ভূত সমাচার (শিশু ও কিশোর উপযোগী ভৌতিক গল্প)...
স্কুল ছুটি। বারান্দায় এসে চিনুদা বইখাতা হাতে নিয়ে দাঁড়াল। তারপর একে একে সবাই এসে পাশাপাশি দাঁড়াতেই চিনুদা বলল- বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সবাই চলে আসবি জায়গামতো।কিন্তু আমার যে!- আদুর কথা থামিয়ে দিয়ে চোখ ছানাবড়া করে বলল- কোন কিন্তু নয়, সবাইকে আসতে হবে ব্যস্। এখন লক্ষ্ণীছেলের মতো যার যার বাড়ি চলে যা। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে তিড়িং বিড়িং করে সোজা ঐ জায়গায় চলে আসবি। আর কোন কথা না বাড়িয়ে চিনুদা বাড়ির উদ্দ্যেশে পা বাড়াল।বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই একে একে সবাই হাজির। শুধু সুনীল পাল ওরফে সুইন্যা এখনও পৌঁছায়নি। তার জন্যে অবশ্য ওরা বসে নেই। সবাই খোশগল্পে মোটামুটি ব্যস্ত।ওদের আড্ডাস্থানটা হল গতবছরের কালবৈশাখি ঝড়ে হেলে পড়া কড়ই গাছটা। স্কুল পুকুরের পূব পাড়ে। স্কুল ঘরেরও পূব পাড়। কেউ গাছের আধ-গোড়ায়, কেউ এ\'ডালে আবার কেউবা অন্য ডালে তবে সবাই কাছাকাছি হয়ে মুখোমুখি বসেছে।দূর থেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ওদের এই জমজমাট আড্ডা দেখে অনেকেই হিংসে করে। প্রীতম নিজেও একসময় খুব হিংসা করতো। তারপর আস্তে আস্তে এসে ওদের দলে মিশেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে চিনুদা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।আগে এই গ্রুপে ছিল চারজন। বর্তমানে প্রীতমসহ পাঁচজন। চিনুদা দারুণ গল্পবাজ ছেলে। ওর গল্প শুনতে সবাই খুব পছন্দ করে। যদিও সব আজগুবি মার্কা গল্প বলে। কিন্তু অসাধারণ!প্রীতম নীরবতা ভেঙে বলল- কী ব্যাপার! সবাই যে দিনের প্যাঁচার মতো বসে আছিস?কী বললি?- চিনুদা কিছু রাগতঃ কন্ঠেই মুখ ভেংচি কেটে বলল- বসে থাকবো না! তবে কি বানরের মতো লাফালাফি করবো?সবাই প্রীতমের দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। উত্তরে সে কী বলে তা শোনার জন্য। কিন্তু প্রীতম উত্তরে কিছুই না বলে চুপচাপ বসে রইলো।কথার মোড় পাল্টে অমল বলল- আচ্ছা চিনুদা, পণ্ডিত স্যার যে ভূত-প্রেতের কথা বলল ওগুলো কি তোর বিশ্বাস হয়?চিনুদা অমলের দিকে তাকায়নি এবং উত্তরেও কিছু বলেনি। যেভাবে বসেছিল ঠিক সেভাবেই বসে আছে। কোনরকম ভাবান্তর নেই।অবশেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রীতম বলল- না বিশ্বাস করার কী আছে? কিন্তু!- এই বলে অমল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চিনুদার দিকে তাকিয়ে বলল- আমিতো কোনদিন কোথাও কোন ভূত-টূত দেখিনি!আরে অনেকের কাছে ভূতের সত্য ঘটনা শুনেছি। তাহলে ওগুলো কি মিথ্যা?- বিশ্বাস করানোর জন্য প্রীতম আবারও বলল- আমার আপন বড় মামাও পর্যন্ত ভূত দেখেছে।আরে ধ্যেৎ! ওসব ভূতে-টূতে আমার কোন বিশ্বাস নেই।– বেশ তাচ্ছ্যিলের সুরেই আদু বলল- যদি কোনদিন দেখাতে পারিস তবে দেখাস দেখি।আয়, আজ তোর পায়ের নলা না ভেঙ্গে ছাড়ছি না।