
বাংলা নিয়ে তেতোকথা - এস, এম, ইমরানুল ইসলাম (রাজন)
বাংলা নিয়ে তেতোকথা এস, এম, ইমরানুল ইসলাম (রাজন) বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব, অহংকার, আলোচনা বা মাতামাতির শেষ নেই। এই ভাষার জন্য কত লাঠালাঠি, আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্ত ঝড়েছে। হতাহত হয়েছে অনেক। সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন বা তাকে সমৃদ্ধ করতে গত পৌনে শতাব্দিজুড়ে যে হৈ-হুল্লোর হয়েছে তা বোধ করি অন্য ভাষা নিয়ে হয়নি। মূল সমস্যাটা বাধে যখন প্রাতিষ্ঠানিকরুপে, পড়াশোনায় বা গবেষনার ক্ষেত্রে। সেখানে দেখা যায়, বাংলায় অনুবাদকৃত তেমন কোন বই-পুস্তক বা গবেষনামূলক বা অধ্যয়নযোগ্য কোন কিছু তেমন নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের তেমন কোন বই নেই। তার অন্যতম কারন হলো বাংলা ভাষার পরিভাষা ও শব্দের পরিমান অতি নগন্য। তাহলে এর থেকে পরিত্রান কি? উপায় কি? বা এর জন্য দায়ী কে? অন্য ভাষা? মোটেও তাও নয়। প্রকৃতির নিয়মে হোক বা পারিভাষিক শব্দের অভাবে হোক অন্যভাষার শব্দগুলো সেই অভাব বা শুন্যতা পূরন করেছে। একটা সময় ইংরেজী ভাষাকে শত্রæ ভাবা হতো। তার কারন হলো তারা দীর্ঘদিন আমাদের শোষন করেছে, অত্যাচার করেছে, যন্ত্রনা দিয়েছে, আমাদের অভাবগ্রস্থ করেছে তাদের বিলাসিতার জন্য। ঠিক একই ভাবে অমুসলিমদের কাছে আরবি ও ফার্সি বা পাকিস্তানি শাসকদের কারনে উর্দু শত্রæ হয়েছে। তবে সেগুলো সবই ছিল স্বার্থের দ্বন্দ ও রাজনৈতিক। কারন ভাষা নিজে কারও শত্রæ হতে পারে না। বাংলা ভাষী ক্ষমতাধরদের ব্যর্থতার ভার তারা বিদেশী ভাষার ঘাড়ে চাপিয়ে বাহবা পেয়েছে যুগ যুগ ধরে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেই ইংরেজী আজ সর্বোচ্চ মর্যাদার আসন অলংকরন করে আছে বীরদর্পে। পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের শোষন টপকে ১৯০ বছরের অত্যাচারের যন্ত্রনা সহজে ভুলে উর্দুকে শত্রæ বানিয়ে ইংরেজী আজ রাজসিক সাজে বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘোরাচ্ছে দেশজুড়ে। অসম্পুর্ন ও ভাড়াটে ভাষা ইংরেজীকে আজ গুরু ভক্তি করা হচ্ছে। এর কারন এই নয় যে, ইংরেজী অনেক সমৃদ্ধ বা এটি ছাড়া জীবন পার করা অসম্ভব। অথচ, ইংরেজীর চাইতেও সমৃদ্ধ ও প্রয়োজনীয় অনেক ভাষার প্রতি আমাদের তেমন কোন আগ্রহ চোখে পড়ে না। যে ভাষাগুলো সাধারন মানুষের সাথে সম্পর্কিত সেগুলোর চর্চাও ঠিকমতো হয় না। উচ্চবিত্ত মানেই ইংরেজী, গরীব মানেই আরবি কারন অভাবীদের একটি বড় অংশ মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত। গরীব, অভাবী বা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কাছে প্রচলিত পড়াশোনাটা বিলাসিতা। দেশব্যপী প্রাথমিক স্কুল থাকলেও সেখানে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই। এছাড়াও বেসরকারী ও এনজিও ভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাছাড়া দেশের প্রবাসীদের বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে। ভাষা