রাতে আকাশে চাঁদ নেই, চারদিক যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইটে অল্প আলোয় ফারহানা দেখতে পেল সামনে “নীলকুঞ্জ ভিলা” লেখা এক পুরনো দোতলা বাড়ি। বাড়িটা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছ থেকে, যার কোনো উত্তরসূরি ছিল না। শহর থেকে বেশ দূরে, প্রায় নিঃসঙ্গ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা ফারহানার কৌতূহলকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছিল অনেক দিন ধরে।চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই গন্ধটা প্রথম ধাক্কা দিল—পুরনো কাগজ, ধুলো আর যেন কোথাও পচে যাওয়া কিছু একটা!রাতটা বাড়ির ভেতরেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফারহানা। তার মতে এসব ‘ভূতের বাড়ি’ গুজব ছাড়া কিছু নয়। সে সাহসী, শিক্ষিতা এবং যুক্তিবাদী।ঘড়িতে রাত তখন ১১টা। হঠাৎ শোবার ঘরের পাশের বড় আয়নাটার সামনে দিয়ে এক ঝলক সাদা শাড়ি পরা নারীর প্রতিচ্ছবি চলে গেল। ফারহানা চমকে উঠল, কিন্তু আয়নাটার সামনে গিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। সে ভাবল, “সম্ভবত নিজেরই ছায়া দেখেছি।”রাত সাড়ে বারোটায়, হঠাৎ শুনতে পেল প্রথম হাসি—একটা টানা, ঠান্ডা, খাঁচা গলার হাসি:“হি… হি… হি…”জানালা খোলা, বাইরে কেউ নেই। ভেতরেও না। সে ভয় পেল না ঠিক, কিন্তু বুকের ভেতর একটা অজানা অস্বস্তি জেগে উঠল।রাত দুইটার দিকে ঘরের দরজার নিচ দিয়ে হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই দ্বিতীয় হাসি—এবার হাসিটা কিছুটা জোরে, যেন কে যেন ঠিক পাশের ঘরে দাঁড়িয়ে:“হি হি হি… হা হা হা…”ফারহানা উঠে পড়ল। টর্চ হাতে নিয়ে এক এক করে ঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগল। সিঁড়ির পাশে একটি পুরনো ছবি—একজন নারী, কপালে টিপ, চোখে কালো কাজল। নাম লেখা: \"সুদর্শনা দেবী, ১৯৩২\"। নিচে লেখা, “মৃত্যু: ১৯৫৪ – আত্মহত্যা”।ঘরের পাশেই একটা ছোট বদ্ধ কক্ষ। দরজাটা অনেক কষ্টে খোলে। ভেতরে ঢুকতেই ফারহানা বুঝল, কেউ তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুরে তাকাতেই কিছুই নেই। তখনই পেছন থেকে আসে তৃতীয় হাসি—এইবার হাসিটা হাহাকারময়, হাহাকারে গলা ভেঙে যাওয়া এক নারীর মর্মান্তিক আর্তি:“হা… হা… হা… হি… হি… হি…!!”হঠাৎ ঘরের মাঝখানে একটা মোমবাতির মতো আলো জ্বলে উঠল। সেই আলোয় ধীরে ধীরে একজন সাদা শাড়ি পরা নারী আবির্ভূত হলো—চোখে কান্না, ঠোঁটে বিকৃত হাসি। সে বলল,“তুই আমার ঘরে ঘুমাতে এসেছিস? আমি মরিনি… আমি হাসি... আমি কাঁদি... আমি ঘুমাতে পারি না…”কাউকে ঘুমাতেও দেই না। তবে তোকে কিছু করবো না, তুই আমাকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দে। এখানে বহুদিন কেউ আসেনা। তুই আমাকে সাহায্য কর।ফারহানার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। সে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।সকাল হলে স্থানীয় এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল ফারহানা, “এই বাড়ির ইতিহাস কী?”বৃদ্ধ বলল, “এই বাড়িতে একসময় জমিদার থাকতেন। তাঁর স্ত্রী সুদর্শনা দেবী নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সবাই বলে, তিনি এক রাতে তিন রকম হাসি দিয়েই নিজের গলায় দড়ি দেন। তারপর থেকে এই বাড়িতে রাত হলে তিন হাসি শোনা যায়—একটা হাসি কৌতুকের, একটা রাগের, একটা কান্নার...। কেউ সে রাত টিকতে পারে না।”ফারহানা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।তবে সেই রাতে নীলকুঞ্জ ভিলার জানালায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে হাসছিল—তিন রকম হাসি একটার পর একটা…“হি… হি… হি…”“হি হি হি… হা হা হা…”ফারহানা ভেবেছিল সে আর ওই বাড়িতে ফিরবে না। কিন্তু কৌতূহল মানুষের মন থেকে সহজে যায় না। কয়েকদিন পর আবার সে ফিরে এল নীলকুঞ্জ ভিলাতে।