রঙিন কাগজে চিঠি

রাত বারোটার ঠিক আগে আমি প্রতিদিনের মতো দরজা–জানালা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম। আমার শোয়ার রুমটা বাড়ির সবচেয়ে নিরিবিলি কোণে—ডানদিকে পুরনো আমগাছ, আর জানালার ওপারে অন্ধকারে ডুবে থাকা ফাঁকা উঠোন। বাইরে শুধু জোনাকিরা ঘুরে বেড়ায়, আর ভেতরে একটুও বাতাস ঢোকে না। এমন রুমে কেউ ঢুকবে, তা ভাবাই যায় না।কিন্তু গত বারো দিন ধরে প্রতিটি সকালে বালিশের নিচে একটা করে রঙিন কাগজে লেখা অচেনা চিঠি পাই। কখনো নীল, কখনো গোলাপি, কখনো হালকা সবুজ। প্রতিটা চিঠির লেখাই একই—“আমি তোমাকে দেখি।”প্রথম দু’দিন ভেবেছিলাম আমার আপনজনদের কেউ দুষ্টুমি করছে। কিন্তু বারো দিন ধরে একই সময়, একই ধাঁচে চিঠি আসছে—এটা আর দুষ্টুমি নয়।আমি নজরদারি শুরু করলাম।রাত এগারোটা পঞ্চান্ন বাজতেই রুমের লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। মাথার নিচে একটা ছোট ক্যামেরা রেখে দিই, যা রাতে ইনফ্রারেডে পুরো রুম রেকর্ড করে। দরজার নিচে খড়খড়ির ফাঁকও পরীক্ষা করে আঠা লাগিয়ে দিলাম—কেউ বাইরে থেকে স্লিপ করিয়েও দিতে পারবে না।সেই রাতে ঠিক ১২টা ০৩ মিনিটে, ঘুম না এলেও চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। বাড়ির কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। শুধু দেয়ালের ঘড়ির টিকটিক।হঠাৎ… রুমের একেবারে কোণায় ঠান্ডা বাতাসের মতো একটা ঝাপটা অনুভব করলাম।কিন্তু জানালা তো বন্ধ!চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম—কিছু নেই। শুধু অনুভূতি, যেন কারও ছায়া appena সরে গেল।সকাল হলেই প্রথমে ক্যামেরার ফুটেজ দেখি।সবকিছু স্বাভাবিক…১২টা ০২… ১২টা ০৩…আর তারপর ক্যামেরার স্ক্রিনে এক সেকেন্ডের মতো পুরো রুমটা কালো হয়ে গেল।শুধু এক সেকেন্ড।আগে–পরে কোনো ত্রুটি নেই।কালো স্ক্রিন শেষ হতেই দেখি—আমার বালিশে একটা হালকা বেগুনি রঙের চিঠি পড়ে আছে।আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।রুমের ভিতরে কিছুই দেখা যায়নি, কিন্তু চিঠি এসে গেছে!চিঠিটা খুললাম।ভেতরে এক লাইন—“আজ রাতটা একটু কথা বলবে?”সেদিন রাতে আমি ঠিক করলাম সত্যিটা জানবই। লাইট বন্ধ করলাম না।১২টা বাজতেই রুমজুড়ে অদ্ভুত একটা শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল।আমার নিঃশ্বাস জমে যাচ্ছে যেন।দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতেই, দেখা গেল—দরজার ওপরের ছায়া ধীরে ধীরে ঘন হতে শুরু করল।সে ছায়া মাটি স্পর্শ করল, আর তারপর মানুষের মতো আকৃতি নিয়ে নরম স্বরে ফিসফিস করল—“ভয় পেয়ো না… তোমার ক্ষতি করব না…”আমি শিউরে উঠলাম।কণ্ঠটা নারীর কণ্ঠ।বয়স যেন খুব কম—চব্বিশ–পঁচিশের মতো।আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না।সে ছায়া এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়াল।তারপর…আমার চোখের সামনেই তার হাত চুলের মতো ধোঁয়ার রেখা হয়ে বালিশের নিচে ঢুকে গেল।আর বেরিয়ে এলো আবার সেই রঙিন কাগজ।ছায়াটা কাগজ রেখে বলল—“আমি আটকে আছি। একটা ভুল মৃত্যুর পর ফিরে যেতে পারিনি… তুমি একাই আমাকে শুনতে পাও।”তারপর মুহূর্তেই সে মিলিয়ে গেল।সকালে চিঠিটা খুলে দেখি—“আমাকে মুক্ত করবে?”চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি বুঝলাম—ঘটনা আর খেলা নয়,এটা এক মৃত মানুষের অনুরোধ।আর আজ রাত ১২টার পরেসে আবার আসবে।আমার রুমের দরজা–জানালা যতই বন্ধ থাকুক,তার আসা ঠেকানো যাবে না।কারণ সে আসে বন্ধ পথ দিয়ে নয়—সে আসে শূন্যের ভেতর দিয়ে।