‘শঙ্খজীবন’✍️নাদিয়া নওশাদ কুসুমপুরের মধ্যবিত্ত,সাধারণ রক্ষণশীল পরিবারে তনুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা আনিসুল হক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বেশ রগচটা ও বদমেজাজী। সর্বক্ষণ কড়া শাসনে তনু কে প্রতিপালন করেছেন। তনু আনিস সাহেব ও মোমেনা বেগমের একমাত্র সন্তান। কন্যা সন্তানের জনক বলেই আনিস সাহেবের তনুর প্রতি পিতৃস্নেহটা একটু কম। ছোটবেলা থেকেই তনু পড়াশোনায় দূর্দান্ত! উচ্চ মাধ্যমিকেও ভালো ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্ত আনিস সাহেব যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তনুকে উত্তম পাত্রস্থ করতে চান। এদিকে মোমেনার শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। ডায়বেটিস,প্রেসার,হাঁড়ের ক্ষয় নানাবিধ রোগে আক্রান্ত সে। এ নিয়ে আনিস সাহেবের মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। তনুর সমবয়সী জয়া, একই বাড়ির তিনতলায় ভাড়া থাকে। ইতিমধ্যেই সে বার কয়েক তনুদের বাসায় আসা-যাওয়া করেছে আর আনিস সাহেবের লোলুপ দৃষ্টি তার উপর পড়েছে!সম্পর্ক আরেকটু ঘনীভূত হতেই একদিন আনিসুল হক ও জয়া কোর্ট ম্যারেজ করেবাড়ি ফেরে। অতল সাগরে পড়ে যায় তনু আর মোমেনা!অবিশ্বাস্য এই কান্ড দিশেহারা মা আর মেয়ে। সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায় তনুর। তাই বন্ধুর মতো মাকে বুঝিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তনু। চলে আসে ঢাকায় বসবাসরত একমাত্র খালার বাড়িতে। রাজধানীতে এসে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয় সে। সাথে দুই-তিনটে প্রাইভেট টিউশনি যোগাড় করে নিজ পড়ার খরচ চালায়। মইন খালার বাড়ির প্রতিবেশীর ছেলে। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত। প্রথম দেখাতেই তনুর প্রেমে পড়ে যায় মইন।একদিন হুট করেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তনুরও বিয়ের প্রস্তাবে খুব একটা আপত্তি হয়নি। চট করে কাজী অফিসে গিয়ে শুভ পরিণয় সেরে নিলো দুজনে। বাঁধ সাধলো মইনের বাবা বোরহান সাহেব। বাবা-মায়ের আশ্রয়হীন অপরিচিত মেয়েকে বৌমা হিসেবে গ্রহণ করতে উনি নারাজ। তাই মইন,তনু ঘর বাঁধে একই শহরের ভিন্ন জায়গাতে,দু’কামরার একটি বাড়িতে। তারপর সুখের দিন কাটছিল দুজনার।মধুর সময় কাটালো দুজনে। বছর খানেক পর তনুর কোল আলো করে পৃথিবীর বুকে এলো শশী। তনুর জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়েই মইন আর শশীর বসবাস। একদিন সকাল,দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। মইন অফিস থেকে আর বাড়ি ফিরল না। দেড় বছরের ছোট্ট শশীকে নিয়ে তনু মইনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত পার করে দিলো। কিন্ত মইন বাড়ি ফিরল না। তনু থানায় মইনের নামে নিখোঁজ ডায়েরী করলো।আনিস সাহেবের দিনের পর দিন অবহেলা,না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের ধাক্কা সব মিলিয়েই মোমেনার এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়া আর খালার কাছে দু’দিন আগে মায়ের এমন মৃ*ত্যু*ব*র*ণের খবর পেয়ে তনুর পায়ের তলার মাটি যেন নড়বড়িয়ে উঠলো। দিন,মাস,বছর পেরিয়ে গেলো মইনকে আর ফিরে পেলো না তনু।এখন শশীর দশ বছর। কোনওমতে পরিচিত পাতানো এক ভাইয়ের কাছে অনুনয় করে বাড়ির পাশের ছোট্ট একটা স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে তনু। সাথে দু’চারটে টিউশনি করে খুব কষ্ট করে শশীকে প্রতিপালন করে সে। একইসাথে শশীর বাবা ও মা হয়ে নৈতিক,বাস্তব সম্মত শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করে। একদিন শশীর জন্মদিনে তনু আর শশী এক রেস্তোরায় খেতে যায়।সেখানে হঠাৎই মইনকে অন্য একজন মহিলার সাথে দেখতে পায় তনু।মুহূর্তের মধ্যেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তনুর। কাছে গিয়ে মইন কে জিজ্ঞেস করলো তনু,“কেমন আছো?” কিন্ত মইন তনুকে চিনতে পারলো না। সাথের ভদ্রমহিলা লায়লা নামে নিজের পরিচয় দিয়ে তনুকে একটা পাশে এনে জানালো দশ বছর আগে একটা মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মইনের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে। লায়লা পেশায় একজন মনোচিকিৎসক।তারি হাসপাতালে মইনের চিকিৎসা রা হয়। এক পর্যায়ে মইন লায়লা পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে আর বিয়ে করে। সব শুনে তনু লায়লাকে আর নিজের পরিচয় না দিয়ে শশীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার তনু। শৈশব,কৈশোর,যৌবন সবটাই তার এক শঙ্খজীবন! নিজের জীবনের প্রাপ্তিটি আজও তনুর কাছে অধরা। তার এই শঙ্খজীবনের আশা একটাই শশী যদি কোনওদিন তনুর জীবনের দুঃখটা বুঝে মা কে আগলে রাখে। *সমাপ্ত*
0 Comments