মেছো ভূতের কাণ্ড (শিশু-কিশোর উপযোগী ভূতের গল্প)...
*তাড়াইল বাজারে সপ্তাহে দু\'দিন হাট বসে। শনিবারে আর মঙ্গলবারে। আজ শনিবার। চারদিকের যত গ্রাম আছে মোটামুটি সবাই এই বাজারের ওপর নির্ভরশীল। অনেক দূরের গ্রাম থেকে লোকজন আসে এই তাড়াইল বাজারের হাটে। বিশেষ করে বর্ষাকালে আরো বেশি আসে। কারণ ভাটি এলাকা হওয়াতে বর্ষাকালে নৌকায় যোগাযোগ ভালো।সামনে ধান কাটার মৌসুম। তাই নিতাই কর্মকারের আজ ভালো বিক্রি হয়েছে। নিতাই কর্মকার গরীব মানুষ। কর্মকার হলেও তার স্থায়ী কোন লোহার-কাজের দোকান নেই। মহাজনের দোকান থেকে লোহা নিয়ে ব্যবসা চালান। একটা দোকান ঘরের বারান্দার এক কোণে হাপর বসিয়ে সারাদিন লোহা দিয়ে নানান রকম জিনিস বানান। যেমন- দা, বটি, কুড়াল, কোদাল, কাঁচি, ছেনী ইত্যাদি। এসব বানিয়ে বিক্রি করে যা রোজগার হয় তাতে তার সংসার মোটামুটি চলে। অনেকদিন পর আজ খুব ভালো বেচা-কেনা হয়েছে।বিকেলে এক ফাঁকে বাড়ির জন্য নিত্যপ্রয়োনীয় বাজার সদাই করে নিয়ে এলেন। আজ বাজারে ইলিশ মাছের বেশ আমদানি এবং দামও হাতের নাগালে। নিতাই কর্মকার লোভ সামলাতে পারলেন না। অবশ্য তিনি নিজের জন্য কিনেননি। তার ছেলে-মেয়েরা ইলিশ মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। আর তিনি তার ছেলে-মেয়েদের খুব ভালোবাসেন। কিন্তু সবসময়তো আর টাকা-পয়সায় কুলায় না। তাই মনের মতো করে ছেলে-মেয়েদের কিছুই দিতে কিংবা খাওয়াতে পারেন না। আজ যেহেতু বিক্রি মোটামুটি ভালই হল তাই সাহস করে একটা ইলিশ মাছ কিনে ফেললেন। মাছটা বেশ বড়সড়।যেমন বেচাকেনা হয়েছে বেশি তেমন ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে অনেক বেশি। মহাজনকে হিসেব বুঝিয়ে দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। রাত দশটার মতো বেজে গিয়েছ। গ্রামের জন্য অনেক রাত। তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু বাড়িটা একটু দূরে। গ্রামের নাম নগরকুল। তাড়াইল বাজারের ঠিক পূর্বদিকে গ্রামটি। দূরত্ব দুই মাইলের মতো হবে। তাড়াইল এবং নগরকুল গ্রামের মাঝে অন্য কোন গ্রাম নেই। একেবারে ফাঁকা। শুধু ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত।দোকান বন্ধ করে সোয়া দশটা নাগাদ বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা হলেন নিতাই কর্মকার। হাঁটতে হাঁটতে নিতাই কর্মকার ভাবছেন সরিষা বাটা দিয়ে ইলিশ দারুন জমবে। মনে করে আসার সময় কালো সরিষা কিনে নিয়েছেন। যদি বাড়িতে না থাকে তবে তো খাওয়া জমবে না। নিতাই কর্মকারকে বেশ খুশী খুশী লাগছে। মনের আনন্দে ভাটিয়ালী গানের সুর ধরেছেন আপন মনে। এখন রাস্তায় অন্য কোন লোকজন নেই। নিতাই কর্মকার একা। এমনিতে তিনি বেশ সাহসী। কিন্তু যখন দেখলেন যে, রাস্তায় তিনি একা তখন হঠাৎ মনের মধ্যে একটু অজানা ভয় জেগে ওঠল। তবে ভয়কে তিনি তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে তাতে আগুন ধরালেন। বিড়ি টানছেন আর আপন মনে গান গাইছেন। পেছনে কিছু একটা শব্দ হতেই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং তাকালেন। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। ভেবেছেন ইঁদুর হবে হয়ত। কিছু না ভেবে আবার হাঁটা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর আবার শব্দ হল। নিতাই কর্মকার এবার থমকে দাঁড়ালেন। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই। মনের ভেতর একটু ভয় জেগে ওঠল। চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকালেন কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। পূর্ণিমা রাত না হলেও বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত আবছা আবছা সব দেখা যায়। কিন্তু আশেপাশে কিছুই দেখতে পেলেন না। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। না, আর কোন শব্দ হচ্ছে না। আবার হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুদূর এগোতেই আবার সেই একই শব্দ। এবার সত্যি সত্যি কিছুটা ভয় পেলেন। গায়ের লোম সব কদম ফুলের মত খাড়া হয়ে জেগে ওঠল। কিন্তু এবারও কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই নাকালো কন্ঠ ভেসে এল- ইঁলিশ মাঁছটা আঁমাকে দিঁয়ে দেঁ।নিতাই কর্মকার ভয় পেয়েছেন সত্যিই কিন্তু মুষড়ে পড়েননি। আরো সতর্ক হলেন। আগে দেখলেন ঠিক পথে আছেন কিনা। পকেটের ম্যাচ বাক্সটা ঠিকমতো আছে কিনা তা\'ও দেখলেন। সবই ঠিক আছে। এবার মনে বেশ সাহস পেলেন। ম্যাচ বাক্সটা হাতে থাকলে অন্ততঃ কোন ভয় নেই। হঠাৎ মনে পড়লো সাথে সরিষাও আছে। মনটা আরো কিছুটা শক্ত হলো। নিতাই কর্মকার এবার হাঁটা শুরু করলেন। পেছনে সমান তালে হাঁটার শব্দ হচ্ছে। ভূতটা নিশ্চয়ই পেছন পেছন আসছে। আবার একটা বিড়ি ধরালেন। এবার সামনে থেকে শব্দ এলো- এঁই আঁবার বিঁড়ি ধঁরাইছিস! ফেঁলে দেঁ বঁলছি! আঁর পঁকেট থেঁকে ম্যঁচ বাঁক্সটাও ফেঁলে দেঁ। সঁরিষাগুলোও ফেঁলে দেঁ।নিতাই কর্মকার সাহস করেই বললেন- তুই হাতটা বাড়া। তোর হাতে দেই।ভূতের কন্ঠস্বর ভেসে এলো- এঁগুলো আঁমার দঁরকার নেঁই। যঁদি দিঁতে চাঁস তোঁ ইঁলিশ মাঁছটা আঁমাকে দিঁয়ে দেঁ।নিতাই কর্মকার এবার ঠাট্টা করে বলল- আজকের মাছটা বাড়িতে নিয়ে যাই। অন্যদিন তোকে দিয়ে যাবো।ভূতটা এবার রেগে বলল- পাঁজি কোঁথাকার। আঁমাকে ফাঁকি দিঁতে চাঁচ্ছিস। দাঁড়া তোঁকে এঁবার মঁজা দেঁখাচ্ছি।তুই আমার কচু করবি। বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো সরিষা দানা ছুঁড়ে মারবো।- নিতাই কর্মকার বলল।কথাগুলো বলার পর আর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে শুনসান নীরবতা। নিতাই কর্মকার বুঝলেন, সরিষার কথা বলতেই ভূতটা ভীষণ ভয় পেয়েছে।নিতাই কর্মকার ভূতকে ডেকে বললেন- কিরে মেছো ভূত, কোথায় গেলি?কিছুটা দূর হতে উত্তর এলো- এঁইতো এঁইখানে আঁছি। তুঁই মাঁছটা আঁমাকে দিঁয়ে দেঁ ভাঁই।