না জানার কারনে আয়-রোজগার ও দিনপাত করা তাদের জন্য রীতিমতো দূর্বিসহ ও কঠিন চ্যালেঞ্জের। যদি তারা আরবি ভাষাটা মোটামুটি শিখে যেতে পারতো, তাতে হয়ত তাদের রোজগার কিছুটা বৃদ্ধি পেত ও সামগ্রিকভাবে একটা স্বাস্তি ফিরতো তাদের জীবনে। এবিষয় নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেয়া দূরের কথা, চিন্তাটাই কেউ করেনি। কারন মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের বিরাট অংশ নি¤œবিত্ত ও নিরক্ষর। রাষ্ট্র তাদের প্রবাসী কল্যান কার্ড দেয়া ছাড়া আর কোন সুবিধা দিতে পারেনি। আর সামান্য কিছু অংশ ইংরেজী, জাপানী, কোরিয়ান, ফ্রেন্স বা জার্মান ভাষা কোনমতে শিখে সেই সকল দেশে যাওয়ার ্একটা পথ খুঁজতে ব্যস্ত। তাদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত ঘরের। আশ্চর্যের বিষয় হলো য়িয়োরেপ বা আমেরিকায় যারা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই লক্ষ লক্ষ টাকা লগ্নি করে সেইসকল দেশে গিয়ে তথাকথিত নীচু কাজ বা অডড জব করতে বাধ্য হচ্ছে। দৃশ্যত তারা আয় করছে লাখ টাকা কিন্তু তাদের জীবন মানের ব্যয় মেটাতে অধিকাংশ ঋণের জালে বন্দি হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। অথচ, তার ১০% অর্থ ব্যয় করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়াটা তাদের মর্যাদার বিষয় হয়ে দাড়াচ্ছে। দেশে গুটি কয়েক মানুষের জন্য এই ইংরেজী আজ রাজার আসনে অধিষ্ঠিত। বিভিন্ন বাস্তবিক পেক্ষাপটে ও রাজনৈতিক কারনে অন্য ভাষা যেমন আমাদের চোখে শত্রæ বা কম দামী তেমনি ক্ষমতার কারনে ইংরেজি আজ উচ্চ আসনে। আরো একটু খোলাসা করা যাক ব্যাপারটা। ইংরেজরা আমাদের ভূখন্ডে যে সমাজব্যবস্থার প্রচলন করে গিয়েছে, তার কোন বৃহৎ পরিবর্তন হয়নি। মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁয়ের মতো তা আরো সুদৃঢ় ও শক্ত-পোক্ত হয়েছে। তাইতো বিলেতীরা এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ইংরেজীর প্রসার সমানুপাতিকহারে বেড়েছে মাতৃভাষার চাইতে। ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বেড়েছে হাজারগুনে। এর ফলে যে দেশব্যপী ইংরেজী জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে বা ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা বেড়েছে, তা কিন্তু না। আসলে ইংরেজী জানা বা শেখা মানে একটা মর্যাদার ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। কারন সমাজের ক্ষমতাবান ও উচ্চবিত্তের ইংরেজী প্রীতি ও ভালবাসা এর মূল কারন। অনেক জানা শোনা তথাকথিত ভালো ইংরেজী জানা ছেলে পুলে বা বিজ্ঞ ব্যক্তিও ঠিকমতো ইংরেজীতে দুকলম সুন্দর কলাম, সাহিত্য বা গবেষনাপত্র লিখতে পারে না। ইংরেজী জানার দাঁড়িপাল্লা হিসাবে পরিচিত টোফেল বা আইইএলটিএস এ ভালো নম্বর পেয়েও তারা ইংরেজীর তেমন কোন পান্ডিত্য অর্জন করতে পারছে না। তার কারন তারা তো শুধু নিয়মতান্ত্রিক কিছু পেট চালানোর ইংরেজী ও ভাষাভাষা গ্রামার শিখছে ঐ দাঁড়িপাল্লায় নিজেকে