মধুপুর ফরেস্টে আতংক

মধুপুর গড় সবুজ আর ঘন বনের জন্যই বিখ্যাত। এখানে স্যাল গাছের সারি, ছায়াঘেরা পথ, শিমুল-করবীর ফাঁক দিয়ে আসা আলো যেন অরণ্যের গোপন রহস্য বহন করে। এই বনে বাঘ-সিংহ নেই, নেই ভয়ংকর কোনো হিংস্র প্রাণীও। আছে শুধু বানর, হনুমান, হরিণ আর অসংখ্য পাখি। তবুও গত কয়েক মাস ধরে বনকর্মীদের বুক কাঁপিয়ে তুলেছে এক অদ্ভুত আতংক।প্রায় প্রায় এক একজন ফরেস্ট কর্মীর ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যাচ্ছে বনের ভেতর। কারও বুক চিরে বের করা, কারও হাত-পা ছিঁড়ে ছিটকে ফেলা—দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন দশ-পনেরোটা বাঘ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অথচ এই বনে তো বাঘ নেই!প্রথম ঘটনাফরেস্ট গার্ড শফিকুল রাতে পাহারারত ছিলেন। ভোরের দিকে সহকর্মীরা তাকে খুঁজে পায় সালগাছের গোড়ায় রক্তাক্ত অবস্থায়। শরীরের মাংস ছিঁড়ে টুকরো টুকরো, তবে আশেপাশে কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপ নেই। শুধু লম্বা আঁকাবাঁকা দাগ মাটিতে দেখা যায়, যেন ভারী কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।দ্বিতীয় ঘটনাদুই সপ্তাহ পর আরেক কর্মী, নুরনবী, নিখোঁজ হয়। তিন দিন পর তার দেহ পাওয়া গেল বনের গভীরে একটি ঝোপে। মুখ নেই, চোখ উপড়ে নেওয়া। আশ্চর্য বিষয় হলো—তার গায়ে কামড়ের দাগ নেই, বরং ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু কে এমন কাজ করবে?তৃতীয় ঘটনাএরপর এক রাত। টহলে থাকা দুই কর্মী হঠাৎ ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পায়। তারা টর্চ জ্বালাতেই দেখে—সামনের ঝোপ থেকে ধীরে ধীরে উঠছে এক বিশালাকার কালো ছায়া। মাথাটা যেন মানুষের মতো, কিন্তু চোখ দুটো লাল জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল। পরে দেখা গেল, যিনি চিৎকার করেছিলেন, তিনি নেই। শুধু পড়ে আছে তার ছেঁড়া জামা আর রক্তমাখা বুটজোড়া।ক্রমে বনের সাধারণ মানুষজনও আতংকিত হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা বলে, এটা নাকি \"অভিশপ্ত প্রেতাত্মা\", যে বহু বছর আগে এখানেই মারা গিয়েছিল। আবার কেউ বলে, এটা বনলুটেরাদের কাজ—তারা গোপনে কাঠ পাচারের জন্য আতংক তৈরি করছে।একদিন সাহসী কর্মী রফিক সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক রহস্য উদঘাটন করবেন। গভীর রাতে তিনি লুকিয়ে বসে থাকলেন একটি শুকনো গর্তের পাশে। হঠাৎ গাছের ফাঁক থেকে দেখা গেল তিন-চারজন মুখোশ পরা লোক, হাতে ধারালো দা আর বড় ছুরি। তারা হাসতে হাসতে বলছে—“আরও একজন কমলো, এখন থেকে বনে কেউ ঢুকতে পারবে না। গাছ কাটতে সুবিধা হবে।”রফিক বুঝলেন—এই হত্যার পেছনে আছে কাঠ পাচারকারী চক্র। তারা লোকজনকে ভয় দেখাতে এভাবে হত্যা করে গুজব ছড়াচ্ছে, যেন মানুষ ভাবে অদ্ভুত কোনো অজানা প্রাণী আছে বনে।রফিক দ্রুত সদর দপ্তরে খবর দিলেন। এক অভিযানে ধরা পড়ল পুরো চক্র। তাদের কাছে পাওয়া গেল মানুষের দেহ ছিন্নভিন্ন করার সব সরঞ্জাম। সেই রাতের আতংক ছড়ানো লালচোখ \"প্রেতাত্মা\" আসলে তাদেরই এক লোক, যিনি বিশেষ মুখোশ পরে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ভয় দেখাত।