কাজল কালো চোখের মায়া, আলতা পায়ে নুপুর পড়া, রূপের ঝলকে মাতোয়ারা সারা প্রকৃতি—নাম তার বনলতা সেন। সে হাসে আর মুগ্ধতা ঝড়ে। কে জানে তার এত ঝলকের রহস্য কী? তার আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা সারা বাড়ি। তবে চেয়ে দেখ, আজ সে একা বসে নিস্তব্ধ হয়ে জানালার পাশে। নেই পায়ে রক্তিম আলতা, চোখের কোনেও নেই সেই কাজল। কেমন যেন উস্ক-খুস্ক হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় একটা প্রাণহীন দেহ। অথচ এই সেই বনলতা, যার হাসির ঝলকে মাতোয়ারা ছিল চারপাশ। কী হলো তার? তাহার রূপের ব্যাখ্যা যে বড় রহস্যময়। তবে কি এমন হলো, শেষ অব্দি সে বেছে নিল নিস্তব্ধতা?❝ ওহে প্রিয় বনলতা,কবে ভাঙবে তোমার এই নীরবতা!তোমার সেই কাজল কালো আঁখি,আলতা রাঙা পায়ে ঘুঙুর পড়া কবে দেখিব আবার সেসব?তুমি যে হৃদয়ের রূপ, কেন তুমি এতো নিশ্চুপ?❞বনলতা চুপচাপ জানালার ধারে বসে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, কিন্তু সে নড়ছে না। যেন হাজারো বছরের নীরবতার ভার তার কাঁধে। চুপচাপ থাকাটা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এই বনলতা একসময় ছিল উচ্ছ্বাসের প্রতীক। তার হাসি, তার চোখের চাহনি, তার পায়ের নূপুর—সব মিলিয়ে সে যেন এক জীবন্ত কবিতা ছিল।গ্রামের এক বিশাল পুরোনো দোতলা বাড়ির এক কোণে জন্ম বনলতার। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল আলাদা। গলায় সুর, পায়ে ছন্দ, চোখে আলো। বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মা গৃহিণী। বনলতার মধ্যে যেন প্রাচীন বাংলার রূপের ছাপ—জীবন্ত মূর্তি। তার হাসিতে যেমন ছিল শিশিরের নরমতা, তেমনি ছিল আগুনের উষ্ণতা।তার জীবনে আলো আসে অরিন্দমের আগমনে। শহর থেকে গ্রামে বদলি হয়ে আসে অরিন্দম, বনলতার বাবার সাবেক ছাত্র। একদিন লাইব্রেরিতে দেখা। প্রথম দেখাতেই চোখে চোখ, কিন্তু কোনো কথা নয়। বনলতা কখনো চোখ তুলে তাকায় না, কিন্তু অরিন্দম বুঝে যায়—এই মেয়েটি সাধারণ নয়। ধীরে ধীরে জানাশোনা বাড়ে। শুরু হয় খোলা চিঠি, কবিতার লুকোচুরি, সন্ধ্যায় বৃষ্টির ছায়া মেখে ঘুঙুরের শব্দে নাচ দেখা।বনলতা হাসত, ঝলকে উঠত তার মুখ। সে বলত, “তুমি কি জানো, প্রতিটি নাচ আমি তোমাকে ভেবে শুরু করি?” অরিন্দম অবাক হতো। শহরের হইচই থেকে দূরে এই মেয়েটি যেন প্রকৃতির এক টুকরো।হঠাৎ একদিন অরিন্দমের হাতে আসে এক রহস্যময় চিঠি। লেখা ছিল—“বনলতার রূপের পেছনে আছে এক অভিশাপ। তাকে ভালোবাসো, তবে খুব সাবধানে।” অরিন্দম অবাক, চিন্তিত। কিন্তু প্রেমের গভীরতায় সে ভুলে যায় সব। সে বনলতার হাতে তুলে দেয় এক নূপুর, আর বলে, “তুমি যেখানেই থাকো, এই শব্দে আমি তোমায় খুঁজে নেব।”বনলতা সেই রাতেই প্রথমবার বলে, “অরিন্দম, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। আমার ভেতর আছে এক ভয়ানক অতীত, তুমি কি শুনতে চাও?” কিন্তু অরিন্দম তার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেছিল, “না বনলতা, আমি তোমার অতীত নয়, ভবিষ্যৎ দেখতে চাই।”কিন্তু ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। এক ভয়াল রাতে বনলতা হঠাৎ হারিয়ে যায়। তার ঘরে পড়ে থাকে সেই নূপুর, এক চিঠি, আর তার আঁকা একটি ছবি—তাতে লেখা, “আমি আসবো, যখন পায়ে নূপুর পরবো আবার।”