

গল্পপুনর্মিলনআফছানা খানম অথৈশাহাজাদা ফয়সল শিকারে গেল সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে।শিকার করতে করতে বনের ভিতর ঢুকে পড়ল।সূর্য ঠিক মাথার উপরে। কড়া রোদ পড়ছে।শরীর থেকে তরতর করে ঘাম ঝরছে।খুব পানির পিপাসা লেগেছে।কিন্তু পানি কোথায় পাবে।বনের আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে হাটতে লাগল।হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছোট্ট কুটির।শাহাজাদা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।তারপর বলল,ঘরে কেউ আছেন?একটু পানি খাওয়াবেন?সে কী!ঘর থেকে বের হল এক রুপসী কন্যা।এলোকেশী আউলাবেশে,তবু সৌন্দর্যের কমতি নেই।হরিণীর চোখ মায়াবী চেয়ারা,মনে হয় মানুষ নয় পরী।শাহাজাদার চোখ উপরে উঠে গেল।হা করে তাকিয়ে রইল।মেয়েটি হাত বাড়িয়ে বলল,এই লন পানি।শাহাজাদার পলক যেন পড়ছে না।সে ভাবে এত সুন্দরী মেয়ে এ জঙ্গলে আসল কোত্থেকে, মনে হয় মানুষ নয় পরী।তার ঘোর যেন কাটছে না।সে আবার বলল,কী হা কইরা ছাইয়্যা রইলেন ক্যান।এই লন পানি।শাহাজাদার ঘোর কাটল।সে ঢগ ঢগ করে পানি খেয়ে পিপাসা মিটালো।কিন্তু মেয়েটিকে ভুলতে পারল না।তার জন্য মনের মন্দিরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল।ফিরে আসতে মন চাইল না।তবুও আসতে হলো।কিন্তু সে কি বারবার তার কথা মনে পড়ছে।শত চেষ্টা করেও তাকে ভুলতে পারছে না।আশ পাশ চারদিকে যেন সে ছায়া হয়ে ভাসছে।সে মেয়েটির প্রেমে পাগল।পরদিন ছুটে গেল মেয়েটির বাবার কাছে।কোন বনিতা না করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো।কোহিনুরের বাবাতো অবাক।তার মতো কাঠুরিয়ার মেয়েকে বিয়ে করবে শাহাজাদা।তা কি করে সম্ভব? রাজা শুনলে গর্দান যাবে।এই ভয়ে তিনি না করে দিলেন।কিন্তু শাহাজাদা নাছোড় বান্দা। সে কোন বুঝ ভরসা মানছে না।সে বিয়ে করবেই করবে।কাঠুরিয়া বাধ্য হয়ে কোহিনুরকে শাহাজাদার সঙ্গে বিয়ে দিলেন।শাহাজাদা কোহিনুকে নিয়ে মহলে ফিরে আসল।রাজা জিজ্ঞেস করলেন,শাহাজাদা তোমার সঙ্গের মেয়েটি কে?জ্বী জাঁহাপনা আমার স্ত্রী কোহিনুর।শাহাজাদা তুমি কী বলছ বুঝতে পারছ?জ্বী জাঁহাপনা পারছি।তাহলে বলো মেয়েটি কে? কোন রাজার মেয়ে?জ্বী জাঁহাপনা কোহিনুর কোন রাজার মেয়ে নয়।আমাদের রাজ্যের কাঠুরিয়ার মেয়ে।কী!বললে কাঠুরিয়ার মেয়ে হবে রাজ পরিবারের বউ।তা কিছুতেই হতে পারে না।তাকে বনে ফেলে দিয়ে এসো।জ্বী না জাঁহাপনা আমায় ক্ষমা করুণ।কোহিনুর আমার বিবাহিতা স্ত্রী।আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে ফেলতে পারব না।আল্লাহ এমন অন্যায় বরদাস্ত করবেন না।এসব উপদেশ রাজাদের মাথায় ঢুকেনা।তিনি চোখ দুটো ছানা বড় করে বললেন,তুমি জান কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ?জ্বী জাঁহাপনা, এই রাজ্যের রাজা আমার আব্বাজানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।শাহাজাদা ভুলে যেওনা,রাজার হুকুমে রাজ্য চলে।তুমি আমার হুকুম মানবে না তাতো হতে পারে না।আমি হুকুম করছি কোহিনুরকে বনে ফেলে দিয়ে এসো।জ্বী না জাঁহাপনা পারব না পারব না।কোহিনুর আমার প্রাণ।তাকে ছাড়া থাকতে পারব না।তাহলে সিংহাসন হারাবে।আমি সিংহাসন চাই না।কোহিনুরকে নিয়ে বাঁচতে চাই।সেই সুযোগ তুমি পাবে না।সেনাপতি শাহাজাদাকে বন্দি কর।শাহাজাদাকে বন্দি করা হল,আর কোহিনুরকে তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো।রাজার কড়া নির্দেশ সে যেন কখনো মহলে ফিরে না আসে।যদি আসে বাবা মেয়ে দুজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হবে।এর ফাঁকে কেটে গেল কিছু সময়।কোহিনুরের কোল জুড়ে আসল এক পুত্র সন্তান।রাজ পরিবারে যার জন্ম হওয়ার কথা ছিল তার জন্ম হলো বনের ছোট্ট কুটিরে তবুও তার সৌন্দর্যের কমতি নেই।একেবারের রাজ পুত্রের মতো চেহার হুবাহুব শাহাজাদা ফয়সলের মতো।কোহিনুর তার স্বামীর নামের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম রাখল ফাহাদ।হাসি আনন্দে ভরে উঠল কাঠুরিয়ার ঘর।এদিকে শাহাজাদা ফয়সল কিছুতেই কোহিনুরকে ভুলতে পারছে না।দিনরাত তার কথা ভাবছে।অনেকবার রাজার হাতে পায়ে ধরে কেঁদেছে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য।রাজার এককথা তাকে ছাড়বে না।ছাড়তে পারে এক শর্তে যদি সে কোহিনুরকে ভুলে যাই।কিন্তু শাহাজাদা ভুলতে পারছে না,তাই মুক্তি ও পাচ্ছে না।কিন্তু ভালোবাসা কখনো বন্দি করা যায় না।সে চলে আপন গতিতে সীমানা পেরিয়ে।কেউ তাদেরকে আটকাতে পারে না।ভালোবাসা মানে সুখ,ভালোবাসা মানে শান্তি,ভালোবাসা মানে অন্তরের অনুভূতি। এই অনুভূতি কখনো ভুলা যায় না।তাই শাহাজাদা কোহিনুকে ভুলতে পারছে না।একদিন মহারানী বলল,জাঁহাপনা একটা কথা বলতে চাই?মহারানী বলো।ফয়সলকে ছেড়ে দিন।কোহিনুরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন।কী!বললে মহারানী, সামান্য কাঠুরিয়ার মেয়েকে করব রাজ পরিবারের বউ।তা কখনো হতে পারে না।মাফ করবেন জাঁহাপনা। কেন পারে না?গরীব বলে কি ওরা মানুষ না?মানুষ তবে গরীব মানুষ।যাকে যেখানে মানায় তাকে সেখানে রাখতে হয়।কোহিনুরের কোন যোগ্যতা নেই এই মহলে আসার।কথাটা মাথায় রেখ।রাজার ক্ষমতার কাছে রানী হেরে গেল।শাহাজাদা মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ে।আবার চিকিৎসা সেবায় সুস্থ হয়,কিন্তু পুরোপুরি না।কারণ ভালোবাসায় আহত হৃদয় কখনো সুস্থ হতে পারে না।এদিকে ফাহাদ সময়ের গন্ডি পেরিয়ে বড় হয়ে উঠল।একদিন সে তার মাকে বলল,মা আমার বাবার নাম কি?কেনো রে ফাহাদ?কিছু না এমনি।আজ থাক অন্যদিন বলব।কেন মা, আজ বললে কী হয়?কিছু হবে নারে বাপ।সময় আসুক তারপর সব বলব।ভাত দিয়েছি খেয়ে নে।ফাহাদ আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।খেয়ে নানার সঙ্গে কাঠ কাটতে গেল।আবার ফিরে আসল।এভাবে কেটে চলেছে ফাহাদের দিনগুলো।কিন্তু তার মনে কোনো শান্তি নেই।যতই দিন যাচ্ছে ততই তার মনে প্রশ্নের ঝড় উঠছে।তার বাবা কে?কি করেন?মা কেনো নাম বলছে না।কারণ কী, তবে কী আমার বাবা...?না না তা হবে কেনো।মা তো বলল বাবা বেঁচে আছে।তাহলে নাম বলছে না কেনো?জানতে হবেই।একদিন তার এক সহপাঠী বলল,ফাহাদ তোর বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে মুখ ভার করে থাকিস কেন?তার মানে তোর কি বাবা নেই?এত বড় অপবাদ ফাহাদ সইবে কেমনে।সে কষে দিলো তার গালে চড়।সে কাত হয়ে পড়ে গেল।দুজনের মাঝে মারামারি লেগে গেল।পরক্ষণে সরি বলে মাফ চেয়ে নিলো।বাড়ি ফিরে মাকে বলল,মা আজ তোমাকে বলতে হবে আমার বাবা কে?যদি না বলি?তাহলে মনে করব আমি তোমার....।কোহিনুর আর থেমে থাকতে পারল না।কষে দিলো ছেলের গালে এক চড়।তারপর বলল,ফাহাদ তুই এত জঘন্য কথা বলতে পারলি।আজ আর কোনোকিছু লুকাব না,সবকিছু বলব।বলো মা চুপ করে থেকো না।।