নিতাই কর্মকার মনে মনে ফন্দি আঁটলেন। একা একা মুচকি হাসলেন। তারপর ভূতকে বললেন- আচ্ছা ঠিক আছে। মাছটা তুই নিয়ে যা।সঁত্যি বঁলছিস! মাঁছটা আঁমাকে দিঁয়ে দিঁবি!- ভূতটা যেন বেশ খুশী হয়েই বলল।হ্যাঁ সত্যি বলছি। কাছে এসে তুই হাতটা বাড়া। তোকে মাছ দিয়ে দিচ্ছি।কাছেই খসখস শব্দ শুনতে পেলেন নিতাই কর্মকার। হঠাৎ নাকে কেমন একটা পঁচা গন্ধ ভেসে এলো। মাছ পঁচে গেলে যেমন গন্ধ হয় ঠিক তেমনি। নিতাই কর্মকার বুঝতে পারলেন ভূতটা খুবই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় একটা বুদ্ধি আসতেই নিতাই কর্মকার বললেন- এই ভূত, তোকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। তুই আগে দেখা দে তারপর তোকে মাছটা দেবো।প্রায় দশ হাত দূরে একটা কুচকুচে কালো ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠল। এবার নিতাই কর্মকার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। ভূতের চোখগুলো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। সারা শরীর কুচকুচে কালো লোমে ঢাকা। মাথা ভর্তি উদ্ভট রকমের ঝাকড়া চুল। কান দুটো তালপাতার পাখার মতো। হাত ইয়া লম্বা। আঙুলের লম্বা নখগুলো দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন নিতাই কর্মকার। একটা খামছি দিলে খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিয়ে যাবে। হঠাৎ উল্টো পায়ের ওপর চোখ পড়ল। এবার সত্যি সত্যি ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন নিতাই কর্মকার। মুখ থেকে আর কোন কথা বের হচ্ছে না। পরক্ষণেই বেশ সতর্ক হলেন। কারণ ভূত যদি বুঝতে পারে যে ভয় পেয়েছে তাহলে আর উপায় নেই। অধৈর্য্য হয়ে ভূতটা বলল- এঁত হাঁ কঁরে কীঁ দেঁখছিস! আঁমার তোঁ আঁরো অঁনেক রূঁপ আঁছে। আঁমার মোঁট তেঁরোটা রূঁপ। আঁরো দেঁখতে চাঁস?ঠিক আছে দেখা।– লোভ সামলাতে পারলো না নিতাই কর্মকার। যদিও ভীষণ ভয় ভয় লাগছে।বলার সাথে সাথেই ভূতটার আকার তালগাছের মত লম্বা হয়ে গেল। বিরাট বিরাট হাত-পা। ইয়া বড় মাথা। নিতাই কর্মকার ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেলেন। দু\'পা রীতিমতো কাঁপছে। বাবা! কী অদ্ভুত দেখতে। সাথে ম্যাচ বাক্স আর সরিষা আছে বলেই রক্ষা। নইলে কখন ঘাড়টা মটকে দিত। আর কোন কথা বলছে না দেখে ভূতটা বলল- দেঁ এঁবার মাঁছটা আঁমাকে।ঠিক আছে হাত বাড়া।– অনেক কষ্টে সাহস করে নিতাই কর্মকার বলল কথাটা।বলতেই উপর হতে বিরাট লম্বা হাতটা বাড়িয়ে দিলো ভূতটা। একদম খুব কাছাকাছি চলে এল হাতটা। হাত তো নয় যেন তালপাতা। নখগুলো দেখতে ভীষণ রকম ভয়ংকর। খুবই বড়বড় এবং ধারালো। খুব কাছ থেকেই দেখলেন নিতাই কর্মকার। নিজের হাতটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকাতে চাচ্ছেন তিনি কিন্তু হাতটা এতটুকু নাড়াতে পারছেন না। কয়েকবার ঢোক গিললেন। গলাটা ভয়েতে প্রায় শুকিয়ে এসেছে। না, ভয় পেলে চলবে না। সাহস করে হাতটা পকেটে ঢোকাল।