এবার সাথে আনল রেকর্ডার, ক্যামেরা, কিছু ধূপ-ধুনো, আর স্থানীয় এক পুরোহিত—চরণচন্দ্র ঠাকুর।পুরোহিত বাড়ির ভেতরে ঢুকেই বললেন,“এখানে শুধু আত্মা নয়, আছে অভিশাপ। কেউ তাকে চেয়েছিল পাগল বানাতে, আর সে হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর দেবী...”রাত ১২টা, শুরু হল পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ। ফারহানা পাশের ঘরে বসে সব ক্যামেরা চালু করে মনিটরে নজর রাখছে। হঠাৎ একটা ক্যামেরা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল।তারপর আরেকটি।তৃতীয় ক্যামেরা হঠাৎ ফুটেজে দেখায়—একজন নারী, গা ছমছমে রক্তমাখা মুখে দাঁড়িয়ে আছে পুরোহিতের পেছনে!ঠিক তখনই প্রথম হাসি বাজল ঘরে,“হি… হি… হি…”পুরোহিত চিৎকার করে উঠলেন: “সুদর্শনা! তুই তোর মৃত্যু ভুলে গেছিস!”সে মুহূর্তে মেঝে কেঁপে উঠল, ঘরের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল নিজে নিজে। ধূপের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে নারীর ছায়াটা ধীরে ধীরে ঘুরে এসে ফারহানার সামনে দাঁড়াল। এবার তার ঠোঁটে আর হাসি নেই, শুধু চোখে জলের ধারা।সে কাঁপা গলায় বলল:“আমায় বাঁচাও... আমার হাসিগুলো শুধু পাগলামি নয়, আমার আর্তনাদ… আমার স্বামী আমাকে পাগল বানিয়ে রেখে তার বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি হাসতে হাসতে মরেছিলাম... এখন আমি আর হাসতে চাই না...”ফারহানা বলল, “তবে তুমি মুক্তি চাও? কী করতে হবে আমাকে?”ভূত উত্তর দিল না। শুধু হাতে তুলে দিল একটি পুরনো চিঠি।সুদর্শনার নিজের লেখা চিঠি—যেখানে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার মানসিক নির্যাতন, তার সন্তান হত্যার দায় সব কিছুই লেখা ছিল। কিন্তু সেই চিঠি কাউকে দেওয়া হয়নি, বরং দেয়ালে পেছনে চাপা দেওয়া হয়েছিল।চিঠিটা নিয়ে ফারহানা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে যায়। তদন্তে উঠে আসে, বাড়ির জমিদার ও তার বন্ধু মিলে সুদর্শনাকে ‘পাগল’ প্রমাণ করে তাকে বন্দি করে রেখেছিল ঘরে। একদিন তার সন্তানকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে, আর সেই রাতে সুদর্শনা একাই হাসতে হাসতে গলায় দড়ি দেয়।তিন হাসি ছিল তার তিন পর্যায়ের মানসিক ভাঙ্গনের প্রতিচ্ছবি—একটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতা,একটা সন্তান হারানোর পাগলামি,আর একটা মৃত্যুর আগে চরম বিষাদের হাসি।ফারহানা সেই চিঠি দিয়ে স্থানীয় এক স্মারকভবনে একটি সত্য ঘটনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিল। নীলকুঞ্জ ভিলা তালা মেরে দেওয়া হলো—কিন্তু যাওয়ার আগে শেষ রাতে সে শুনল এক আলতো হাসি, যেন মুক্তি পেয়েছে কারো আত্মা...\"হি... হি... হি...\"এইবার হাসিটা ছিল শান্ত, মায়াময়, যেন এক অন্ধকার যুগের অবসান হলো।
রাতে আকাশে চাঁদ নেই, চারদিক যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইটে অল্প আলোয় ফারহানা দেখতে পেল সামনে “নীলকুঞ্জ ভিলা” লেখা এক পুরনো দোতলা বাড়ি। বাড়িটা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছ থেকে, যার কোনো উত্তরসূরি ছিল না। শহর থেকে বেশ দূরে, প্রায় নিঃসঙ্গ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা ফারহানার কৌতূহলকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছিল অনেক দিন ধরে।চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই গন্ধটা প্রথম ধাক্কা দিল—পুরনো কাগজ, ধুলো আর যেন কোথাও পচে যাওয়া কিছু একটা!রাতটা বাড়ির ভেতরেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফারহানা। তার মতে এসব ‘ভূতের বাড়ি’ গুজব ছাড়া কিছু নয়। সে সাহসী, শিক্ষিতা এবং যুক্তিবাদী।ঘড়িতে রাত তখন ১১টা। হঠাৎ শোবার ঘরের পাশের বড় আয়নাটার সামনে দিয়ে এক ঝলক সাদা শাড়ি পরা নারীর প্রতিচ্ছবি চলে গেল।
0 Comments