তাসলিমা আক্তার কাঁধের আঁচল গুছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“কে আপনি? কাকে খুঁজছেন? আমার কাছে কেন এসেছেন?”লোকটি শান্ত গলায় বলল,“চাচী, একটু ধৈর্য ধরেন। একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে কষ্ট হয়। আগে একটা গ্লাস পানি যদি দেন… ভিতরে বসতে দেবেন না?”তাসলিমা খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন, কিন্তু শিষ্টাচারের খাতিরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,“ফারজিয়া, একটা চেয়ার আর এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।”মেয়েটি তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে একটা পুরোনো বাঁশের চেয়ার টেনে আঙিনায় রাখল। সাথে এক গ্লাস ঠান্ডা পানিও।রেখে আবার দরজার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফারহানা আর রিয়াজ হারিকেনের আলোতে বসে পড়ছে। রিয়াজের সামনের মাসে মেট্রিক পরীক্ষা।লোকটা সদর দরজা পেরিয়ে আঙিনায় এসে চেয়ারে বসলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোকে শেষ করল। যেন বহুদিন পরে পানি পেল।তাসলিমা বললেন, “আরেকটু দেব?”লোকটা মাথা নাড়ল। “না চাচী, আর লাগবে না।”গ্লাসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল,চাচী, আমার নাম সজীব। মসজিদের পাশে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছি। একজনকে খুঁজছি অনেক দিন ধরে। তাই গ্রামের প্রায় সবার সাথেই কথা বলেছি আজ দুপুর থেকে। কেউ চিনে না—আর যারা চেনে, তারা বলছে কিছু জানে না,”তার গলায় ক্লান্তি, চোখে অদ্ভুত এক জেদ।“সাইকেলটাও মাঝপথে লিক হয়ে গেছে,”—একটু হেসে বলল সজীব যেন নিজের দুর্ভাগ্যকে হালকা করার চেষ্টা।তারপর পকেট থেকে ধীরে ধীরে একটি চিঠির খাম বের করল। খামটা পুরনো, বাদামী হয়ে এসেছে, কোনাকুনি ভাঁজ পড়েছে। লেখা এত মোলিন হয়ে গেছে যে চোখ কুঁচকেও বোঝা যায় না ঠিক কী লেখা আছে।তাসলিমা আক্তার কৌতূহলী চোখে খামের দিকে তাকালেন।সজীব বলল, “এই চিঠির সূত্র ধরেই আমি এসেছি রাজনগরে। বহু পুরনো… কিন্তু একটাই নাম স্পষ্ট— শামীম।”তাসলিমা আক্তারের মুখ মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ঠোঁট কেঁপে উঠল। যেন বহু পুরনো কোনো ক্ষত হঠাৎ চিঠির খামে জেগে উঠেছে।তাসলিমা আক্তার ফারজিয়া কে ধমক দিয়ে বললেন,\"যা, পড়তে বস।\"মায়ের আচরণে হতভম্ব হয়ে গেল ফারজিয়া । কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল।কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পর, কৌতূহল তাকে টেনে আনল দরজার আড়ালে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগল।তাসলিমার মুখটা থমথমে, চোখেমুখে অস্বস্তির ছাপ। গলা যেন শুকিয়ে এল। হঠাৎ যেন বিশ বছর আগের কোনো স্মৃতি ছায়ার মতো মনের মধ্যে ভেসে উঠল।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন—\"কে আপনি? তার সাথে আপনার সম্পর্ক কী?\"\"আমি... আমি ওনার ছেলে, সজীব আল মাহমুদ।\"\"তোমার মায়ের নাম?\"\"আসমা আল মাহমুদ।\"তাসলিমার মুখ কঠিন হয়ে উঠল। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,\"তোমার মা কোথায়?\"সজীব একটু চমকে উঠল।মুহূর্ত আগেও যে নারী \"আপনি\" বলছিলেন, হঠাৎ করেই যেন \"তুমি\"তে নেমে এলেন।কিন্তু কেনো?তবু কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল।তাসলিমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন,\"একা এসেছো? তোমার মাকে নিয়ে আসোনি?\"সজীব নিচু গলায়, ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে বলল—\"আমার মা গত ১৪ জুলাই মারা গেছেন।\"মৃত্যুর আগে বাবার দেওয়া শেষ চিঠি আর একটা খামটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন— \"এখানেই আছে তোর বাবার পরিচয় পাব।\"চিঠি থেকে শুধু অস্পষ্ট কিছু শব্দই বোঝা গেল—\"প্রি আসমা... কেমন আছো... আমি রাজ গর যাচ্ছি...\"সবকিছু যেন আধভাঙা, ধোঁয়াটে। স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।তবে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বুজতে পারল— রাজনগর।এই নামটা ও শুনেছে, মায়ের মুখে... অনেক আগেই। তাকে রাজনগর যেতে হবে।চিঠির এক কোণে ছোট করে লেখা ছিল— \"ইতি, শামীম।\"চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলল—\"জানেন চাচী, ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার লোকজন বলত—আমার জন্মের পরই নাকি আমার বাবা পালিয়ে গেছে।এই একটা কথা আমার শৈশবকে বিষাক্ত করে তুলেছিল।আমি তখন কিছুই বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম, অন্যদের মতো আমার পাশে একজন বাবা নেই।বহুবার মাকে জিজ্ঞেস করেছি—‘আমার বাবা কোথায়? নাম কি? তিনি কি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন?’মা কখনো রাগ করতেন , কিন্তু উত্তরও দিতেন না। একটাই কথা বলতেন—‘লোকের কথা শুনে মন খারাপ করিস না,বাপ।তোর বাপ একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। সে..........আমারে কথা দিছে। কথা রাখার জন্য হলেও আসতে হবে।এইটুকু বলেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। আমি দেখতাম, তাঁর চোখের কোনা ভিজে যাচ্ছে… কিন্তু তিনি আমাকে দেখতে দিতেন না।তাঁকে কাঁদাতে চাইতাম না... তাই বড় হয়ে আর কোনো দিন কিছু জিজ্ঞাসাই করিনি।শুধু ভেতরে ভেতরে একটা প্রশ্ন—সে মানুষটা কে ছিল? আর কেন তাকে এভাবে বিশ্বাস করে বসে আছে আমার মা?\"তারপর একদিন...সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁদার পর,মা হঠাৎ একবার ফিসফিস করে একটা নাম বললেন—‘শামীম’।শুধু একটা নাম।না ঠিকানা, না চেহারা, না ছবি।কিন্তু ওই নামটা...ওই একটা নামই যেন আমার সমস্ত জীবনটা উল্টে দিল।চলবে........কে শামীম।তাসলিমা কি চেনে শামীম কে। ফারজিয়া জীবনে নতুন কোন মোড় আসতে চলেছে।
0 Comments