– এই বলে চিনুদা এবার আড়মোড়া ভেঙে বসল। আর দৃষ্টি জোড়া স্কুল গেইটের এদিকে। চিনুদার মেজাজ দেখে সবাই গল্পগুজব বন্ধ করে দিল। সবার দৃষ্টি এখন সুইন্যার আসার পথে। সে হনহন করে এগিয়ে আসছে। তবে দৃষ্টিটা এদিকে সবার দিকে। হাতে কাগজের একটা পুটলা। গায়ে নতুন শার্ট। বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হাঁটার ভঙ্গীটাই যেন অনেক পাল্টে গেছে।সুইন্যা এসে পৌঁছাতেই চিনুদা রাগে তেলে-বেগুনে জ্বলে লাল হয়ে বলল- তুই জানিস না! দেরী করলে আমি কতরকম শাস্তি দেই। তারপরও তুই এত দেরী করে আসলি?রাগ করিস না ভাই!- অনুনয়ের সুরে সুইন্যা বলল- আগে আমার কথাটা শোন!না! কোন কথাই আজ আমি শুনতে রাজি নই।– গ্রাম্য মাতব্বরের মত মুখ ভেংচি কেটে চিনুদা আবারও বলল- রোজ রোজ আর কত বলব যে, সময়কে জীবনের চেয়ে বেশি মূল্য দিবি। তবে জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। কী হয়েছিলরে সুইন্যা?- পরিস্থিতিট স্বাভাবিক করার প্রয়াসে প্রীতম বলল- স্কুল ছুটির পর বলে গেলেই পারতি।বাড়িতে গিয়ে দেখি।– সুইন্যাকে থামিয়ে দিয়ে চিনুদা বলল- থাক! আর মামার বাড়ির গল্প করতে হবে না।আহা চিনুদা, শোন্ না আগে কী হয়েছিল!- পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক করার জন্য প্রীতম বলল।আর কোন কথা না বলে চিনুদা চুপচাপ বসে রইল। দৃষ্টি আকাশের দিকে। মনটা হয়তো এখানেই পড়ে আছে। অনেক দিন পর মামা এসেছে।– সুইন্যা বলতে শুরু করল।মামার কোলে বসেছিলি এতক্ষণ!- চিনুদা বেশ রেগে গিয়েই বলল- চলে এলি কেন! আমরা তোর জন্য ফিডারে করে দুধ পাঠাতাম।তুই ভাবছিস, আমি মিথ্যে বলছি?- হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বিজয়ের সুরে সুইন্যা বলল- এই দেখ, মামার আনা আঙুর তোদের জন্যে এনেছি।আঙুরের কথা শুনে নীরবতা ভেঙে চিনুদা কাছে ডাকল সুইন্যাকে। সুইন্যা গাছে উঠে চিনুদার পাশে গিয়ে বসল। আঙুরের সুবাদে সুইন্যা চিনুদার কাছে বসার চান্সটা পেয়ে গেল। চিনুদার কাছাকাছি বসে গল্প শোনার মজাই আলাদা। যাই হোক, ফুরফুরে বাতাস থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন একটু গরম গরম লাগছিল এতক্ষণ। এখন একটু হালকা বোধ হচ্ছে। এখন সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো।আঙুরের পুটুলিটা চিনুদার হাতে পৌঁছে গেল। একটা একটা করে আঙুর মুখে চালান দিচ্ছে আর হাসি মুখে সুইন্যাকে দেখছে। তারপর সবার উদ্দ্যেশে বলল- তোরা যেন কী বলাবলি করছিলি এতক্ষণ?- কারো দিকে না তাকিয়ে বেশ বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞ্যেস করল চিনুদা।ভূতের কথা হচ্ছিল।– গল্প শোনার জন্য প্রীতম তড়িঘড়ি করে বলল- আদু আর অমল ভূতে একদম বিশ্বাস করে না।বিশ্বাস অবিশ্বাস আবার কী!- চিনুদা আঙুর চিবাতে চিবাতে আবারও বলল- যে দেখবে সে বিশ্বাস করবে। আর যে দেখবে না, সে বিশ্বাস করবে না ব্যস্।তাহলে আমি যে- প্রীতমের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে চিনুদা বলল- থাকুক আর বলতে হবে না। একটা সত্য ঘটনা বলি শোন।