রায়পুর গ্রামটা যেন ঘড়ির কাঁটার বাইরে চলে—শীতলপাটি, খড়ের চাল, বাঁশের বেড়া, আর রাত নামলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে বিদ্যুৎ আসে, যায়—আর ভূতের গল্প ঠিকই থাকে, রাতের বাতাসের মতো।গ্রামের উত্তরপ্রান্তে একটা পোড়োবাড়ি আছে। লোকে বলে এটা রাজা মানিক লালের জমিদারবাড়ি ছিল। এক রাতে ভয়ংকর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। জমিদার, চাকর-বাকর—কেউ আর বের হয়নি। সেই থেকে এই বাড়ি ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ নামেই কুখ্যাত।কিন্তু, যেটা সবাই মানে, সেটা হলো—এ বাড়িতে থাকা ভূতটা ভয়ংকর না, বরং অদ্ভুত।একদিন গ্রামের এক বাউল যুবক, জগলু, ফিরে এল শহর থেকে। শহুরে চাকরি ভালো লাগেনি। সে ঠিক করল, মাটির টানে ফিরবে রায়পুরে। থাকবার জায়গার অভাবে সে গিয়ে উঠল সেই পোড়োবাড়ির পাশের পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে। সবাই বলল,— “ওখানে রাত কাটালে নাকি স্বপ্নে কাঁথা টেনে নেয় ভূত!”জগলু হেসে বলল,— “ভূতের ভয়ে মানুষ মরলে, রায়পুরে গরু রাখারও জায়গা থাকত না!”প্রথম রাতে কিছুই হয়নি। শুধু রাতে দূরের বাঁশবনে কার যেন হাঁটাচলা। গুনগুন গলায় কেউ যেন গাইছে—\"রাই জাগে, ভূত সনে, অদ্ভুত সে প্রাণ...\"জগলু ভাবল, এ নিশ্চয় বাতাস। কিন্তু রাত তিনটার দিকে সে শুনল গোয়ালের দরজায় ‘টক টক’ শব্দ। বাইরে এসে দেখল কেউ নেই, কেবল গোয়ালঘরের ঠিক সামনে রাখা কলসিতে একটা গাঁদাফুল।পরদিন সকালে সে পল্লবী মাস্টারনির কাছে গিয়ে বলল,— “ভূত ফুল দেয় বুঝলে?”পল্লবী হেসে বললেন,— “ভূত পাগল হলে যা হয়!”এরপর রাতের পর রাত, কখনো গানের শব্দ, কখনো পেছনে কারো নিঃশ্বাস। কিন্তু কিছুই ভয়ানক না, বরং যেন কারো নিঃসঙ্গ উপস্থিতি। এক রাতে জগলু জেগে উঠে দেখল, পাশে বসে একটা আবছা সাদা কাপড়ের অবয়ব। তীক্ষ্ণ চোখ, অথচ দৃষ্টি মায়াভরা।ভূতটি বলল,— “আমি ভীত না, আমি অদ্ভুত। কেউ ভালোবাসেনি আমাকে। এ বাড়ির চাকর ছিলাম, প্রেমে পড়ি জমিদার কন্যার। জানলে আমাকে পুড়িয়ে মারা হয়... এই বাড়িসুদ্ধ।”জগলু প্রশ্ন করল,— “তুমি কি চাইছ?”ভূতটি কাঁপা গলায় বলল,— “শুধু একটা গান। যে প্রেম ব্যর্থ, তা যেন অন্তত কারও কণ্ঠে বাঁজে।সেই রাতের পর থেকে জগলু রাত হলেই গায়—\"সেই প্রেম, হারায় নি, আছে গোপনে...\"গ্রামের মানুষ বলে, রাত নামলে পোড়োবাড়ি থেকে সুরেলা বাঁশির শব্দ ভেসে আসে। কেউ কেউ বলেছে, তারা দেখেছে গাঁদাফুলের মালা পড়ে এক বাউল ছায়ার সঙ্গে আরেক সাদা ছায়া নেচে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।আর জগলু?সে এখন গান লিখে। কেউ বলে পাগল, কেউ বলে সাধক।সে শুধু বলে—— “ভুত আছে… কিন্তু সে ভয় দেখাতে আসে না। সে তো শুধু চায়, কেউ যেন তার কথা মনে রাখে।”
রায়পুর গ্রামটা যেন ঘড়ির কাঁটার বাইরে চলে—শীতলপাটি, খড়ের চাল, বাঁশের বেড়া, আর রাত নামলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে বিদ্যুৎ আসে, যায়—আর ভূতের গল্প ঠিকই থাকে, রাতের বাতাসের মতো।গ্রামের উত্তরপ্রান্তে একটা পোড়োবাড়ি আছে। লোকে বলে এটা রাজা মানিক লালের জমিদারবাড়ি ছিল। এক রাতে ভয়ংকর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। জমিদার, চাকর-বাকর—কেউ আর বের হয়নি। সেই থেকে এই বাড়ি ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ নামেই কুখ্যাত।
0 Comments