিছানায় কংকালসার যিনি শুয়ে আছে তিনিই আদিরা বেগম।রোশনি\'র কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি কেঁদে উঠলেন। কি হয়েছে রোশনি\'র? আবার জিজ্ঞেস করে রুহিত।করোনার সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কমিশনারকে বাঁচালো অথচ তার পোলাটা আমার মেয়েটারে বাঁচতে দিল না। কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বদমাশটা আমার মেয়েটাকে মেরে ফেললো। মেয়েটা আমার জীবনের বিনিময়ে উপকারের প্রতিদান দিল। রুহিত যেনো আর কিছু শুনতে পায়না। কথাগুলি ক্রমাগত তার কানে প্রতিদ্ধনি হতে থাকে। নাদিরা বেগম রুহিতকে কাছে ডাকে, তার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দেয়।রুহিত এলোমেলো হাটতে থাকে, তার পা যেন চলেনা। যে বাসাটায় রুহিত থাকতো তার সামনে এসে সে থমকে যায়। একটা সাইনবোর্ড তাতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাঝে হাস্যজ্জল রোশনীর ছবি।একটা এনজিও এর আর্থিক সহায়তায় গড়া স্কুলটি রোশনি সাজিয়েছিল খুব যত্নে অথচ সে নিজেই আজকে…একটা স্কুল করার ইচ্ছা প্রায়ই শেয়ার করতো রোশনি। হয়তো নিজের পড়ালেখাটা শেষ করতে পারেনি তাই।রুহিত আস্তে আস্তে দোকানের কাছে চলে আসে, সিগারেট ধরায়। মনে মনে ভাবে, দোকানের মতো সমাজটাকেও যদি সহজে বদলে ফেলা যেত!যে সমাজে ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকবে না, জাতি-ধর্মের পার্থক্য থাকবে না, থাকবে না সুবিধাবাদী এলিটদের কর্তৃত্ব।ভালোবাসাই হবে সেখানে একমাত্র ধর্ম, সেবার ব্রত নিয়ে যেখানে রোশনীরা নির্দ্বিধায় ঝাপিয়ে পড়বে মানুষের পাশে। এইতো করোনার সময়ে যখন মৃত্যুর করাল গ্রাসে পৃথিবী থমকে গিয়েছিল তখনও রোশনীরা ‘মিস করোনা’ হয়ে সেবা দিয়ে গেছে। নিজে আক্রান্ত হয়েছে তবুও থেমে যায়নি। অনিবার্য মৃত্যর ভয়কে জয় করেছে, করোনা হেরেছে মিস করোনা’র কাছে।রোশনীরা বেঁচে থাকলে বেগম রোকেয়া হয়, মাদার তেরেসা হয় আর মরে গেলে হয় হৈমন্তী, শকুন্তলা। সমাজ তাদের আসবাবপত্রের মতো ব্যবহার করে কিন্তু দহনে পোড়ে তার পরিবার, প্রেমিক কিংবা প্রিয়জন ।সমাজ তো আর গায়ের জামা নয়, তাকে তাই বদলানো যায় না।রুহিত বাইরে এসে দাঁড়ায়। সে আকাশের দিকে তাকায়। সূর্যের কৌণিক দূরত্বে থাকা চাঁদটাকে আজ বড্ড মলিন লাগছে তার। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের আড়ালে পালহীন নৌকার মতো একবার ডুবছে একবার উঠছে। সে দুহাত প্রসারিত করে মেঘগুলো সরাতে চায় কিন্তু রুহিত জানে না এ তো অসীম দূরের পথ! যার সীমানা ধরা যায়না, ছোয়া যায়না। আকাশের সমস্ত মেঘগুলো তার চোখ ভারী করে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে। সে হাঁটতে পারে না, তার সমস্ত শক্তি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রে আটকে যায়।ভালোবাসার সফল পরিণতিই হয়তো বিচ্ছেদে। তবুও এ বিচ্ছেদ, এ বিয়োগব্যাথায় রুহিতকে পুড়তে হবে বহুকাল।রুহিত আদিরা বেগমের কাছে পাওয়া প্যাকেটটা খোলে, নীল-সাদা র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা বই। লেখক রুহিতের প্রিয়-পূর্ণেন্দু পত্রী। ভিতরে নীল কাগজের উপর কালো কালিতে স্পট করে লেখা কয়েকটা লাইন-আশায় বুক বেঁধে রইলো সে অপেক্ষায়!পোড়াকপালি জানেই না-কিছু ধৈর্য আজীবনের হয়!সবাই ভোগের আশায় বলতো ভালোবাসি!পোড়াকপালি জানতোই না-গোপনে গোপনে সে যৌনদাসী!ভালোবাসা বাসি হলে অভিমানও বিষ ছড়ায়, রোশনি\'র মনের গহীনে জমানো অভিমানে নিশ্চয়ই কোনো বিষ ছিলো না। তবুও রুহিতের জীবন এ বিষেই নীল হয়েছে প্রকৃতিগতভাবেই।বেশকিছুদিন পর…দুটো বিশেষ কারণে আজ রোহিতের মন কিছুটা ভালো।এক, নীল কাগজে লেখা উপরের লেখাগুলোর লেখকের নাম সে খুঁজে পেয়েছে, নাম - রুমীজ উদ্দিন খান।দুই, রোশনি\'র স্কুলটাকে চালু করা গেছে।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, রোদ্রৌজ্জ্বল বৃষ্টি। বৃষ্টির রং যত ধূসর তাতে মায়া তত বেশি, আবেগ তত বেশি।রোদ্রৌজ্জ্বল বৃষ্টিতে চোখের বৃষ্টি আড়াল করা সত্যিই কষ্টকর।…………………….***………………………………
রোশনীরা বেঁচে থাকলে বেগম রোকেয়া হয়, মাদার তেরেসা হয় আর মরে গেলে হয় হৈমন্তী, শকুন্তলা। সমাজ তাদের আসবাবপত্রের মতো ব্যবহার করে কিন্তু দহনে পোড়ে তার পরিবার, প্রেমিক কিংবা প্রিয়জন ।
0 Comments