এবার সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। সবার দৃষ্টি চিনুদার দিকে। অজানা শিহরণে সবাই বেশ পুলকিত হলেও কিছুটা যেন শংকিত। সন্ধ্যার এখনও অনেক বাকি। তবুও কেন যেন একটা হিমহিম ভাব সবার মধ্যে ঝেঁকে বসল।মিথ্যা কথা কিন্তু একটাও বলতে পারবি না।– অভিমান ভরা কন্ঠে আদু গাল ফুলিয়ে বলল- তোর তো শুধু বাড়িয়ে বাড়িয়ে গল্প বলা।ঠিক আছে। কোন গল্পই বলার দরকার নেই।– মুখে একটা আঙুর ছুঁড়ে ফেলে পা দুলিয়ে চিনুদা বলল- এমন ভাব দেখাচ্ছিস যে, গল্প না বললে আমার পেটের ভাত হজম হবে না!আহা! রাগ করছিস কেন? ঘটনাটা বল, আমরা শুনবো।– সুইন্যা বেশ অনুরোধ করে বলল।কথার মধ্যে বাগড়া দিলে মেজাজটাই গরম হয়ে যায়।– চিনুদা পা দুটো দোলাতে দোলাতে বলল।আচ্ছা, ঠিক আছে।– মুচকি হেসে আদু বলল- স্যরি, কথার মাঝখানে আর কোন কথা বলবো না।চিনুদা এখন বলতে পারিস।– তাড়া দিয়ে প্রীতম বলল- আমরা কেউ কোন কথা বলবো না।বেলা বেশি নেই চিনুদা।– আকাশের দিকে তাকিয়ে অমল বলল- তাড়াতাড়ি গল্পটা শুরু করে দে।ভয় পাচ্ছিস মনে হচ্ছে। তাহলে এখনই সোজা বাড়ি চলে যা। তোর গল্প শোনার দরকার নেই।– চিনুদা বেশ নিরাসক্ত কন্ঠেই বলল।আরে না, ভয় পাচ্ছি না। মানে...- আমতা আমতা করে অমল বলল- সন্ধ্যার পর দেরি করে বাড়ি ফিরলে মা বকুনি দিবে।তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তারপর একে একে সবার হাতে আঙুরের ভাগ পৌঁছে গেল। খালি কাগজটা তালগোল পাকিয়ে পুকুরের জলে ফেলে হাত ঘষে ঘষে চিনুদা বলল- সন্ধ্যার পরে পড়তে বসতে হবে। যতকিছুই করি না কেন, আমাদের লেখাপড়া সবসময় ঠিক রাখতে হবে।কথাটা শুনে প্রীতম মুচকি মুচকি হাসল। তবে চিনুদা একদম টের পায়নি।চিনুদার আসল নাম চিন্ময় সরকার। সবাই চিনু নামেই ডাকে। আগে প্রীতমদের থেকে দুই ক্লাশ উপরে পড়তো। পরপর দু\'বার ফেল করে এখন এদের সাথে। প্রথম প্রথম সবাই চিনু\'দা বলেই ডাকতো। কিছুদিন যাওয়ার পর চিনুদা নিজেই সবাইকে বলল নাম ধরে ডাকার জন্য। আর আপনি নয় তুই ডাকলেই ভালো। কিন্তু তবু সবাই দাদা ডাকে। তবে বন্ধু হওয়ার পর সবাই ঠিক করলো যে, চিনুদা ডাকবে এবং তুই তোকারিও চলবে। সেই থেকে চিন্ময় সরকার ওরফে চিনুর নামই এখন চিনুদা হয়ে গেছে। চিনুদা নিজেই লেখাপড়ায় লাড্ডু আবার সবাইকে লেখাপড়ার কথা বলে। তাই প্রীতমের হাসি পাচ্ছিল। তবে এটা ঠিক যে, প্রীতমদের সাথে মেলামেশার পর থেকেই চিনুদা লেখাপড়ায় অনেকটা মনোযোগী হয়েছে।বুঝলি, ঘটনাটা বেশ মজার।– এই বলে আঙুর খেতে খেতে জিহ্বায় একটা চাট্টি মেরেই চিনুদা বলল- ঘটনাটা বেশিদিন আগের নয়। মাস তিনেক হবে বড় জোর। আমার নেতা মামাকে চিনিস তো? কেউ কোন জবাব দেয়নি বলে চিনুদা বলল- ঠিক আছে, চেনার দরকার নেই।একদিন বিকেল বেলা বসে মামা পার্টির আলাপ করছিল কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে। হঠাৎ করে ভূতের আলোচনা শুরু হল। সবাই স্বীকার করল যে, ভূত না দেখলেও সে সম্পর্কে বেশ ভয় আছে। এর মধ্যে একজন ভূতই বিশ্বাস করে না।