অরিন্দম পাগলের মতো খুঁজেছে তাকে। শহর, গ্রাম, নদীঘাট—সব জায়গায় গিয়েছে। কোনো সন্ধান নেই। বছর কেটে যায়, অরিন্দম ফিরে আসে। কিন্তু বনলতা নেই।বছর পাঁচেক পর, হঠাৎ এক ঝড়ের রাতে এক ভাঙা শরীরে বনলতা ফিরে আসে তার বাড়িতে। কিন্তু সে এখন আর আগের বনলতা নয়। নেই চোখে কাজল, নেই মুখে হাসি, পায়ে নেই নূপুর। শুধু জানালার ধারে বসে থাকে। কোনো কথা বলে না।অরিন্দম তাকে দেখে চমকে ওঠে। সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?” বনলতা চুপ। সে শুধু একটা চিঠি এগিয়ে দেয়।চিঠিতে লেখা ছিল— “আমাকে এক শক্তি বন্দি করেছিল। আমার রূপ ছিল তাদের জন্য ঝুঁকি। আমার হাসিতে তারা ভয় পেত। আমি ছিলাম এক পুরনো অভিশাপের উত্তরসূরি। যে-ই আমাকে ভালোবাসে, তাকে তারা নিয়ে যায়। আমি পালিয়েছিলাম, কারণ তোমাকে হারাতে চাইনি। কিন্তু তারা আমাকে ধরেছিল। এখন আমি মুক্ত, কিন্তু আমার মন আর শরীর এক নয়।”অরিন্দম সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নেয়—যা-ই হোক, সে বনলতার পাশে থাকবে। সে বলে, “তুমি নূপুর না পরলেও, আমি তোমার শব্দ শুনি। তুমি হাসো না, তাও আমি তোমার হাসির প্রতিধ্বনি শুনি। ফিরে এসো বনলতা, আবার।”সেই রাতে প্রথমবার, বনলতা চোখ তোলে। সে বলে, “তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছো।” ধীরে ধীরে সে কথা বলতে শুরু করে। আবার তার চোখে কাজল ওঠে। পায়ে পড়ে এক জোড়া নূপুর—অরিন্দমের দেয়া পুরনো নূপুর।পুরো বাড়ি আবার জেগে ওঠে। সন্ধ্যায় নাচে ওঠে বনলতা, আঙিনায় ঘুঙুর বাজে। অরিন্দম জানালার পাশে বসে, আর ভাবে—একটা প্রেম যদি সত্য হয়, তা পারে অভিশাপকেও হারাতে।বনলতা আর নীরব নয়। সে আজ তার কণ্ঠে বলে— “প্রেম যদি নিঃশব্দ হয়, তবু তার একটা শব্দ থাকে। সেই শব্দই আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
বনলতা সেন(পুরো পর্ব)কাজল কালো চোখের মায়া, আলতা পায়ে নুপুর পড়া, রূপের ঝলকে মাতোয়ারা সারা প্রকৃতি—নাম তার বনলতা সেন। সে হাসে আর মুগ্ধতা ঝড়ে। কে জানে তার এত ঝলকের রহস্য কী? তার আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা সারা বাড়ি। তবে চেয়ে দেখ, আজ সে একা বসে নিস্তব্ধ হয়ে জানালার পাশে। নেই পায়ে রক্তিম আলতা, চোখের কোনেও নেই সেই কাজল। কেমন যেন উস্ক-খুস্ক হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় একটা প্রাণহীন দেহ। অথচ এই সেই বনলতা, যার হাসির ঝলকে মাতোয়ারা ছিল চারপাশ। কী হলো তার? তাহার রূপের ব্যাখ্যা যে বড় রহস্যময়। তবে কি এমন হলো, শেষ অব্দি সে বেছে নিল নিস্তব্ধতা?❝ ওহে প্রিয় বনলতা,কবে ভাঙবে তোমার এই নীরবতা!তোমার সেই কাজল কালো আঁখি,আলতা রাঙা পায়ে ঘুঙুর পড়া কবে দেখিব আবার সেসব?তুমি যে হৃদয়ের রূপ, কেন তুমি এতো নিশ্চুপ?❞বনলতা চুপচাপ জানালার ধারে বসে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, কিন্তু সে নড়ছে না। যেন হাজারো বছরের নীরবতার ভার তার কাঁধে। চুপচাপ থাকাটা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এই বনলতা একসময় ছিল উচ্ছ্বাসের প্রতীক। তার হাসি, তার চোখের চাহনি, তার পায়ের নূপুর—সব মিলিয়ে সে যেন এক জীবন্ত কবিতা ছিল।
Vlo legeche rupkothar golpo misrito.