মাপার জন্য। তারা সাহিত্য চর্চা করছে না, ভাষা বিজ্ঞানের চর্চা করছে না, ঠিকমতো পড়ছেও না বেশিরভাগ মানুষ। আসলে তাদের পড়ানো হচ্ছে না। ইংরেজী শেখানোর কারিগররা আদতে ঠিকমতো শেখাতে চাচ্ছে না। আরেকটি বিষয় দেখে অবাক হতে হয়, বাংলার অনেক রথী-মহারথীরা সামাজিক মাধ্যম, মিডিয়া বা মাঠে-ময়দানে বাংলা ভাষার পক্ষে বিস্তর চেঁচামেচি করছে, গরম করে রাখছে তার কলাম বা ভাষন দ্বারা। প্রকৃতপক্ষে তারাও ইংরেজী প্রীতির কারনে বিলেত বা মার্কিন মুল্লুকে রুটি রুজির জন্য ধন্যা ধরছে, তাদের ছেলে-মেয়েকে বাংলা মাধ্যমে পড়াচ্ছে না বা দেশেই রাখছে না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ঘুষখোর, দূর্নীতিবাজ, বাটপার, সমাজ বিরোধী, কালোবাজারী, শিক্ষা-ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি চরম উদাসীন ইত্যাদি শ্রেনীর ছেলে-মেয়েরাই ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশোনা করছে অধিকহারে। হাতে গোনা মেধাবী কিছু ভুত-ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বিলেতি বা বিদেশী স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইংরেজীর দিকে ঝঁকে পড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়েরা সাফল্য পাচ্ছে। রাষ্ট্র ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না। ইংরেজ শাসন নেই অথচ, নামকাওয়াস্তে ইংরেজীর কেন এত প্রসার হচ্ছে, এর কারন কি? কারন ইংরেজদের তৈরী করা একশ্রেনীর উচ্চবর্ণের মানুষেরা দায়ী। ইংরেজ শাসনের সময়ও তারা সাধারন মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা বা আইকন হিসাবে বিলেতী তাবেদারী করেছে, সুবিধা নিয়েছে, তারাই আবার ইংরেজীতে অপন্ডিত হত দরিদ্র, দূর্বল মানুষের মাঝে এসে উচ্চ আসনে জীবন পার করেছে। ইতিহাসে সমাজ সংস্কারক, জ্ঞানী-গুণী হিসাবে তারাই বীর দর্পে পরম্পরা রক্ষা করে চলেছে। ইংরেজীর আড়ালে তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা তাদের রক্তে রয়েই গেছে। আর এই ঔপনিবেশিক মানসিকতায় বাংলার প্রধান শত্রæ। তাদের যোগ্যতা বা ক্ষমতা থাকা স্বাত্তেও নিজেরা ঠিকই ইংরেজীতে তাদের মসনদ রক্ষা করেছে। বাংলার স্থায়িত্বের জন্য আদতে তারা কোন কাজই করেনি। বাংলার ঐতিহৃ, মর্যাদা, যোগ্যতা নিয়ে তারা তেমন প্রচার করেনি। বাংলার শক্তিশালী ও যোগ্যতার ইতিহাস তারা চেপে গেছে সুকৌশলে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পায়, বাংলার শিক্ষিত-অশিক্ষিত আপামর জনার অনেকাংশ আজ ভিনদেশী বা ইংরেজীর বিভিন্ন দিক তারা চর্চা করে, প্রচার করে, আত্বতৃপ্তি পায়। বাংলাকে শুধু চেতনায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, সত্যজিৎ রায়ের বদলে জেমস ক্যামেরুন-স্পিলবার্গ, শবনম বা সুচিত্র সেনের বদলে মনরো-কিডম্যান, শাহ আব্দুল করিম বা লালন শাহ বা ওস্তাদ ফতেহ আলী খানের বদলে বিটোফেন-ক্লাপটন, উত্তম কুমারের বদলে মুর-লিওনার্দো, বিদ্যাসাগরের বদলে সেক্সপিয়ার, নজরুলের বদলে ওয়ার্ডওয়ার্থ, অমত্যসেন- প্রফেসর