\"মা, আমরা কি মারা যাবো?\"নিজের ৭ বছরের মেয়ে আয়িশাহর উদ্বিগ্ন অথচ নিষ্পাপ কন্ঠে করা প্রশ্ন শুনে সুরাইয়াহর বুকটা বিষাদে ভরে উঠলো।ফিলিস্তিনের গাজা শহর। কিছুক্ষণ আগেই মধ্যরাত পেরিয়েছে, নতুন দিনের শুরু হয়েছে। যদিও সুরাইয়াহর কাছে প্রতিটি দিনই এক, আতঙ্ক ও বিষাদময়। বাইরে কিছুক্ষণ পর পর বিস্ফোরণের শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছে। বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে সুরাইয়াহরা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।এক সময় তাদের এ শহর কতই না সুন্দর ছিল, কিন্তু এখন এর অবস্থা চিন্তা করলেও নিজের মধ্যে একটা আতঙ্কের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ইস*রায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যার আজ কততম দিন সুরাইয়াহ জানেন না। তাদের এ বর্বর আক্রমণ শুরুর পর অল্প কয়েকটি দালান এখনো গাজা শহরে টিকে আছে।তার মেয়ে আয়িশাহর নামের এক অর্থ সৌভাগ্যবতী। ওর বাবা কি মনে করে মেয়ের এমন নামকরণ করেছিলেন সুরাইয়াহ জানেন না। এখন তাকে সেটা জিজ্ঞেস করাও সম্ভব না, কারণ আয়িশাহর বাবা কয়েকমাস আগে ইস*রায়েলি বোমার আঘাতে শহিদ হয়েছেন। স্বামীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখে সুরাইয়াহ কাঁদতে পারেননি, হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তার স্বামীর শরীরের বেশ কিছু অংশ বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল, অথচ তার মুখে ছিল প্রশান্তির হাসি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেছেন। সুরাইয়াহ বাস্তবে ফিরে এসে মেয়ে আয়িশাহর দিকে তাকালেন, \"না, মা। আমাদের কিছু হবে না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন।\" যদিও তার গলায় খুব জোর পাওয়া গেলো না।\"মা, আমাদের উপর যারা বোমা ফেলছে, তারা কি জানে না এখানে আয়িশাহর মত অনেক ছোট ছেলে-মেয়েরা আছে?\"এবার প্রশ্নটা এলো তার বড় ছেলে মাহমুদের কাছ থেকে। মাহমুদের বয়স ১০, ইতিমধ্যেই সে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। যদিও এ বয়সে তার অনেক প্রাণবন্ত ও উচ্ছল থাকার কথা। কিন্তু এ ইস*রায়েলি বর্বরতা তার মধ্যে এক ধরনের দায়িত্বশীলতাবোধের জন্ম দিয়েছে। কারণ তার বাবার অনুপস্থিতিতে তাকেই তো তার পরিবারকে রক্ষা করতে হবে।সুরাইয়াহ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, \"জানি না, বাবা। হয়তো তারা জানে, কিন্তু এতে তাদের কিছুই আসে যায় না। যখন কারো প্রতি কারো শত্রুতা ও ঘৃণা অনেক বেড়ে যায়, তখন তাকে আর মানুষ হিসেবে মনে করা হয় না। তারা হয়তো আমাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না।\"\"কেনো, মা? আমরা কি মানুষ না? আচ্ছা মা, যারা আমাদের উপর বোমা ফেলছে, তারা অনেক খারাপ, তাই না? কিন্তু কেউ তাদের কিছু বলে না কেনো?\"\"বাবা, প্রতিবাদ করতে সাহস লাগে, অনেকের সেটা নেই। অনেকেরই হয়তো আমাদের নিয়ে কিছু যায় আসে না, কারণ বোমা তো তাদের মাথার উপর পড়ছে না। অনেকে হয়তো তাদের নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত, আমাদের নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের নেই। আর অনেকে.... তারা আমাদের দুর্দশা দেখেও এড়িয়ে যায়, কারণ কিছু করার থেকে এড়িয়ে যাওয়া অনেক সহজ।\"\"আচ্ছা, মা। অন্য মুসলিমরা আমাদের জন্য কিছু করছে না কেনো?\"সুরাইয়াহ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কম্পিত কন্ঠে বললেন, \"বাবা, কেউ কেউ সাহায্য করতে চায়, কিন্তু তারা অনেক নগণ্য, তাদের পক্ষে কিছু করাই সম্ভব নয়। কারো কারো হয়তো সাহায্য করার, আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দুর করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তারা চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করে। কেননা, আমাদের পক্ষে কিছু করলে তাদের রাজকীয় ক্ষমতা, শান্তি, আরাম-আয়েশ সবকিছু ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তারা এখন বর্বর নরপশুদের হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই না। কিন্তু হয়তো.....\" সুরাইয়াহর কন্ঠে যেন ক্ষীণ আশা ফুটে উঠল, \"হয়তো এখনো কিছু প্রকৃত মুসলিম আছেন, যারা আমাদের নিয়ে চিন্তা করেন, যারা আমাদের জন্য দুআ করেন আল্লাহর কাছে।\"সুরাইয়াহ আয়িশাহর দিকে তাকালেন। মেয়েটি কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। \"মাহমুদ বাবা, তুমিও ঘুমিয়ে পরো, রাতের আর খুব বেশি বাকি নেই।\"\"আমার ঘুম আসছে না, মা। তোমাদের জন্য চিন্তা হচ্ছে।\"মাহমুদের অনেক ভয় লাগছিল, যদিও সে তার মাকে সেটা বলল না। সে বড় হয়ে গেছে, এখন তার ভয় পাওয়ার বয়স নেই আর।\"চিন্তা কোরো না, বাবা। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন।\" সুরাইয়াহ যেন নিজেকেই সাহস যোগালেন। \"আচ্ছা, মা। বড় হয়ে আমি কি আমাদের উপর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব?\"\"না বাবা। আমি চাই কাউকেই যেন যুদ্ধ করা না লাগে, এ খারাপ দিনগুলোর যেন অবসান হয়। আমি চাই তুমি যেন ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারো, জীবনে ভালো কিছু করে তোমার মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে পারো। বলো, তুমি কি সেটা করতে পারবে না?\"\"হ্যাঁ, মা। আমি চেষ্টা করব।\" ঘুম জড়ানো কন্ঠে মাহমুদ বলল।ভোর হয়ে আসছে। বাইরে সূর্যের ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। আজকে ফজরের আযান শোনা গেলো না, হয়তো মসজিদের মুয়াজ্জিন বোমার আঘাতে শহিদ হয়েছেন। সুরাইয়াহ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মহান আল্লাহ তাকে আরও একদিন এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করার সুযোগ করে দিলেন। সুরাইয়াহর মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো আল্লাহ একদিন তাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন, এ নরক যন্ত্রণা, সাধারণ মানুষের আর্তনাদের অবসান ঘটবে। সে দিন দেখার জন্যই হয়তো আল্লাহ তাকে ও তার সন্তানদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুরাইয়াহ আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, \'হে আল্লাহ, আপনি আমার সন্তানদের এ বর্বর নরপশুদের থেকে রক্ষা করুন, তাদের আপনি আর দশটা শিশুর মত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার, স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিন।\'সুরাইয়াহ উঠে দাঁড়ালেন। তাকে আজকের দিনের জন্য খাবার খুঁজতে যেতে হবে। তিনি বাইরে বের হয়ে এলেন। তার চোখে মুখে বিষাদের ছায়ার পাশাপাশি যেন একটা ক্ষীণ আশার আলো খুঁজে পাওয়া গেলো।
0 Comments