চোখ বড়বড় করে ভূতট ধমক দিয়ে ওঠল- এঁই! তুঁই মাঁছ দিঁবি তোঁ পঁকেটে হাঁত ঢোঁকাচ্ছিস কেঁন? মাঁছ তোঁ ব্যঁগের ভিঁতর। ব্যাঁগের ভিঁতর হাঁত দেঁ।ম্যাচ বাক্সটা পকেট থেকে বের করতেই ভূতটা অদৃশ্য হয়ে গেল। নিতাই কর্মকার চারদিকে তাকাল। না, ধারে-কাছে নেই। সে এবার জোরে পা চালালো। বেশি অর্ধেক পথ হেঁটে চলে এসেছেন। বাকি পথটুকু মঙ্গল মতে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু না, কিছুটা পথ এগোতেই আবার পেছন থেকে ভূতের কন্ঠস্বর ভেসে এলো- কিঁরে পাঁজি মাঁনুষ, তুঁই মাঁছটা দিঁলি নাঁ কেঁন!নিতাই কর্মকার ঠাট্টাটা করার লোভ সামলাতে পারলো না, বলল- কেন ভদ্রভূত, তুমি জানো না? মাছটা তো তোমার জন্য কিনিনি!নাঁ কিঁনিস, তুঁই বঁলেছিস দিঁবি। তাঁহলে দিঁলি নাঁ কেঁন? শুঁধু শুঁধু মিঁথ্যে কঁথা বঁলেছিস। দাঁড়া, আঁরেকদিন তোঁকে মঁজা দেঁখাবো! সুঁযোগ পেঁলে তোঁর ঘাঁড়টা এঁকেবারে মঁটকে দেঁব।– এই বলে ভূতটা অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকি পথটুকু নিতাই কর্মকার বেশ নির্বিঘ্নেই চলে এলো। *কী সুন্দর ঝিরঝির বাতাস বইছে। অথচ নিতাই কর্মকার রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে একাকার। স্ত্রী প্রমিলা রাণী দেখে ভীষণ অবাক হয়েই বললেন- কী ব্যাপার! এত ঘেমেছ কেন?নিতাই কর্মকার মনে মনে ভাবলেন ভূতের কথাটা এত রাতে বললে ভীষণ ভয় পাবে। তাই পাশ কাটিয়ে বললেন- একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে এসেছি তো তাই বেশি ঘেমে গিয়েছি।বুদ্ধিমতী স্ত্রী প্রশ্ন করলেন- তাড়াতাড়ি হেঁটে এসেছো, তবে এত রাত হলো কেন?দোকান গোছাতে গোছাতে অনেক দেরী হয়েছিল। শোন, একটা ইলিশ মাছ এনেছি। কথা না বলে, সর্ষে বাটা দিয়ে মাছটা রান্না করো গিয়ে।এত রাতে আবার মাছ রান্না করবো!- প্রমীলা রাণী ভীষণ অবাক হয়েই বললেন।নিতাই কর্মকার খুব নরম সুরেই বললেন- প্লিজ, একটু কষ্ট করে রান্না কর। সবাই মিলে বেশ মজা করে খাবো। তাছাড়া আগামীকাল মাছটা তেমন স্বাদ লাগবে না।বাচ্চা-কাচ্চারা সবতো সেই কখন ঘুমিয়েছে। আগামীকালই রান্না করি সবাই একসঙ্গে খাবো।আহা! এখনই রান্না কর। আমি ওদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবো।স্বামী সারাদিন এত পরিশ্রম করে এসেছে। তাছাড়া শখ করে ইলিশ মাছটা কিনে এনেছে। আর সবচেয়ে বড়কথা নিজেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আর না করলেন না।আচ্ছা তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি মাছ রান্না করছি।– এই বলে প্রমিলা রাণী রান্না ঘরে চলে এলেন ইলিশ মাছটা নিয়ে।