ঠিক আছে। তুই যখন ভূতে বিশ্বাস করিস না। রাতের অন্ধকারে শ্মশানের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসবি। তবেই বুঝবি ভূত কাকে বলে।– ওই বন্ধুকে মামা বলল।এটা কোন ব্যাপার হলো নাকি!- তাচ্ছ্যিলের স্বরে বন্ধুটি বলল- আজ রাতেই শ্মশানে যাব। পরিবর্তে বাজী রইল দুইশ\' টাকা।ঠিক আছে। সবাই সাক্ষী থাকলো।– হাত নেড়ে মামা বলল- তবে একটা শর্ত, ভয় পেলেই আমার জিত। কি ঠিক আছে?সবাই তখন সম্মতিসহ সাক্ষী রইল। *শ্মশানের ভেতর একটা বাঁশের টুকরা ফেলে রাখা হয়েছে। সেটি তুলে নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে বুঝা যাবে যে, সে শ্মশানের মধ্যে সত্যিই গিয়েছিল। কথা হলো, রাত বারোটার পরে শ্মশানে যেতে হবে।কথামতো রাত বারোটা বাজতেই সবাই বিদায় দিল। বন্ধুটি শ্মশানের উদ্দ্যেশে রওনা হল। চারদিক নীরব-নিঃস্তব্ধ, এর মাঝে শুধু একজন লোক দৃঢ় পদে সতর্ক দৃষ্টিতে হাঁটছে। শ্মশানটা লোকালয়ের বাইরে এবং চারদিক ঘন ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা। ফলে এখানে অন্ধকারের আঁচটা একটু বেশি। একটা পেঁচা অদ্ভুত কন্ঠে ডেকে ওঠতেই গায়ের সব লোম কদম ফুলের মতো খাড়া হয়ে ওঠল। কয়েকটা কাকও পরপর ডেকে ওঠলো। সামনে দিয়ে হঠাৎ করে কী যেন একটা দৌঁড়ে গেল। থমকে দাঁড়ালো এবং বুঝতে চেষ্টা করলো ব্যাপারটা। না, আর কোন শব্দ নেই। ঝোঁপঝাড়ের রাস্তা পেরিয়ে এবার শ্মশানের রাস্তা শুরু। শ্মশানের পথে পা বাড়াতেই শিয়ালের হুক্কা-হুয়া ডাকে সারা গা ছমছমিয়ে কেঁপে ওঠলো। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে শ্মশানে পৌঁছেছে। রাস্তার দু\'পাশে আরো ছোটখাটো ঝোঁপঝাড় এবং গাছপালা। পথে হুমড়ি খেয়ে পড়া গাছের ডালে হাত লাগতেই থমকে দাঁড়াল। মনের অজান্তেই শরীরের রক্ত সঞ্চালন যেন বেড়ে গেল। সামনে কী যেন একটা দাঁড়িয়ে আছে। ঝোঁপঝাড়ের আবছা অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। তবে মানুষের মতই মনে হচ্ছে। দেখতে বেশ বড়সড়। রাস্তার পশ্চিম প্রান্তে থমকে দাঁড়াল। পলকিবিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। কিন্তু একই রকম দেখাচ্ছে, কোনরকম পরিবর্তন হচ্ছে না। মনে খটকা লাগছে। শেষ পর্যন্ত তাহলে পথেই ভূতের সাক্ষৎ! মনকে শক্ত করার চেষ্টা চলছে অবিরত। কিন্তু তবুও এক অজানা ভয়ের শিহরণে বুকটা ধুকপুক করছে। নিজেই বুকে থু থু দিল। মনে মনে ভাবছে পেছন ফিরে দৌঁড় দিবে কিনা। কিন্তু ভূতের অনেক গল্প শুনেছে- পেছন ফিরে তাকাতে নেই। তবেই ভূত আস্কারা পেয়ে যায় এবং ঘাড় মটকে দেয়। সাহস করে সামনেই যেতে হবে মন স্থির করল।হালকা বাতাসে কলাপাতাটা নড়ে ওঠতেই স্পষ্ট বুঝতে পারল। এই পথে তেমন একটা আসা-যাওয়া নেই। তাই কলাগাছের কথা মনেই ছিল না। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার সামনে এগিয়ে চলল।আচ্ছা গাছ কি পথে একটাই ছিল?- জিজ্ঞাসু কন্ঠে আদু বলল।এই যে কথার মধ্যে বাগড়া। আমি গল্প বলা বন্ধ করলাম।– এই বলেই চিনুদা চোখ জোড়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল।তোর এই অভ্যাসটা গেল না!