অশোক দামের বাড়ি

অয়ন শহর থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল কদিনের জন্য একটু প্রশান্তির আশায়। নানারকম ঝামেলা, মানসিক ক্লান্তি আর জীবনের একঘেয়েমি থেকে পালাতে চেয়েছিল সে। গন্তব্য ছিল দূরের এক পুরাতন গ্রাম—চর সিঙ্গারদিয়া, যেটা এক সময় বিখ্যাত ছিল জমিদারি আর রাজকীয় আড়ম্বরের জন্য।গ্রামে পৌঁছে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আসে। আঁধার নেমে আসতে না আসতেই অয়ন পথ হারিয়ে ফেলে। চারদিক কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা, শুধু ঝোপঝাড় আর হাওয়ার শব্দ। ঠিক এমন সময় সে দেখতে পায় সামনে একটা প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি—ভগ্নপ্রায়, ছাদের কার্নিশ ভাঙা, জানালাগুলো কালো ফাঁকা চোখের মতো তাকিয়ে আছে।বৃষ্টিতে ভিজে অস্থির হয়ে ওঠা অয়ন দ্বিধা না করেই ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে। ঘরের ভেতর অদ্ভুত এক স্নিগ্ধ গন্ধ—পাঁকশালার ধূপ, পুরনো আসবাবের ধুলো আর আতরের মিশ্রিত গন্ধে মন কেমন করে ওঠে।হঠাৎ এক কক্ষ থেকে শুনতে পায় বাজনার আওয়াজ—তবলা, সরোদ আর ঝংকারে ভরা সুর। ভেতরে উঁকি দিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় সে।বড় ঘরের মাঝখানে মঞ্চে নাচছে এক অপূর্ব সুন্দরী নর্তকী। তার পরনে লাল-পীত শাড়ি, কপালে সিঁদুর, নুপুরের ছন্দে তার পা যেন মাটিতে নয়, বাতাসে ভাসছে। ঘরের এক পাশে বসে আছেন একজন প্রৌঢ়—জমিদার বেশে। পাশে আরো কিছু লোক, যারা মনোযোগে নাচ দেখছে আর মাঝে মাঝে প্রশংসায় গলা ফাটাচ্ছে।অয়নের মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো প্রাচীন নাট্যচিত্রে প্রবেশ করেছে।হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ে কয়েকজন মুখোশধারী লোক। মুহূর্তেই অস্ত্র উঁচিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জমিদার ও তার সঙ্গীদের ওপর। চারদিক ছড়িয়ে পড়ে চিৎকার, আর্তনাদ আর রক্ত। মেঝে ভরে ওঠে রক্তস্রোতে, নর্তকীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়, তারপর নিস্তেজ...অয়ন স্তব্ধ। ভয় আর বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ! সে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে ঘরে কেউ নেই! নেই জমিদার, নেই নর্তকী, নেই রক্তের চিহ্ন।সে শুধু দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা ঘরে, চারপাশে ধুলো, শীতলতা আর নিস্তব্ধতা।ঘাম দিয়ে ভিজে যায় অয়নের শরীর। আতঙ্কে সে দেয়ালের দিকে তাকায়—সেখানে ঝুলছে কিছু ছবির ফ্রেম। কিন্তু...ছবিগুলো এখন তাকে দেখে হাসছে।না, সেটা সাধারণ হাসি নয়। ছবি থেকে বেরিয়ে আসা এক অদ্ভুত অট্টহাসি যেন তার চারদিক ঘিরে ধরেছে। নর্তকী, জমিদার, সেই ডাকাত—সবাই যেন ছবিতে ঠাঁই নিয়েছে। তাদের চোখগুলো লাল, দাঁতগুলো ঝকঝকে সাদা, আর হাসির শব্দে পুরো ঘর কাঁপছে।অয়ন পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে—\"কে আছো! আমাকে বের হতে দাও!\"কিন্তু কোনো সাড়া নেই। দেয়ালগুলো যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে, ছাদের পলেস্তার গায়ে যেন লালচে ছোপ...ঠিক এমন সময় কানে আসে এক কণ্ঠ—\"তুমি তো চলে এসেছো অতীতে, এবার থেকে এই নাটকের এক নতুন চরিত্র তুমি...\"তারপর হঠাৎ সব নিঃশব্দ।পরদিন সকালে, গ্রামবাসীরা দেখতে পায় পরিত্যক্ত অশোক দামের ভাঙা প্রাসাদের সামনে পড়ে আছে অয়ন নামের এক শহুরে যুবকের ব্যাগ।কিন্তু অয়ন?সে যেন কোথাও নেই, কারো কোনো খোঁজ নেই...শুধু মাঝে মাঝে রাতে কেউ কেউ দূর থেকে দেখতে পায় সেই পুরনো কক্ষে আবার বাজছে সুর, আবার নাচছে এক নর্তকী—আর এক কোণে বসে আছে অয়ন... উদাস চোখে তাকিয়ে আছে অতীতে, আর ভবিষ্যতে।