নিতাই কর্মকার স্নান করতে গেলেন কলপাড়। আর প্রমীলা রাণী মাছটা কেটে-কুটে চুলায় আগুন ধরালেন। কড়াইয়ের তেল গরম হতেই মাছের টুকরোগুলো তেলে ছাড়লেন। ছ্যাত ছ্যাত শব্দ শুনতে পেলেন নিতাই কর্মকার। দশ-পনের হাত দূর হতেও ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। স্নান শেষে ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। দুই ছেলে আর তিন মেয়ে। সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠে বিছানায় বসে বসে ঢুলছে। আবার শুয়ে পড়ছে তো নিতাই কর্মকার আদর করে ডেকে ডেকে লোভ দেখাচ্ছে- ঐ তো মাছ ভাজা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। ইলিশ মাছ খাবে না!সবাই ঘুম ঘুম চোখেই বসে আছে। নিতাই কর্মকার শার্টটা টেনে নিয়ে গায় দিলেন। ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে প্রমীলা রাণীর চিৎকার শোনা গেল- বাবাগো-মাগো, ভূত! ভূত!এক দৌড়ে নিতাই কর্মকার রান্নাঘরে চলে এলেন। তার বুঝতে বাকি রইল না। ঐ শয়তান ভূতটা এখনও পিছু ছাড়েনি। বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। মায়ের চিৎকার শুনে ছেলে-মেয়েগুলোও ভয়েতে চিৎকার করে ওঠল। নিতাই কর্মকার রান্না ঘরে এসে দেখেন প্রমীলা রাণী মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। ভীষণ ভয় পেয়েছেন প্রমীলা রাণী। নিতাই কর্মকার ঘাবড়ালেন না। পাঁজাকোলে করে স্ত্রীকে বড় ঘরে নিয়ে এলেন। তারপর চৌকিতে শুইয়ে দিলেন। চিৎকার শুনে আশেপাশের বাড়ির লোকজন ছুটে এলেন। সবাই সেবাযত্ন শুরু করে দিলেন। কেউ হাত পাখা নিয়ে বাতাস করছেন। কেউবা গামছাটা ভিজিয়ে হাত-মুখ মুছে দিচ্ছেন। আবার কেউবা রসুন-তেল গরম করে হাত ও পায়ের তলায় মালিশ করে দিচ্ছেন। প্রায় পনের মিনিট পর এক পলক তাকিয়েই আবার চোখ বন্ধ করলেন প্রমীলা রাণী। সেবা-যত্ন চলছেই। প্রায় আধ ঘন্টা পর ঠিক কিছুটা স্বাভাবিক হলেন। তারপর সবিস্তারে ঘটনাটা বললেন: মাছ ভাজা করা প্রায় শেষ তখন হঠাৎ ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটা বড় কুচকুচে কালো হাত ঢুকে গেল। আর নাকালো কন্ঠে বলল- মাঁছ ভাঁজাগুলো আঁমাকে দেঁ।প্রমীলা রাণী এক চিৎকার দিয়েই অজ্ঞান। তারপর আর কিছুই বলতে পারলেন না। নিতাই কর্মকার তার আসার পথের ঘটনা বিস্তারিত সবার কাছে বললেন। সব কথা শুনে পাশের বাড়ির কালিদাসের মা বললেন- ভূতটাকে একটা শাস্তি দেওয়া দরকার। তোমরা সবাই বড় ঘরে বসে থাকো। আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি।সবাই নিষেধ করা সত্ত্বেও কালিদাসের মা রান্না ঘরে একা গেলেন। চুলার আগুনটা ঠিক করে তেলের কড়াইটা গরম করলেন। ভাজা মাছগুলো আবার ভাজছেন। মাছ ভাজার ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ হচ্ছে। এক ফাঁকে লোহার ছেনাটা চুলার ভেতর আগুনে ঢুকিয়ে দিলেন। ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দে মাছ ভাজা হচ্ছে। সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। বড় ঘরের বেড়ার ফাঁকে সবার চোখ রান্না ঘরে। কারো কারো ভয়ে গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠছে। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে রাখছে। অনেকটা সময় চলে গেল কিন্তু ভূতটা আসছে না। সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।চুলার ভেতরে যে ছেনাটা পোড়ানো হচ্ছে সেটা পুড়ে লাল হয়ে আছে। এবার ভূত আসলেই তবে মজার খেলা হবে। কালীদাসের মা মাছ ভাজছে আর নামাচ্ছে। আসলে ভাজা মাছগুলোই আবার ভাজছে। শেষ ভাজা মাছটা কড়াই থেকে নামাতেই রান্না ঘরের বাইরে পাতার খসখস শব্দ শুনতে পেলেন কালিদাসের মা। কড়াইয়ে এখন আর মাছ নেই। তবু এমনি এমনি ছেনা নাড়াচ্ছেন। ইলিশ মাছের গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। কিন্তু এই সুগন্ধ ছাপিয়ে হঠাৎ পঁচা গন্ধ নাকে এসে লাগল। কালীদাসের মা বুঝতে পারলেন এটা মেছো ভূত। এর জন্যই মাছ খেতে পাগল হয়ে গেছে। কালিদাসের মা একেবারে তৈরি হয়ে আছেন মনে মনে। এখন শুধু অপেক্ষা। ভূতটা হাত বাড়ালেই কাজ হবে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সবাই রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই অজানা রোমাঞ্চে বেশ পুলকিত। আবার পাশাপাশি ভয়ও লাগছে।হঠাৎ মড়মড় করে শব্দ হতেই কালিদাসের মা তাকিয়ে দেখেন, একটা বড় হাত ঠিক তালপাতার পাখার মতো তার চোখের সামনে। কুচকুচে কালো বিরাট বড় বড় নখ। লোমে ঢেকে আছে পুরো হাত।আঁমাকে মাঁছ ভাঁজাগুলো দিঁয়ে দেঁ।– ভূতের কন্ঠ সবাই স্পষ্ট শুনতে পেল। কেমন যেন নাকালো সুর। নাক দু\'আঙুলে চেপে কথা বললে যেমন হয় ঠিক তেমনি।জবাবে কালিদাসের মা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অদ্ভুত সুরে বলল- তোকে মাছ ভাজা দিচ্ছি। ( এই এখনই দিচ্ছি। সত্যি বলতে কী উনিও কিছুটা ভয় পেয়েছেন। ভয়েতে নিজের কন্ঠস্বরটা কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। তাছাড়া বয়সও হয়েছে অনেক। সব মিলিয়ে কালিদাসের মায়ের কন্ঠস্বরটা একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করল।এই অচেনা কন্ঠস্বরটা শোনার পর সবার গা অজানা আতংকে ছমছমিয়ে ওঠল)। এই বলে চুলার ভেতর থেকে আগুনে পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া ছেনাটা হাতে নেন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সবাই দেখছে কালিদাসের মায়ের সাহস। যদিও কালিদাসের মায়ের হাতটা থরথর করে কাঁপছিল। কিন্তু তিনি দমবার পাত্রী নন।কালিদাসের মা গরম ছেনাটা হাতে নিয়েই ভূতের বাড়িয়ে দেয়া হাতে চেপে ধরলো। ভূতটা মাগো-বাবাগো বলে চিৎকার করে পালিয়ে গেল। মুহূর্তেই গাছের ডাল ভাঙার বিকট শব্দ হলো। হারিকেন হাতে সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। বড় আম গাছের বড় একটা ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। সবাই ভয়ার্ত চোখে ভাঙা ডালের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আর কোনদিন এই বাড়িতে মাছের জন্য কোন ভূত আসেনি। ***
মেছো ভূতের কাণ্ড (শিশু-কিশোর উপযোগী ভূতের গল্প)...
0 Comments