রাত তখন নিঃশব্দ, শুধু দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে।চারপাশ বোঝার চেষ্টা করলো—সে কোথায়? কে তাকে এমন করলো?তার কানে যেন ফিসফিস শব্দ বাজে... কারা যেন কথা বলছে, ধরা যায় না কিন্তু অজানা ভাষার মতো, থেমে থেমে আসছে। হঠাৎ ঠান্ডা একটা বাতাস কানের পাশ দিয়ে বয়ে গেল। সে কেঁপে উঠলো। চারপাশের অন্ধকার যেন ঘন হতে লাগল, চেপে ধরলো তাকে।সে উঠে বসতে চাইল, কিন্তু শরীর সাড়া দিল না। হাতটা নাড়াতে গিয়ে বুঝতে পারল, তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মোটা দড়ি, হয়তো খেজুরগাছের ছাল দিয়ে বাঁধা।চোখ দুটো ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হচ্ছে অন্ধকারে। দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পেল—মোমবাতির মতো। ধীরে ধীরে আলোটা এগিয়ে আসছে… না, কেউ আসছে হাতে আলো নিয়ে।সে নিশ্বাস আটকে রাখল।পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেল—নরম, ভারী কাপড় টেনে হেঁচড়ে চলার শব্দ।শেষমেশ একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো সামনে। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু হাতে ধরা জ্বলা হারিকেনের আলোয় কাঁধ পর্যন্ত ঢাকা কালো চাদর দেখা যাচ্ছে শুধু।চেনা সেই কণ্ঠস্বর এবার সরাসরি বললো—\"কেমন আছো ফারজিয়া..?\" -০-সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ছোট্ট গ্রামটির সরু মেঠোপথে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আর পাশের পুকুরে জোনাকিরা জ্বলতে শুরু করেছে। রাজনগর নামে একটা ছোট গ্রামে সরদার পরিবারের বাস।সরদার বাড়িতে থাকে ফারজিয়া। তার বয়স মাত্র পনেরো । দুধে আলতা গায়ের বরণ একদম মা তসলিমার আক্তারের মতো। শান্ত স্বভাব, মায়াবী কাজল কালো চোখ, মাথায় ঘন কালো কেশ যা কোমর পর্যন্ত হবে। সব সময় চুল বেঁধে রাখে।কুরআনের হিফজ শুরু করেছে বছরখানেক হলো।তার ছোট বোন ফারহানা তার থেকে ২ বছরের ছোট।খুব চঞ্চল স্বভাবের, কিছুটা শ্যামল বর্ন তার। বড় ভাই রিয়াজ। পিতা সোহাগ সরদার। শহরে একটি বেসরকারি অফিস কাজ করে।প্রতিমাসে তাদের সাথে দেখা করে যায়। আসার সময় তাদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসে।তাদের বিশাল দালান-বাড়ী।বাড়ির সদরদরজা পাড়ী দিলে সামনে বড় একটা আঙ্গিনা। ডান-পাশে বড় পাকঘর,তার থেকে কিছুটা দূরে কলপাড় আর গোসলখানা। বাম-পাশে এক সারিতে ৩ টা বসতঘর।১ম কক্ষে তাসলিমা আক্তার থাকে,২য় কক্ষে থাকে ফারজিয়া এবং ফারহানা।শেষ কক্ষে থাকে রিয়াজ।তার বাম-পাশে দিকে আছে ২ কক্ষের মাঝে আছে পিছনদরজা।একটা কক্ষ ব্যবহার হয় লাহাড়িঘর হিসাবে অন্যটা অথিতি কক্ষ হিসেবে।ফারজিয়া মার সাথে পাকঘরে কাজে সাহায্য করছিলো।রিয়াজ সেই বিকালে গিয়েছিলো হাটে। সে বাজার করে ফিরলে, ফারহানা দৌড়ে যায় তাকে জড়িয়ে ধরতে।“ভাইয়া, আমার জন্য কি এনেছো?”রিয়াজ পকেট থেকে একটা ছোট্ট সাদা রঙের স্কার্ফ বের করে দিয়ে বলে, কাল থেকে মাদ্রাসায় এটা পরে যাবি ।ফারজিয়া চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। এই ভাইটার মধ্যে যেন এক গভীরতা আছে।