- শাসনের সুরে সুইন্যা বলল- শুধু শুধু বকবক করিস।ঠিক আছে, আর কোন কথা বলব না।– আদু দুঃখ প্রকাশ করে বলল।ওখানে কী আমি ছিলাম নাকি?- বেশ রাগ করেই চিনুদা বলল- তোর ভালো না লাগলে উঠে চলে যেতে পারিস। কেউ তোকে আটকাবে নাআহা! এত রাগ করিস কেন?- বিনীত কন্ঠে আদু বলল- আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম। সরি, আর কোন কথা বলবো না।ঠিক আছে, আর কোন কথা বলবি না।– পরিবেশটা শান্ত করার জন্য প্রীতম বলল- এবার শুরু করা যাক। কী বলিস চিনুদা?দেখ প্রীতম, এত উকালতি করিস না।– তারপর হাত বাগিয়ে বলল- তবে এমন এক গাট্টা দেবো যে, এই জনমের সব কথা ভুলে যাবি।আচ্ছা, ঠিক আছে। আর কোন কথা বলবো না।– এই বলে প্রীতম আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলল- এবার তাহলে শুরু করা যাক।কথা শেষ করতে না দিয়েই চিনুদা বলল- টু-শব্দটি পর্যন্ত যেন না হয়। কী, ঠিক আছে?সবাই সম্মত হলো; গল্পের মাঝখানে আর কোন কথা বলবে না। তারপর সবাই একটু নড়েচড়ে চিনুদার কাছাকাছি হয়ে বসলো। প্রীতম হাত ফসকে পানিতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বসল প্রীতম। চিনুদা এবার গলা খাকাড়ি দিয়ে গল্প শুরু করল: তারপর মামার বন্ধুটি সব ভয় কাটিয়ে শ্মশানের কাছে চলে এলেন। কিন্তু এখন পড়েছেন মহাভাবনায়। শ্মশানের ভেতর ঢুকবেন কী ঢুকবেন না।কাছের ঝোঁপেই ভেণ্ডী গাছটা এপাশ-ওপাশ দুলতে লাগল। অথচ কোনরকম বাতাস বইছে না। ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কান দিয়ে শাঁ শাঁ করে গরম বাতাস যেন বের হচ্ছে ক্রমাগত। গাছটার দিকে আবার তাকালেন। গাছটা যে দুলছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটলেন- অনুভূতি তো ঠিকই আছে, তাহলে! তিনি সাহস করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন গাছটার দিকে। একসময় গাছটা একেবারে শান্ত হয়ে গেল। তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেই শ্মশানের ভেতর পা বাড়ালেন। কিছুদূর এগোতেই ঝুনঝুন করে কী যেন বেজে ওঠল।আচমকা সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। প্রতিটি লোম যেন শরীর ছেড়ে উড়ে চলে যেতে চাচ্ছে। একই শব্দ আবার বেজে ওঠল। এখন পায়ে চলার শক্তিও যেন ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে।আঙ্কেল হাতে লাগানো লোহার তাবিজটা ভাল করে দেখে নিলেন। তাবিজ ঠিকঠাক মতোই আছে। যতই ভয় দেখাক, গায়ে হাত লাগাতে পারবে না। মনের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে সামনের দিকে পা বাড়ালেন। কী একটা অদ্ভুত স্বর ঠিক সামনের ঝোঁপটা থেকে আসছে। কিন্তু ধারে-কাছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবলেন; সামনে এসে যেহেতু কিছুই করছে না সুতরাং নিরাপদ। চিনুদার গল্পের ভয়ে সবাই যেন জড়সড় হয়ে যাচ্ছে।আঙ্কেলটা খুবই সাহসী!- গুয়ামুড়ি হেসে সুইন্যা বলল- আমি যদি এমন সাহসী...।– মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে চিনুদা বলল- থাক, থাক অনেক হয়েছে! আর এগোতে হবে না। সাহস থাকে তো, এখান থেকে এখন একা একা বাড়িতে যা!