শিরোনাম: আশ্চর্য্য লাঠিলেখা: মোবারক হোসেনআমার বয়স তখন হয়তো সাত কি আট। তখনও আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সন্ধ্যার পরেই কেরোসিনের হারিকেন জ্বালিয়ে রাত কাটত। ঘর-বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যেত মাগরিবের আজান পেরোলেই।আমাদের মাটির ঘরের এক কোণায় রাখা ছিল এক অদ্ভুত লাঠি। কালো চকচকে, মাথার দিকটা মোটা, গোড়ার দিকে সরু। আব্বা বলত, এটা তার বাবার আমলের। কেউ কখনো ছুঁতে সাহস করত না। দাদি সবসময় বলে যেতেন, \"এই লাঠি খালি লাঠি না রে পুত, এর ভেতরে রহমতের জিন বসে আছে।\"তখন এসব কথার মানে বুঝতাম না, শুধু ভয় করত।এক রাতে…একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ভেতরে গভীর নিস্তব্ধতা। ঘরের ভেতর অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বল আলো! হারিকেন নিভে গেছে অনেক আগেই, তাহলে আলো আসছে কোত্থেকে?তাকিয়ে দেখি, সেই লাঠিটা জ্বলজ্বল করছে! যেন কোনো বাতির ভেতর থেকে আলো বেরোচ্ছে! ঘরের মাটিতে এর আলো পড়ে এমন এক ধরণের চমৎকার নকশা তৈরি করছে, যা আমি আগে কখনও দেখিনি।আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ দেখি, লাঠির মাথা দিক থেকে ধোঁয়ার মতো একটা কুয়াশা বেরিয়ে আসছে। সেই ধোঁয়ার মধ্যে একটা অবয়ব… প্রথমে আবছা, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হলো—একজন বৃদ্ধ! দাড়ি মাথা সাদা, মুখে রহস্যময় হাসি।আমি চিৎকার করতে যাব এমন সময় সেই বৃদ্ধ হাত তুলে ইশারা করল, “ভয় পাবি না… তুই আমার রক্তের ধারা…”তারপর যা বলল তা আমি জীবনে ভুলতে পারি না।সে বলল, এই লাঠি তার নয়, তার আগের আরও সাত পুরুষ আগের। এটা আসলে এক আশ্চর্য্য বস্তু। যাকে গ্রহণ করে, সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়—কিন্তু শর্ত আছে। একবার ব্যবহার করলে তিনটি সত্য দেখতে পাবে, কিন্তু একটির পরিণতি বদলাতে চাইলেই জীবন থেকে কিছু অমূল্য হারাতে হবে।তিনটি দৃশ্যলাঠির আলোয় আমি তিনটি দৃশ্য দেখি:১. আমার বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, ডাক্তার নেই, টাকা নেই।২. আমার বড় বোনকে কাঁদতে দেখি—সে বিয়ের দিন কনে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বর আসেনি।৩. আমি নিজেকে দেখি শহরে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে—আমার হাতে সেই লাঠি, লোকজন হাততালি দিচ্ছে, কিন্তু আমি কাঁদছি।বৃদ্ধ বলল, “একটি দৃশ্য বদলাতে চাইলে, বাকিগুলো স্থির থাকবে, কিন্তু তুই হারাবি কিছু বড়।”আমি কিছু বলার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি।পরদিন…ঘুম ভাঙার পর দেখি সূর্য উঠেছে, মা রান্নাঘরে। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, লাঠি ঠিক আগের জায়গায় পড়ে আছে—একদম চুপচাপ, নিরীহ।কিন্তু কিছুই আগের মতো ছিল না। পরের কয়েক বছরে সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে একে একে—যেমন আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম।তবে আমি একটিই বদলে দিতে চেয়েছিলাম—আমার বাবার মৃত্যু। সে জন্যেই হয়তো আমার বোনের বিয়ে ভেঙে যায়… আর আমি? আজও সেই লাঠির রহস্য লুকিয়ে রেখেছি নিজের ভেতর।শেষ কথাআজ আমি সেই মঞ্চে, বহু মানুষ আমাকে ‘আলোকদর্শী’ বলে ডাকে। কিন্তু কেউ জানে না, আমার চোখে আলো নয়, ভেতরে জমে আছে তীব্র এক অন্ধকার—একটি সত্য বদলাতে গিয়ে হারানো কিছু মানুষের সুখ।আর সেই লাঠি?
আমার বয়স তখন হয়তো সাত কি আট। তখনও আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সন্ধ্যার পরেই কেরোসিনের হারিকেন জ্বালিয়ে রাত কাটত। ঘর-বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যেত মাগরিবের আজান পেরোলেই।আমাদের মাটির ঘরের এক কোণায় রাখা ছিল এক অদ্ভুত লাঠি। কালো চকচকে, মাথার দিকটা মোটা, গোড়ার দিকে সরু। আব্বা বলত, এটা তার বাবার আমলের। কেউ কখনো ছুঁতে সাহস করত না। দাদি সবসময় বলে যেতেন, \"এই লাঠি খালি লাঠি না রে পুত, এর ভেতরে রহমতের জিন বসে আছে।\"
0 Comments