ভাবতে ভাবতে বাজারের ব্যাগটা রিয়াজ হাত থেকে নিয়ে মাকে দিলো।কিছুক্ষন পর তাসলিমা আক্তার বললো,যা তিনজন পড়তে বস। তিন ভাই-বোন বাধ্য সন্তানের মত হারিকেনের আলোতে পড়তে বসলো।তাদের গ্রামে এখন কারেন্ট আসে নাই।বাজার দিকে আছে কিছু ঘরে।ঘন্টাখানেক পরে তাসলিমা খাবার জন্য ডাকলো। সবাই খাবার খেতে বসলো। তাসলিমা আক্তারের কিছু নিয়ম আছে যেমন খাবার সময় কোনো কথা বলা যাবে।মেয়ে লোক সন্ধ্যার ভিতরে ঘরে প্রবেশ করবে।সব সময় পর্দার ভিতর থাকতে হবে।আরো কথা নিয়ম ।সবাই নিঃশব্দে খাবার খেয়ে নিজ নিজ রুমে চলে গেলো। রাত ০৮:১৫ঘরে আলো নিভে গেছে। পূর্ণিমার রাত পূর্ণিমার আলোতে ঘর আলোকিত হয়ে আছে।জানালা দিয়ে মৃদ বাতাস প্রবেশ করছে।বিছানায় শুয়ে আছে দুই বোন।ঘুম আসছে না কারোর।হঠাৎ ফারহানা বললো,তোমাকে একটা কথা বলবো আপু\"হুমম..বল।\"\"না.. মানে কাল রাতে কে যেনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল,আমাকে দেখে চলে যায়।\"আতকে উঠে বলল \"কি বলস! আমি তো জানালার পাশে শুই!\"হঠাৎ বাইরে একটা হালকা শব্দ হয় — যেন কারো পায়ের আওয়াজ!\"...তুই শুনলি?\"ফারহানা ভয়ে ভয়ে বলল \"হ্যাঁ... জানালার পাশ থেকে আওয়াজ আসলো না?\"জানালার পর্দা নড়তেছে..।তারা দু’জনেই উঠে বসে, চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।বাহিরে কেও নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না।কিছুক্ষন পর পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।দুই বোন একে অপরকে শক্ত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে যাই।রাতের ঘটনা কাওকে বললো না । মাদ্রাসায় চলে গেলো। বিকালে মাদ্রাসা শেষে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।আসার সময় দেখলো,ধুলো জমা মেঠোপথ ধরে একটা পুরোনো বাইসাইকেল আসছে। চালকের মাথায় সাদা কাপড়, গায়ে ধুলো মাখা ফতুয়া। কেউ চিনে না তাকে।গ্রামের ছেলেপুলেরা দূর থেকে তাকে দেখছে। কেউ কেউ ফিসফিস করে—\"নতুন লোকটা কে রে?\"\"হুজুরের বাড়ির পাশেই নাকি উঠেছে আজ সকালে...\"আর তখনই গল্পের কেন্দ্রে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ফারজিয়ারসে জানত না, আজকের বিকেলটা তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।সন্ধ্যা ৬:৩০ঘরে সবাই মাগরিবের নামাজ শেষ করেছে। তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।ঠক ঠক ঠক...ফারজিয়ার মা দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে এক অচেনা যুবক। গায়ে ধুলো, চোখে গভীর ক্লান্তি, মুখে কেবল একটি কথা—\"আমাকে একটু পানি দেবেন? আমি খুব পথ হেঁটে এসেছি...\"মা জিজ্ঞেস করলেন,\"তুমি কারা? কোথা থেকে আসছো?\"যুবক মাথা নিচু করে বলল,\"আমি কোথা থেকে এসেছি, সেটা বড় কথা না, চাচী আমি একজনকে খুঁজছি, সে এই গ্রামেই আছে।হয়তো!\"ফারজিয়া চুপচাপ দরজার আড়াল থেকে দেখছিল সেই অচেনা ছেলেটিকে। তার চোখে ছিল যেন একটা অদ্ভুত কষ্ট আর রহস্য... এবং ঠিক সেই মুহূর্তে তার হৃদয়ে একটা অচেনা শব্দ বাজলো—কিসের শব্দ?..ভয় নাকি কৌতূহল?
0 Comments