সুইন্যা একেবারে চুপচাপ। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কেমন যেন একটু ভয় ভয় ভাব সবার মনের ভেতর ভর করেছে। প্রীতম নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- চিনুদা, তারপর?দু\'হাতের আঙুলে মাথায় বিনুনি কেটে চিনুদা শুরু করলো- তারপর হাঁটতে হাঁটতে আঙ্কেল নির্ধারিত বাঁশের টুকরাটির কাছে পৌঁছাল। অতি সন্তর্পণে যখন বাঁশের টুকরাটি তুলতে যাবে ঠিক তখনই ধপাস করে একটি ঢিল এসে ঠিক সামনে আছড়ে পড়ল। হেচকা টানে নিজেকে টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন- ধারে কাছে কোন কিছু আছে কিনা। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। ভূত যদি থেকেই থাকে তবে নিশ্চয়ই মানুষকে কিছুটা ভয় পায়। নইলে দূর থেকে এমন করবে কেন? এই ভেবে কিছুটা সাহস যোগাতে চেষ্টা করলেন মনে মনে। নিজের গায়ে হাত রাখলেন। গা ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গিয়েছে। কখন এমন অবস্থা হলো একদমই টের পাননি। যতই সাহস দেখান না কেন! মধ্যরাতে এই নির্জন শ্মশান এলাকায় একা একা আসা সত্যিই কল্পনাতীত।শত হলেও মানুষ। অতি নির্জনতায় কিছু না কিছু ভয় থাকবেই।সাহস ওপর ভর করে বাঁশের টুকরাটা হাতে তুলে নিলেন। বাঁশের টুকরাটা হাতে নিয়ে ফিরতেই মাথায় যেন বিদ্যুৎ চমকে ওঠল। আবছায়া হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে- কতগুলি কাঠি যেন হেলে-দুলে নাচছে। নিশ্চয়ই কংকাল! মাথার ভেতর সবকিছু কেমন যেন বিকল হয়ে আসছে। বুদ্ধি এতটুকুও কাজ করছে না। ইতিমধ্যে দুই পা যেন একেকটা টনী-পাথর হয়ে গেছে। নড়াচড়ার এতটুকু শক্তি শরীরের কোন অঙ্গেই বোধ হচ্ছে না।কংকালটি ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ভঙ্গীতে নাচছে। মাঝে মাঝে আবার ঘটাঘট, ঘটাঘট শব্দ হচ্ছে। পুরো গা ক্রমশঃ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটলেন। অনুভূতি শক্তি একেবারে ক্ষীণ। কোন অনুভূতি নেই বললেই চলে। মনের ভয় কাটিয়ে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছেন। একসময় মনের অজান্তেই হাতের বাঁশ দিয়ে বসালেন কয়েক ঘা। কংকাল পাশের ঝোঁপে গিয়ে ছিটকে পড়ল। তারপর কতক্ষণ সময় থমকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি নিজেই জানেন না। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই তিনি দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলেন। হাটছেন ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন টেনে ধরলো। মুখে কোন ভাষাই ব্যক্ত করতে পারলেন না। এমনটি মুখ থেকে একটি চিৎকার পর্যন্ত বের হলো না। তিনি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন।তার মানে, ভূতে টেনে ধরেছে? তুই শুধু শুধু বাড়িয়ে বলছিস!- ভীত কন্ঠে আদু বলল।আমার দায় পড়েছে বাড়িয়ে বাড়িয়ে মিথ্যে বলার।– চোখ জোড়া গরম করে চিনুদা বলল- ঠিক আছে। আর কিছুই তোদের বলবো না।