ইউনছের বদলে মার্কস-স্যামুয়েলসল, জগদিশ চন্দ্র এর বদলে মর্কনী ইত্যাদি কে প্রমান হিসাবে ব্যাবহার করাকে স্মার্ট ও আধুনিক মনে করছে। পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, আহার-বিহার, অবকাশযাপন ইত্যাদিতে ও আজগুবি বৈচিত্র এসেছে। প্রকৃতপক্ষে ঐসকল ভাড়াটে বিদেশী জ্ঞানী-গূনীর কর্ম বা জীবন যে আদর্শ হিসাবে নিয়েছে তা নয়। তাদের যোগ্যতা বা জীবনাদর্শকে প্রমান হিসাবে নিয়ে পথ চলছে, তাও না। তাহলে আসলে বিষয়টা কি? এগুলো শুধু ইংরেজী বা বিদেশপ্রীতির মতো হীনমন্যতার জন্যই করছে। এর জন্য কি আজকের তরুন সমাজ দায়ী? মোটেও না। ঘুরে ফিরে সেই সামন্তবাদীতা ও ঔপনিবেশিক মানসিকতা দায়ী। কারন তারই মূলত ভূখন্ডের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করে চলেছে। তাদের এই পাগলামো, সামন্তবাদী চেতনা, শোষনের মানসিকতা, মিথ্যা, উচ্চবিত্তের কৃত্রিম বলয় ভাঙতে হবে বাংলাকে দিয়েই। লড়াইটা শুরু করতে হবে চর্চা ও চিন্তা দিয়ে। হিংসা বা বিদ্বেষ দিয়ে নয়। বাংলার যত ভালো কিছু আছে, সেগুলো প্রত্যেকের মনে মনে পৌছে দিতে হবে। বাংলার রুপ, সাহিত্য, অর্জন, ঐতিহৃ এবং এর প্রসারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিভাষা, শব্দ প্রচলন করতে হবে। যে যার স্থান থেকে অল্প-স্বল্প করে হলেও এগোতে হবে। বিদেশপ্রীতির মিথ্যা ফানুস ফুটো করে দিতে হবে যুক্তি ও বাস্তবতা দিয়ে। বিদেশের মাটিতে আত্বমর্যাদা নিয়ে যে বাঁচা যায় না তা যুগে যুগে প্রমানিত হয়েছে বিভিন্নভাবে। ভবিষ্যতকে বাঁচাতে হতে আজ থেকেই লড়াই শুরু করতে হবে। প্রথমে শুরু করতে হবে মনস্তাত্বিক লড়াই। তারপর ব্যাবহারিক আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের মনে রাখা উচিত পৃথিবীর কোন ভাষায় কোন ভাষার শত্রæ হতে পারে না বা শত্রæ না। ভাষাকে যখন হাতিয়ার বা স্বার্থে ব্যাবহার হয়, তখন ই সে ভাষার খোলস ছেড়ে তাবেদারীতে পরিনত হয়। মানুষ ও ভূক্ষন্ডের শত্রæ হিসাবে হাজির হয়। তাহলে বাংলা ও তার ঐতিহৃকে কিভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে? কাজটা অত সহজ না। কারন দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তিকর মরিচা দূর করা কঠিন ব্যাপার তবে অবাস্ত বা অসম্ভব নয় মোটেও। বাংলার প্রেম, মাধুর্য্য, গভীরতা ও কোমলতা দিয়েই তাকে পুনর্জীবিত করতে হবে। প্রয়োজনে অনেক ভাষা চর্চা করবো, তবে বাংলাকে পাশ কাটিয়ে নয়। বাংলাকে মূল ভিত্তি হিসাবে ধরেই অন্যদের চিন্তা করতে হবে। কারন আমাদের কাছে বাংলা শুধু নিছক একটি ভাষা নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মায়্,া মমতা, জীবনাদর্শন, মনের চুরান্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
বাংলা নিয়ে তেতোকথা - এস, এম, ইমরানুল ইসলাম (রাজন)
ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন, কবিতা, ছড়া ও গল্প লেখার অভ্যাস। তবে সংবাদ পত্রে প্রতিবেদনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক লেখালেখির শুরু।
0 Comments