তোর বাবা এই রাজ্যের রাজ পরিবারের সন্তান,শাহাজাদা ফয়সল।আর তুই তার সন্তান শাহাজাদা ফাহাদ।তাহলে আমরা এখানে কেন?সে এক বড় কাহিনী।বলো মা,চুপ করে থেকো না।সে আর দেরী করলো না।ঘটে যাওয়া ঘটনা ছেলের কাছে প্রকাশ করল।সবকথা শুনার পর ফাহাদ বলল।আমি ছাড়ব না এই অত্যাচারী রাজাকে।শুরু হলো ফাহাদের প্রস্তুতি। রাজ বংশধর বলে কথা।কয়েক মাসের মধ্যে সে নিজেকে পরিপূর্ণ যোদ্ধা হিসেবে তৈরী করল।সৈন্যসেনা নিয়ে আক্রমণ করল রাজ সিংহাসান।চারদিকে হৈচৈ শুরু হলো।রাজার কানে খবর যেতে তিনি বললেন,সেনাপতি প্রস্তুত হও।আক্রমণ কর শত্রু পক্ষকে।তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি, সেনাপতি সৈন্যসেনা নিয়ে শত্রুপক্ষে আক্রমণ করল।শুরু হলো মুখোমুখি যুদ্ধ।পরাজিত হলো রাজার পক্ষ।ফাহাদ ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল রাজদরবারে।তারপর প্রথমে পিতা শাহাজাদা ফয়সলকে বন্দিঘর থেকে মুক্ত করলো।তারপর সিংহাসনে বসবাসরত রাজাকে বন্দুক নিশানা করলো।তাকে দেখে রাজা অবাক।চিৎকার করে বললেন,সেনাপতি এই ছেলের এত বড় দু:সাহস হয় কী করে মহলে ঢুকার?তোমরা কোথায় ওকে বন্দি কর।চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। কারো কোন সাড়াশব্দ নেই।ফাহাদ বলল,রাজা সাহেব কেউ আসবে না।সবাই পরাজিত বন্দি।আপনার ক্ষমতা শেষ। এবার আপনিও আমার হাতে বন্দি।এই তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?রাজাকে বন্দি কর।রাজার চারদিকে বন্দুক তাক করানো।নড়বার সুযোগ নেই।রাজা পরাজিত অপমানিত অপদস্থ।কিছু বলার সুযোগ নেই।বারবার ফাহাদের দিকে তাকাচ্ছে।কেন জানি চেনা চেনা মনে হচ্ছে।প্রশ্ন করল,হে বালক বন্দি করার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?জ্বী জাঁহাপনা বলুন।তুমি কোন রাজ্যের রাজা?জ্বী জাঁহাপনা আমি এই রাজ্যের রাজা।রাজপরিবারের বংশধর।হে বালক,ঠিক বুঝলাম না।জ্বী জাঁহাপনা আপনি বুঝবেন না।বুঝার মতো মন আপনার নেই।আপনার মন কলুষতায় অহংকারে ভরা।আপনি মানুষকে মানুষ মনে করেন না।প্রজাদের উপর অত্যাচার করেন।আপনাকে ছাড়া যাবে না।হে বালক আমার ধৈর্য আর মানছে না।বলো তোমার পরিচয়?জ্বী জাঁহাপনা বলছি শুনুন, কুড়ি বছর আগে যাকে গরীব বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন,উনি আমার গর্ভধারিণী কোহিনুর বেগম আর শাহাজাদা ফয়সল আমার জন্মদাতা পিতা।আমি রাজ বংশধর।আপনি নিষ্ঠুর অত্যাচারী,আপনার সাজা হওয়া দরকার।রাজা নম্রস্বরে বলল,দাদু ভাই তুমি ঠিক বলেছ।আমার সাজা হওয়া দরকার।দাঁড়িয়ে আছ কেন?, আমায় সাজা দাও,।জ্বী না দাদু পারব না।আমি এসেছি বাবাকে নিতে, চলো বাবা।দাদু ভাই যেওনা,তুমি আজ থেকে এই মহলে থাকবে।জ্বী না জাঁহাপনা যে মহলে আমার মায়ের জায়গা হয়নি।সে মহলে আমি থাকব না,থাকব না থাকব না।দাদু ভাই সত্যি আমার বড় ভুল হয়ে গেছে।আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে,জন্ম হোক যথা তথা,কর্ম হোক ভালো।তুমি রাজ পরিবারের ভবিষ্যৎ কর্ণধার।আজ থেকে এই সিংহাসনে তুমি বসবে।দাঁড়িয়ে আছিস কেন?আয় আমার বুকে...। অনেক সংগ্রামের পর ফাহাদ তার অধিকার ফিরে পেল।ফিরে পেল কোহিনুর তার স্বামীর অধিকার।ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সবাই মিট হলো।হলো তাদের মাঝে পুনর্মিলন। \"পুনর্মিলনের\" মধ্য দিয়ে সবাই একত্রে বসবাস শুরু করলো।
0 Comments