প্রীতম শাসনের সুরে বলল- আদু, তুই কেন বার বার কথার মাঝে বাগড়া দিচ্ছিস?তারপরে তোর মামা বাজিতে জিতেছিল।– সুইন্যা জিজ্ঞ্যেস করল।তোরা যে যা\'ই বলিস, আমি ভাবছি মামার বন্ধুটির সাহস আছে বটে!- কমল বেশ চিন্তিত হয়েই বলল।কমলের কথাতে চিনুদা বেশ খুশীই হলো। যা\'ই হোক কমল ওর গল্পটা বেশ বিশ্বাস করছে; চিনুদা মনে মনে ভাবল। সবাই একের পর এক কথাই বলে যাচ্ছে। চিনুদা একেবারে নিরব। তারপর বেশ রাগ করেই চিনুদা বলল- ঠিক আছে। তোরা কথা বল। আমি উঠলাম।প্রীতম হালকা ধমকের সুরে সবার উদ্দ্যেশে বলল- সবাই চুপ কর তো! গল্পের বাকিটা শুনি। তারপর কথা বলা যাবে।মুড নেই। আর কোন গল্প বলতে পারবো না।– চিনুদা বেশ রেগে আছে এখন।কিসে তোর মুড আসবে?- প্রীতম জানতে চাইল।এমন ভাব করছিস যেন, সাত রাজার ধন চাইলে তা\'ও এনে দিবি!- চিনুদা ব্যঙ্গ করে বলল।বম্বে চানাচুরে মন ভরবে তো?- পকেটে হাত দিতে দিতে প্রীতম বলল- বাজারে কে যাবি?আদুকে যেতে হবে।– চিনুদা বলল- তুই কথায় কথায় বেশি বাগড়া দিয়েছিস। এটাই তোর শাস্তি। যা এখনই। এক মুহূর্ত দেরি করবি না। এক দৌঁড়ে যাবি আর আসবি।কোন কথা না বলে আদু গাছ থেকে নেমেই বাজারের দিকে দিল এক ভোঁ দৌঁড়। আদু ফিরে আসার পর সবার হাতে চানাচুর পৌঁছে গেল। তবে সিংহ ভাগ চিনুদার হাতে। চানাচুর হাতে নিয়ে এক মুঠ মুখে চালান দিল। তারপর চিবোতে চিবোতে চিনুদা আবার শুরু করল- মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরে পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল। বন্ধুটির জ্ঞান ফিরছে না দেখে একে একে সবাই ঝোঁপের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন।আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। ভূত বলতে আবার কিছু আছে নাকি?- বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে কমল বলল।তাহলে তুই ভয় পাস কেন?- চোখ রাঙিয়ে চিনুদা বলল- সন্ধ্যার পরেইতো তুই গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিড়ালের মত মিউ মিউ করে গানের কলি আওড়াস কেন!ভয় পেলাম আবার কোথায়!- ভাঙা ভাঙা স্বরে কমল বলল- গান তো সবাই গায়।আহা! আবার কথার মোড় ঘুরে যাচ্ছে।– বিরক্ত হয়ে সুইন্যা বলল- গল্প তো শেষ হয়নি। আর এদিকে বেলা প্রায় শেষ।চিনুদা চানাচুর শেষ করে কাগজটা জলে ছুঁড়ে ফেলে গল্প শুরু করল- তারপর সেকি অবস্থা! মামার বন্ধুটিতো যায় যায় অবস্থা। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। সকাল বেলায় জ্ঞান ফিরল। ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন। পরদিন দুপুর নাগাদ কিছুটা সুস্থ হলেন। তবে উনি বেশ সাহসী থাকাতে বেঁচে গেছেন।– কমলকে উদ্দ্যেশ্য করে চিনুদা বলল- তোর মতো হলে, এই জনমে আর মামার কোলে বসতে পারতি না এই বুড়ো বয়সে!কমলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুইন্যা বলল- কাণ্ডগুলো কিভাবে ঘটল তা\'তো ভীষণ খটকা লাগছে- তোর মামা আর অন্য বন্ধুরা সেই সময় শ্মশানে কেন?ব্যাপারটাইতো এখানে।– চিনুদা বেশ রহস্য করে বলল- সব খুলে বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোন।যখন মামা ও সকল বন্ধুদের মাঝে কথা হলো- রাত বারোটার পর বন্ধু বিমল শ্মশানে যাবে। কথা শেষে সবাই চলে গেল। তারপর মামা বন্ধু বিমল ব্যতীত সববন্ধুকে ডেকে এনে পরামর্শ করল যে, বিমলকে যেভাবেই হোক ভয় দেখাতে হবে এবং ভূত বিশ্বাস করাতে হবে। আসল কথা হল যেভাবেই হোক ভয় দেখানো। কারণ বিমল খুব বেশি রকম সাহসী। যার দরুণ প্রতিটি ক্ষেত্রে উনার কদর সবচেয়ে বেশি এবং সকলের কাছে সমাদৃত। তাই মামার কথায় সবাই রাজী হয়ে গেলেন।পথে তেমন কোন সংকেত ব্যবহার করেনি। যদি ঘটনা টের পেয়ে যায়। শ্মশানে ঢোকার পথে প্রথমে ঝোঁপের আঁড়ালে বসে মামা ভেণ্ডী গাছটা নেড়েছিল। যখন দেখল যে বন্ধু বিমল তেমন ভয় পাচ্ছে না তখন নিরাশ হয়ে গাছ নাড়ানো থামিয়ে দিলো। মামা অবশ্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। যদি কারণ খুঁজতে বিমল গাছের কাছে চলে আসে। তাই দ্রুতই গাছ দোলানো বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর আরেক বন্ধু প্যাঁচার ডাক ডেকেছিল। কিন্তু শব্দটা যে কিসের হয়েছিল তা\' কেউ বুঝতে পারেনি। তবে শুনতে বেশ বিশ্রী রকমের হয়েছিল এবং ভয় জাগানিয়া শব্দ। কিন্তু তা\'তেও যখন ভয় তেমন পাচ্ছিল না তখন অন্য বন্ধু ঝুমঝুমি বাজিয়েছিল। কিন্তু হাতের কাঁপুনিতে ওটার শব্দও একটু অন্যরকম হয়ে গেল। কিন্তু তা\'তেও ফল না দেখে মামা উনার জায়গা থেকে ঢিল ছুঁড়েছিলেন। তারপর ফেরার পথে অনন্যোপায় হয়ে কংকাল দেখিয়েছিলেন।উনাদের ইচ্ছে ছিল অল্প ভয় পাইয়ে উনারা জয়ী হবেন। তাই প্রথম দিকে কংকাল দেখাননি। যদি বেশি ভয় পেয়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু অবশেষে কংকাল দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও যখন দেখা গেল, বন্ধু বিমল জয়ের মালা ছিনিয়ে নিচ্ছে তখনই মামা শেষ মুহূর্তে উনার শার্টটার কোণায় টেনে ধরেছিলেন। তারপরই উনি জ্ঞান হারিয়ে ধরাশায়ী হলেন।নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রীতম বলল- চিনুদা, যত কিছুই বলিস তোর মামার বন্ধুটি দুর্দান্ত সাহসী। প্রীতমের কথায় সবাই সায় দিল।গল্পটা তোদের কেমন লেগেছে?- চিনুদা জানতে চাইল।সবাই সমস্বরে বলে ওঠল- দারুণ লেগেছে।আশেপাশে তাকিয়ে চিনুদা বলল- কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল টেরই পেলাম না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।– বলেই গাছ থেকে লাফিয়ে নামল। তারপর একে একে সবাই গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল। চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কেউ কারও কাছে প্রকাশ করছে না। কিন্তু সবার মাঝেই এক অজানা ভয় ঝেঁকে বসেছে। ওদের চলনেই তা\' স্পষ্ট; সবাই গা ঘেষাঘেষি করেই হাঁটছে। আর ফাঁকে ফাঁকে এদিক-ওদিক ভয়ার্ত চোখে তাকাচ্ছে। তবে চিনুদা ভয়হীন পায়ে এগিয়ে চলছে। হাঁটতে হাঁটতে চিনুদা বলল- আগামীকাল একই সময় আসবি। আরেকটা মজার গল্প বলবো।সবাই বেশ খুশী হয়ে বলল- ঠিক আছে। *
0 Comments